বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১২২): অক্টোবর বিপ্লব

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

মাত্র তিন দিন আগে বরাবরের মতই এলো ০৭ নভেম্বর। এলো স্বাভাবিক বেশে, প্রকৃতির নিয়মে। প্রকৃতি বিপ্লবের কথা জানে না, বিপ্লবের কথা জানে না পৃথিবী। পৃথিবী আপন মনে নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে লাটিমের মত ঘুরে আর ঘুরে সূর্যের চারিদিকে। আসে শীত, আসে বসন্ত, আসে গ্রীষ্ম, আসে হেমন্ত। আর এভাবেই আসে ০৭ নভেম্বর। তবে কিছু কিছু মানুষের কাছে এটা আর দশটা দিনের মত নয়। মানব ইতিহাসে এটা এক বিশেষ দিন।

এদেশে আসার আগে যখন বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তখন এই দিনটির অন্য রকম গুরুত্ব ছিল আমাদের কাছে। ০৭ নভেম্বর ছিল মহান অক্টোবর বিপ্লব দিবস। আমাদের কাছে সেটা ছিল আলোকবর্তিকা স্বরূপ। ধার্মিকদের কাছে যেমন লক্ষ্মী পূর্ণিমা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, শবেবরাত বা খ্রীস্টমাস – সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের কাছে ০৭ নভেম্বর ছিল তেমনি পবিত্র এক দিন। অন্তত সে রকম শ্রদ্ধা ভরেই আমরা এ দিনটি পালন করতাম। সোভিয়েত আমলেও সেরকম গাম্ভীর্যের সাথে এই দিনটি পালন করা হত যদিও তাতে সেই সাথে থাকত আনন্দ উল্লাস।  স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এই দিনটি স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে তুলত। ফলে সেই সময় যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছে আর বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে – তাদের অনেকের কাছেই এটা উৎসবের দিন।

আমরা যারা এ দেশে পড়াশুনা করতাম, তারা সব অর্থেই এক স্বপ্ন রাজ্যে বাস করতাম। বিশেষ করে যারা তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে আসা। ছিল পড়াশুনা করার সুন্দর পরিবেশ। আহামরি না হলেও ভদ্র জীবন যাপন করার মত স্টাইপেন্ড। অন্তত ছাত্রদের জন্য। ছিলেন স্নেহশীল শিক্ষক। দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বৈষম্য দেখে অভ্যস্ত আমরা এখানে পেলাম মানুষের সম্মান। সে সময় সোভিয়েত বন্ধুদের সাথে এক আধটু ওঠা বসা থাকলেও সত্যিকার সোভিয়েত সমাজটা ছিল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশ থেকে আসার পর রাস্তাঘাটে, ট্রামে বাসে, মেট্রোতে যখন প্রায় নির্বিকার মানুষদের কোন বই বা খবরের কাগজ পড়তে দেখতাম, মনে হত এখানে সবাই পরম সুখে আছে। এটা ঠিক তখন সবার ছোট বড় একটা থাকার জায়গা ছিল, ছিল বিনা পয়সায় চিকিৎসা, শিক্ষা, ছিল চাকরীর নিশ্চয়তা। আর এসবই মানুষের নিরাপত্তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটা মানুষকে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দিত। একই সময় সহপাঠীদের যখন বিদেশী জিনিসের জন্য হাপিত্যেশ করতে দেখতাম তখন এটাকে মনে হত যৌবনের ধর্ম। কেননা দেশে থাকতে আমরা নিজেরাও বিদেশী জিনিসের জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকতাম। দোকানে যে জিনিস ছিল না তা নয়, তবে সেটা হয় আমাদের মাপে হত না, অথবা তেমন ফ্যাশনেবল ছিল না। তবে কখনোই মনে হয়নি যে ভেতর থেকে সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি এতটা রোগাক্রান্ত। সেই সময় এদেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম আমেরিকানদের চেয়েও বেশি মার্কিনপন্থী ছিল। কারণ আমেরিকা তাদের কাছে ছিল জিন্স, রক – এসব। আমেরিকা ছিল নিজের মত প্রকাশের গ্যারান্টি। অন্তত সিনেমায় তারা সেটাই দেখতে পেত। সেদেশের সাধারণ মানুষের কাহিনী এদের জানা ছিল না। তখন ইন্টারনেট ছিল না, তাই কালো আমেরিকার প্রতি সাদাদের শোষণ অনেকেই সরকারি প্রোপ্যাগান্ডা বলেই মনে করত। ফলে দেশে থাকতে আমরা যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক রঙিন ছবি আঁকতাম, এখানকার মানুষও তাই। হয়তো এ কারণেই এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে ভোট দিয়েও ১৯৯১ সালের আগস্টে যখন অভ্যুত্থান হল মানুষ ইয়েলৎসিনের জন্য রাস্তায় নামলো, গরবাচভ বা সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য নয়। সে বছর ডিসেম্বরে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হল ইয়েলৎসিন, ক্রাভচুক আর শুচকিয়েভিচের কলমের খোঁচায় কোন মানুষ রাস্তায় নামলো না, যদিও তখন এখানে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরবর্তী অবস্থা ছিল না, চাইলে মানুষ নামতেই পারত। যারা ১৯১৭ সালে বিপ্লব করেছিলেন, যারা প্রচণ্ড ত্যাগের মধ্য দিয়ে পশ্চাৎপদ রাশিয়াকে শিল্পোন্নত করেছিলেন, যারা জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের মরণ থাবা থেকে দেশকে বিজয়ের স্বাদ পাইয়েছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরিরা দেখল কীভাবে একটি দেশ, একটি সভ্যতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তাই আজ যে এ দেশে অক্টোবর বিপ্লব পালন করা হয় না তার বীজ অনেক গভীরে। আসলে কোন উৎসব যদি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসবে পরিণত না হয় তাকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। নিজের বাসায় বা বন্ধুদের দেখি তারা ২২ জুন স্মরণ করে। সেদিন ভোর চারটায় হিটলারের জার্মানি  সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেছিল। এদিন তারা স্মরণ করে যুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। একইভাবে মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পালন করে ৯ মের বিজয় দিবস। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের কাউকে হেয় করার জন্য অন্যেরা তার দুর্নাম করে। এর ফলে শুধু যে সে হেয় হয় তাই নয়, পরিবার, পারিবারিক মূল্যবোধ হেয় হয়। একই ঘটনা ঘটে দেশে বা রাজনীতিতে। সন্দেহ নেই যে স্ট্যালিনের অনেক দোষ যেমন ছিল, তবে তার গুনেরও তেমনি অভাব ছিল না। রাশিয়ার আধুনিকায়নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রশ্ন হল কি পদ্ধতিতে? ইউরোপ, আমেরিকা সেটা করেছে আদিবাসী বা উপনিবেশের কোটি প্রাণের বিনিময়ে। স্ট্যালিন সেখানে নিজ দেশের মানুষের প্রাণ নিয়েছেন। তবে লক্ষ্য করার বিষয় খ্রুশেভ সহ যেসব পার্টি নেতারা স্ট্যালিনকে সে কাজে সহযোগিতা করেছেন পরে তাঁরাই তাঁর সমালোচনা করেছেন নিজেরা কোন দায়িত্ব না নিয়ে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অতিরঞ্জিত। আমার ধারণা যখন সেই সময়ের সমস্ত ডকুমেন্ট ওপেন করা হবে আর স্ট্যালিন ভীতি বা স্ট্যালিন ভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে কেউ সেই সময়ের নিরপেক্ষ সমালোচনা করতে পারবে তখনই আমরা স্ট্যালিন সম্পর্কে অবজেক্টিভ তথ্য পাব। তবে এসবের মধ্য দিয়ে দেশে যে ভাঙ্গনের বীজ, যে অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করা হয়েছিল সেটাই পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত পরবর্তী প্রায় তেত্রিশ বছর রাশিয়ায় থেকে, এখানকার মানুষদের সাথে মিলেমিশে, কথা বলে দেখেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে নস্টালজিয়া থাকলেও সেটা আমাদের মত নয়। কারণ তারা শুধু বাইরে থেকে বা ওপরে ওপরে সেটা দেখেনি, এখানে বাস করেছে, এখানকার ভালোমন্দ সব ভেতর থেকে দেখেছে। আমরা ছাত্ররা ছিলাম নেবার দলে, তারা শুধু নিতই না, তাদের দিতেও হত। তাদের নিজ কর্মের দায়িত্ব নিতে হত। তাছাড়া আমাদের সব দেশেও তো অক্টোবর বিপ্লব দিবস সার্বজনীন কিছু নয়, শুধু মাত্র যারা বাম ঘরানার রাজনীতি করে তাদের কাছে এটা উৎসব। আমি এটা লিখছি এ কারণে যে নতুন রাশিয়ায় এই দিনটি পালন না করায় বা এর পরিবর্তে ০৪ নভেম্বর জাতীয় সংহতি দিবস পালন করায় বাইরে থাকা অনেকেই সেটাকে ঠিক মেনে নিতে পারে না, ভাবে এটা আসলে অক্টোবর বিপ্লব দিবসের গুরুত্ব ম্লান করার এক অপচেষ্টা। আমরা ভুলে যাই, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও সেদেশের সবাই বামপন্থী ছিল না, সবাই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিকে আর ভাঙ্গনের পরে পার্টির নেতাদের যে রূপ সাধারণ মানুষ দেখেছে সেটাও কোন মতেই সাধারণ মানুষের সামনে সমাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি অটুট রাখতে সহায়ক হয়নি। কোন আদর্শ, কোন দলীয় উৎসব যখন জোর করে সবার উপর চাপিয়ে দেয়া হয় তখন সেটার এক সময়ে নাই হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। রাশিয়ায় ঠিক সেটাই ঘটেছে। তার মানে এই নয় যে এখানে কেউ এই দিবসটি পালন করে না। করে। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি অন্যান্য অনেক দলীয় অনুষ্ঠানের মত অক্টোবর বিপ্লব দিবস পালন করে। হয়তো এখানে আর আগের মত করে কখনই অক্টোবর বিপ্লব দিবস পালন করা হবে না, তার মানে এই নয় সেটা তারা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলছে। একটা সময় ছিল, যখন সেই চেষ্টা করা হয়েছে। ঠিক যেমন পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার নাম উচ্চারণ করা হত না। তবে এখন সময় বদলে গেছে। উৎসবের মত করে পালন না করলেও রেডিও, টিভিতে অক্টোবর বিপ্লবের কথা বলা হয়। নব্বুইয়ের দশকের উল্টো রথের পরে রাশিয়া আবার একটু একটু করে তার সোভিয়েত ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনছে। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায়, যখন এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা আবার জেগে উঠছে, যখন পিটার হাসদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ নব্য উপনিবেশবাদের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য দেশে দেশে গড়ে উঠছে জাতীয় ঐক্য, তখন অক্টোবর বিপ্লব আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে বলেই আশা করা যায়।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা(১২১): ধর্ম ও উৎসব - বিজন সাহা

কোন জিনিস বা ঘটনার ব্যাখ্যা নির্ভর করে কোথা থেকে দেখা তার উপর। যারা ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত তাদের এক ব্যাখ্যা, যারা দূর থেকে দেখে তাদের আরেক ব্যাখ্যা। আবার কোন ঘটনার ব্যাখ্যায় সময়ও একটা বড় ফ্যাক্টর। এখন যখন পূজা বা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান দেখি তখন সেটাকে যতটা না ধর্মীয় তার চেয়ে বেশি সামাজিক শো ডাউন বলে মনে হয়। যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয় ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, বিনয়ী হওয়া, এখন আমরা সবাই নিজেদের পোশাক পরিচ্ছদের জৌলুস দেখাতে ব্যস্ত। একই ঘটনা মনে হয় ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে। সেসময় এটা আর মানব মুক্তির শপথের দিন ছিল না, ছিল পুঁজিবাদী বিশ্বকে নিজেদের শক্তি দেখানোর সুযোগ। এটা আসলে সময়ের ডাক। স্বাধীনতার পর পর বিজয় দিবসের যে আবেদন ছিল, এখন কি তা আছে? যদিও এখন অনেক আড়ম্বর করে বিজয় মেলা হয়, তারপরের সেটা অধিকাংশ মানুষের কাছে শুধু মাত্র মেলাই, ত্রিশ লক্ষ শহীদের বীর গাঁথা আর দুই লক্ষ মা বোনের বেদনার কথা নয়। কারণ এক দিনের বা এক মাসের উৎসব দিয়ে এটা হয় না। সেজন্যে দরকার প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা, কেন আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সেই গল্প শোনানো। একই কথা বলা যায় সেই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে অক্টোবর বিপ্লবের ব্যাপারেও। আসলে ফুলদানি যতই সুন্দর হোক তাতে যদি উপযুক্ত ফুল না থাকে সেটা এক সময় বিরক্তির জন্ম দেয়। তাই কী অক্টোবর বিপ্লব দিবস, কী স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস – তা যত জাঁকজমক করে পালন করা হোক না কেন, যদি এসবের আদর্শিক ভিত্তি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া না যায় একদিন তা মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিকতা হারাবেই।

সবাইকে মহান অক্টোবর বিপ্লবের শুভেচ্ছা!

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো