বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১২৩): লৌহ যবনিকা

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত “কারার ঐ লৌহ কপাট” গানে এ আর রহমানের দেয়া সুর নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা নিয়ে কয়েকদিন আগে ১১ নভেম্বর ২০২৩ সুর অসুর নামে একটি স্ট্যাটাস লিখেছিলাম

আর রহমান বিখ্যাত নজরুল গীতি কারার লৌহ কপাট গানে নতুন সুর আরোপ করেছেন। এই নিয়ে ফেসবুক তোলপাড়। একারণেই ইউটিউবে গানটি খুঁজে শুনলাম। মানুষ নতুন যে কোন জিনিস গ্রহণ করে তার অভিজ্ঞতার আলোকে। তাই চাই বা না চাই গানের মূল সুরের সাথে একটা তুলনা এমনিতেই চলে আসছিল। এই আপেক্ষিক মহাবিশ্বে আমরা তুলনা না করে কোন কিছু নিতে পারি না। এমনকি একই গান একাধিক শিল্পী গাইলে আমরা তাদের মধ্যেও তুলনা করি। এখানে তো একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষিত। নিজেকে প্রশ্ন করলাম যদি মূল সুরে গানটি শোনা না থাকত তাহলে এই সুর কেমন লাগত? যদি ভাষা না জানতাম হয়তো খারাপ লাগত না। কারণ গান শুধু সুর নয়, কথাও। সেই কথাগুলো কিভাবে বলছি তার উপর নির্ভর করে অর্থ। সুরের কারণে কিছু কিছু শব্দ একাধিক বার উচ্চারণ করায় আর ইনটোনেশন বা স্বর পরিবর্তন করায় বাক্যগুলো অর্থ হারিয়েছে বলে মনে হয়েছে। বাঙালি হিসেবে যে বিষয়গুলো আমার কাছে সামনে চলে এসেছে ভিনদেশীদের কাছে সেটা নাও হতে পারে। আর রহমানের অধিকার ছিল কি না এই গানে নতুন সুর আরোপ করার। আইনগত বাধা না থাকলে তিনি সেটা করতেই পারেন। দর্শক বা শ্রোতা গ্রহণ করবে কি না সেটা ভবিষ্যত বলতে পারবে। দিনের শেষে মানুষই ঠিক করে কোন সুর টিকে থাকবে আর কোনটা হারিয়ে যাবে। বর্তমান যুগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কোন কিছু বাজার থেকে সরিয়ে ফেলা যায় না। বরং এধরণের ঘটনার মধ্য দিয়ে নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ যদি আরেকটু বেশি মানুষের আলোচনায় চলে আসেন তাতে ক্ষতি কি? আমরা যদি যখন কেউ রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল বা অন্য কারো গানে সুর আরোপ করে তখন প্রতিবাদ করি আর অন্য সময় তাদের সৃষ্টি রক্ষার ব্যাপারে, তা সে সুর বিকৃতিই হোক আর শব্দ পরিবর্তন হোক, নির্লিপ্ত থাকি, তাহলে শুধু আর রহমান নয়, পাড়ার যে কেউ সেটা করবে। আরও একটা কথা, কারার লৌহ কপাট গানের মধ্যেই আছে পরিবর্তনের আহ্বান, ভাঙার আহ্বান। সেটাও যেন আমরা ভুলে না যাই।

এর পরে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন দাবি দাওয়া উঠলে আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়। সেগুলো নিয়েই আজকের লেখা বা বলতে পারেন কিছু প্রশ্ন।

এটা মনে হয় ১৯৭৪ বা ১৯৭৫। মানিকগঞ্জে এক্সিবিশন চলছে। সেসময় যেকোনো ধরণের মেলা বা প্রদর্শনীর একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল যাত্রা। সেই এক্সিবিশনে একটা যাত্রা পালার শুরু হল নায়কের না গান না কবিতা এমন ভাবে উপস্থাপিত “আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই তুমি তাই গো” দিয়ে। এরপর যখন মস্কো আসি ছাত্র জীবনের শেষের দিকে নিয়মিত থিয়েটার দেখতে যেতাম। যদি সোভিয়েত আমলে সব থিয়েটার ছিল সরকার চালিত ও সরকার দ্বারা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে অনেক নতুন থিয়েটার জন্ম নেয়। বিখ্যাত সব অভিনেতারা নিজেদের থিয়েটার গড়ে তোলেন। আমিও উৎসাহ নিয়ে নতুন পুরানো সব জায়গায় তাদের মঞ্চায়ন দেখি। যেহেতু দস্তইয়েফস্কি আমার প্রায় লেখক, তার লেখা নিয়ে কোন শো হলে আমি চেষ্টা করতাম সেটা দেখতে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে শুধু রুশ দেশে নয় কাম্যুর মত লেখক দস্তইয়েফস্কির বেসি বা ডেভিল উপন্যাস অবলম্বনে পসেসড নামে এক নাটক রচনা করেন। আসলে আমরা পাঠকেরা অনেক স্বাধীন। লেখক তার রচনায় যেটা বলতে চেয়েছেন আমরা সেটা পড়ে তার অন্য ব্যাখ্যা দিতেই পারি। কারণ আমাদের সব দেখাই নির্ভর করে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার উপর। যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের জীবন ভিন্ন, প্রতিটি ঘটনায় আমাদের ব্যাখ্যাও ভিন্ন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বিখ্যাত থিয়েটার তাগানকায় লুবিমভ যদি “ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট” প্রায় মূল রচনার মত করেই করেন, উ নিকিতস্কিখ ভারোতে রজভস্কি মাত্র দুজন শিল্পী ব্যবহার করে “হত্যাকারী” নামে সেটা ভিন্ন ভাবে দেখান। একই কথা বলা চলে বুলগাকভের “মাস্টার ও মারগারিতা” সম্পর্কে। এবং এরা বলে একেক জন পাঠক নিজের মত করে কোন কিছু পাঠ করে। তাই সে নিজের মত করে কোন কিছু ইন্টারপ্রিটেশন করতেই পারে। বিভিন্ন নাটকে বিভিন্ন গান ব্যবহার করা হয়, অনেক সময় সেসব গানে নতুন সুর পর্যন্ত দেয়া হয়। খুব দূরে যাব কেন, যদি ভুল না করি আমাদের আরেক প্রাণপ্রিয় “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানের মূল সুর ছিল ভিন্ন। তাছাড়া কোন গান যখন কোন সিনেমার অংশ হয়ে যায় সেটা আগের মত থাকে না, সে এখন স্বতন্ত্র্য নয়, একটা বৃহৎ কিছুর অংশ মাত্র।

আমি ফটোগ্রাফি করি। যখন সবুজ পাতার ভিড়ে লাল ফুলের ছবি তুলি তখন আমার লাল সবুজ পতাকার কথা মনে হয় যদিও জানি এটা নেহায়েত আমার সাবজেক্টিভ ভাবনা। এটা অনেকটা ছোটবেলায় যেকোন বইয়ের পাতায় দেবী সরস্বতীকে দেখার মত বা যেকোন আরবি টেক্সট কোরআন বলে ভ্রম করা। আমার ধারণা পিপ্পা সিনেমায় কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি নজরুল গীতি হিসেবে গাওয়া হয়নি, হয়েছে সিনেমার ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে। কয়েক বছর আগে কোলকাতার কিছু নামকরা গায়ক আমার সোনার বাংলা ও জনগণ মন গান দুটি গেয়েছেন। এ দু’টোই অনেক বড় গান। শুধু অংশবিশেষ বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যদিও এ নিয়ে তখন কিছু কথা উঠেছিল তারপরও এদের কখনোই জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে দেখার অবকাশ ছিল না, অবকাশ ছিল না এর মধ্য দিয়ে জাতীয় সঙ্গীতের অবমাননা করা। একই ভাবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট প্যাটার্নে তৈরি লাল সবুজ পতাকা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। অন্য কোন কিছুই আমাদের পতাকা বলে গণ্য হবে না।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১২২): অক্টোবর বিপ্লব -বিজন সাহা

যতদূর শুনেছি পিপ্পা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি এক সিনেমা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর অসংখ্য ছবি হয়েছে, এখনও হচ্ছে। সেসব ছবি শুধু যুদ্ধের কথা বলে না, সেখানে আছে প্রেম, আছে ভালোবাসা, আছে বিশ্বাসঘাতকতা, আছে সাধারণ জীবন। একাত্তরে আমার বয়স ছিল মাত্র সাত। সেই স্মৃতি নিয়ে একাত্তরের সাত সতেরো নামে একটি স্মৃতিকথা পর্যন্ত লিখেছি। এখনও মনে আছে সেই সময় শুধু ভয়ে পালিয়ে থাকাই ছিল না, ছিল খেলাধুলা, ছিল ঝগড়াঝাঁটি। চোখের সামনে মানুষ মরেছে আবার জন্ম নিয়েছে শিশু। আমাদের দেশে তো মুক্তিযুদ্ধের উপরে খুব বেশি সিনেমা হয়নি। আজ ভারতের এক পরিচালক এর উপর ছবি করছেন। সেই যুদ্ধ কিন্তু শুধু আমাদের যুদ্ধ ছিল না, ছিল ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধও। সেই সিনেমা কেমন হয়েছে জানি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর প্রচুর রুশ সিনেমা যেমন দেখেছি তেমনি বেশ কিছু জার্মান ছবিও দেখেছি। বলা বাহুল্য সেটা ছিল একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। এটা অনেকটা আমাদের ও শ্রীলঙ্কার মানুষের দৃষ্টিতে রামায়ণের ঘটনার ব্যাখ্যার মত। তারপরেও রাশিয়ায় তা দেখিয়েছে।

ভয় হয় নজরুল গীতি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়ে আমরা সিনেমাটি নিষিদ্ধ না করি। এতে আর যাই হোক আমাদের কোন লাভ হবে না, লাভ হবে স্বাধীনতা বিরোধীদের। তাছাড়া ইতিমধ্যে সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের টেক্সট ব্যবহার করার অনুমতি নিয়েই তারা এটা করেছেন। এসব নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা পরিচালকদের হাত পা বাঁধব না তো? কারণ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে রচিত সব সিনেমাই একটু অন্য রকম হয়। এটা টেকনিক্যাল কারণে যেমন তেমনি বানিজ্যিক কারণেও। আমার বিশ্বাস এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছি। এবার ক্ষান্ত দেয়া দরকার। আর যদি এর পরেও প্রতিবাদ করতেই হয় সুরের আগে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিৎ শব্দ নিয়ে। কে না জানে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় মহাশ্মশান শব্দ আমরাই গোরস্থান করেছি। আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের কবি সাহিত্যিকদের সন্মান না করি, পপুলিস্টিক দৃষ্টি থেকে ইচ্ছে মত শব্দ বদলাই অন্যদের কাছ থেকে কি আশা করব?

আবার আসি ছবির কথায়। আপনি যখন কোন বন বা মাঠের প্রেক্ষাপটে কোন প্রাণীর ছবি তুলেন তখন সেই প্রাণী কম্পোজিশনের দিক থেকে ঠিক জায়গায় আছে কিনা সেটাই দেখেন। কিন্তু যখন আপনি ওই প্রাণীর ক্লোজ-আপ তুলতে চান তখন কিন্তু তার নিজস্ব সৌন্দর্য তুলে ধরেন। অর্থাৎ দুই ভিন্ন প্রেক্ষিতে একই প্রাণীকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন। আমাদের সমস্যা হল আমরা প্রায়ই চোখের সামনের পাঁচ পয়সার মুদ্রাটা দেখি, কিন্তু সেটা যে সমস্ত মহাবিশ্ব আমাদের চোখের আড়াল করে রাখছে সেকথা প্রায়ই ভুলে যাই। এখানেও মনে হয় সেটাই ঘটছে। যদিও দীর্ঘ সিনেমার ছোট্ট একটা অংশ জুড়ে আছে এই গান, আমরা শুধু গানের কথাই বলছি সিনেমার কথা ভুলে গিয়ে। ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করে আমরা প্রায়ই বৃহৎ চিত্রটা মিস করছি। যতদূর জানি এ আর রহমান এই গানটিকে নজরুল গীতি হিসেবে দাবি করেননি। নজরুল গীতি বা রবীন্দ্র সঙ্গীত এটা শুধু কথা হয়, কথা ও সুরের সমন্বয়। আমি প্রথমেই এই সুরের প্রতি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করেছি। এটা নিয়ে খুব বেশি হৈচৈ করলে মনে হয় আমরা এটাকে বরং জনপ্রিয় করে তুলব।

তবে এই গানটাকে নিয়ে যেভাবে প্রতিবাদ হয়েছে সেটা আমাকে আশার আলো দেখায়। আজ বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যের উপর যেভাবে ছুরি চালানো হচ্ছে, বর্ণবাদের দোহাই দিয়ে যেভাবে সমস্ত ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্ণের নায়ক নায়িকা দিয়ে পুরানো সিনেমা বদলানো হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমা সংস্কৃতি কালচারাল জেনোসাইডের শিকার হতে পারে। সেদিক থেকে এই প্রতিবাদ আশাব্যাঞ্জক। একই সাথে জাতি হিসেবে আমরা যে দিন দিন না র‍্যাশনাল না হয়ে আবেগ ও অনুভূতি প্রবন হয়ে যাচ্ছি সে সম্পর্কেও আমাদের সজাগ থাকা দরকার।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো