বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১৬): ভিসা কাহিনী

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

গত কয়েক দিন ধরে ভিসা নিয়ে দেশে মেলা ঝামেলা চলছে। আর ভিসা নিয়ে এত কথা থেকেই বোঝা যায় আমরা আমেরিকার উপর কতটা নির্ভরশীল। অথচ এমনটা হবার তো কথা ছিল না। ধরুন আপনার এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী লোক যদি আপনাকে তার বাড়িতে প্রবেশ না করতে দেয় তাহলে আপনার খারাপ লাগবে, হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন, কিন্তু আপনার প্রতিবেশী, যার সাথে আপনার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই লতায় পাতায় জড়িয়ে আছে সে হঠাৎ এরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করলে আপনার বিপদ বেশি বই কম হবে না। অর্থাৎ ভারত যদি এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারির কথা বলে তাহলে যে পরিমাণ অসুবিধা আমাদের হবে বা হতে পারে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা সে তুলনায় তেমন কিছু না। অন্তত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায়। আমি বুঝি, পৃথিবী আজ ছোট হয়ে আসছে, আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য প্রচণ্ড ভাবে আমেরিকার (পশ্চিমা বিশ্বের) উপর নির্ভরশীল, তারপরেও এ নিয়ে যে ধরণের রাজনৈতিক খেলা হচ্ছে তাতে মনে হয় আমেরিকা আর হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে নয়, সে এখন আমাদের ঘরে বিছানার উপর পা তুলে বসে আছে। এবং আইনগত ভাবে আমরা বাড়ির মালিক হলেও সেটা আসলে আমেরিকার দখলে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম, সেটা আমরা নিজেরাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছি নিজেদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ফলে।

অবাধ্যতা কি সবসময়ই খারাপ? মনে হয় না। অনেক সময় অবাধ্যতাই মানুষকে সাফল্যের মুখ দেখায়। খবরে প্রকাশ ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করে দেবতাদের মানুষের কাছে মাথা নত করতে বলেন। কিন্তু দেবতাদের প্রধান সেই আদেশ মানতে অস্বীকার করেন কারণ আগের হুকুম অনুযায়ী ঈশ্বর ছাড়া আর কারো কাছে তাঁর নত হওয়ার কথা ছিল না। তাই ঈশ্বরের এক আদেশ মানতে গিয়ে তিনি অন্য আদেশ অমান্য করেন। শাস্তি স্বরূপ তিনি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন। দেবরাজ হয়তো তার অধিকার রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এটা ছিল তার অধিকারের জন্য লড়াই। অকারণে বশ্যতা মেনে নেয়া মানে অধিকার হারানো। অসমর্থিত সূত্র থেকে এটাও জানা গেছে যে ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করে আপেল খাবার ফলে মানুষ পৃথিবীতে নির্বাসিত হয়েছিল। আজকে এই যে আমি লিখছি, আপনি পড়ছেন অথবা ফেসবুক বা অন্য কোন সামাজিক মাধ্যমে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের সাথে কথা বলছেন, পৃথিবীর আলো বাতাস নিচ্ছেন অথবা আসন্ন ক্রিকেট বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল নির্বাচন কতটা সঠিক ও নিরপেক্ষ হয়েছে সেটা নিয়ে পৃথিবী উল্টিয়ে দিচ্ছেন এ সবই কিন্তু পারছেন পূর্বপুরুষের সেই অবাধ্যতার রেশ ধরেই। আবার আমরা যদি জিন্নাহর কথা মেনে নিতাম তাহলে উর্দুই হত আমাদের রাষ্ট্রভাষা, আমরা এখনও পাকিস্তানেই বাস করতাম, সাকিব তামিম নিয়ে কথা বলতাম না, কেননা পাকিস্তান দলে এদের সুযোগ পাবার সম্ভাবনা ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। আমাদের অবাধ্যতা, জিন্নাহকে অমান্য করার সাহস আমাদেরকে দেশ দিয়েছে, দিয়েছে ভাষা। আর এজন্যই অবাধ্যতার সবসময় খারাপ নয়।

ফিরে আসি ভিসার কথায়। ভাবার কোন কারণ নেই যে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে খুব চিন্তিত। তাদের চিন্তা এদেশে তাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কিনা বা এদেশ তাদের স্বার্থে কাজ করছে কিনা সেটা নিয়ে। আর এটা তারা ঘোষণা দিয়েই করে, করছে। মনে নেই সেই বিখ্যাত উক্তি “আমাদের কোন বন্ধু নেই, আমাদের আছে শুধু নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ।” তাহলে তারা কেন আমাদের দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে ভাববে? তারা তাদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নামক মারনাস্ত্রে একে অন্যের বিরুদ্ধে আমাদের কীভাবে ব্যবহার করবে সেটাই তাদের ভাবনার মূলে। তাই আমাদের দেশের মানুষের গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা রক্ষায় বা বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের হস্তক্ষেপকে যারা আশীর্বাদ বলে মনে করেন তাদের সে ধারণা আসলে ভুল। ভিসা দেওয়া না দেওয়া এটা তাদের ব্যাপার, এটার সাথে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, সাধারণ মানুষের স্বার্থ সম্পৃক্ত নয়। মানে আমাদের দেশের মানুষের স্বার্থে তারা এটা করে না, করছে না, করছে নিজেদের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে তারা জিম্মি করছে। এটার সাথে একটা জিনিস সম্পৃক্ত – তা হল আমাদের দেশকে তারা কতটুকু কব্জায় রাখতে পারবে বা পারবে না অর্থাৎ আমরা আমাদের দেশের স্বার্থ কতটুকু তাদের কাছে বর্গা দেব বা আদৌ দেব কিনা কিনা সেটাই তাদের একমাত্র বিবেচ্য। আজকে আমাদের দেশে যারা ভিসা প্রসঙ্গে শোরগোল তুলছে আসলে তারাও মানুষের কথা ভেবে করছে না, করছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে। এটা ক্ষমতার লড়াই – এটা গণতন্ত্রের লড়াই নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লড়াই নয়। কারণ মানুষের জন্য লড়াই করলে তারা মানুষের রাজনীতি করত অর্থাৎ বাংলাদেশ বা বিশ্বের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন কিভাবে বদলানো যায় সেই কথা বলত বা সেই লক্ষ্যে কাজ করত। আর সে প্রেসক্রিপশন আমরা জানি। সেটা পুঁজিবাদের পথ নয়, তার জন্য অন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মতাদর্শ ও পথ দরকার। কিন্তু যারা এই নিয়ে হৈচৈ করছেন তারা সেই রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তারা বিশ্বাস করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উপার্জিত টাকা গোনার, এই টাকা বিদেশে পাচার করার, সাধারণ মানুষকে শোষণ করার রাজনীতিতে। সুতরাং এটা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের ইস্যু নয়, গণতন্ত্রের অপব্যবহার। আমেরিকা যখন ভিসার উপরে শর্ত আরোপ করে তখন কিন্তু এটা দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়ে যায়। যদিও আমরা ভাবি এর ফলে তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে, বাস্তবে তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। যে কোন দেশপ্রেমিক মানুষের ও দলের উচিত এর প্রতিবাদ করা। এটা ঠিক আমাদের অনেক সমস্যা আছে কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে যদি বাইরের হস্তক্ষেপ কামনা করি সেটা হবে স্বাধীনতা বিরোধী, একাত্তরের চেতনা বিরোধী। মনে রাখা দরকার মীর জাফর ও অন্যেরা সিরাজের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েই ইংরেজদের সাথে হাত মেলায়। পরিণাম সবার জানা।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১৫):পরিবর্তন -বিজন সাহা

আমাদের দেশে বিভীষণ বা মীরজাফরের অভাব ছিল না কখনোই, তবে বিভীষণ আর মীরজাফর একই ক্যাটাগরিতে পড়ে না। কারণ বিভীষণ বিরোধিতা করলেও শত্রুপক্ষে গিয়েই করেছিল, মীরজাফর বন্ধুর বেশে থেকে শত্রুতা করেছে। শুধু আমাদের দেশে কেন এর আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইউরোপিয়ানরা ঘুষ দিয়ে বা অন্যান্য ভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের প্রথমে বশ আর পরে হত্যা পর্যন্ত করেছে। তারা এখনও সেটা করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে – হয় সরাসরি ঘুষ না হয় ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে। বিভিন্ন দেশে অনেক কিছুর মত ক্ষমতাও তারা পণ্যের মতই বিক্রি করে। তাই তারা যখন দুর্নীতির কথা বলে সেটা হাস্যকর মনে হয়। এটা ঠিক যে নিজেদের দেশে তারা দুর্নীতি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে, তবে বাইরে তারা এটাকে মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে। বর্তমানে হাওয়া বদলে গেছে। এমনকি তারা এখন নিজেদের জনগণের স্বার্থ ক্ষুন্ন করে অন্য দেশের যুদ্ধের জ্বালানি সরবরাহ করে। যদিও সেটা করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদির নামে কিন্তু আদতে সেখানে তারা অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে। আজ ইউরোপ আমেরিকায় রাজনীতির বর্তমান হালের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া। এমনকি সেখানকার বিভিন্ন আন্দোলন তা যে নামেই অথবা যে তন্ত্র বা মানবতার নামেই হোক না কেন সেগুলো কোনো না কোনোভাবে বড় বড় কোম্পানির সাহায্যে চলে এবং সে সমস্ত কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন একসময় বিভিন্ন দেশে বাম আন্দোলনে সাহায্য করলেও অধিকাংশ দেশেই এ সমস্ত আন্দোলন গড়ে উঠেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে সমস্ত দেশের মানুষের হাতে। আর এসব আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল স্থানীয় জনগণের অবস্থার উন্নয়ন। পুঁজিবাদী বিশ্বও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলে। এসবের মধ্যে এনজিও সাধারণ মানুষকে সাহায্যের পাশাপাশি সেসব দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে সরকারকে নিজেদের বলয়ে রাখতে। এছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়াকে মোকাবিলার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব গড়ে তোলে আল কায়েদা, তালিবান, ইসলামিক স্টেট ইত্যাদি উগ্রবাদী সংগঠন। আরও আছে পরিবেশ, নারী অধিকার, আফ্রো আমেরিকানদের অধিকার আদায়, এলজিবিটি ইত্যাদি সংগঠন যেসব দিয়ে দেশে বিদেশে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করে পশ্চিমা বিশ্ব। এসব সংগঠনের বেশির ভাগই নেপথ্য থেকে বৃহৎ পুঁজির দ্বারা পরিচালিত। স্বদিচ্ছা থেকে প্রচুর লোকজন এসব সংগঠনে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা সবাই বৃহৎ পুঁজির স্বার্থই সংরক্ষণ করে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, সেটা আসলে এসব দেশকে নব্য উপনিবেশবাদের কাঁটাতারে আটকে রাখার জন্যই।

আবার এটাও ঠিক যে এই নিষেধাজ্ঞার কারণেই আজ ইরান, উত্তর কোরিয়া নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এই স্যাঙ্কশনের কারণেই রাশিয়া আবার নিজেকে শিল্পে বানিজ্যে সামনে নিয়ে আসছে। কেননা নিষেধাজ্ঞা আপনার গতানুগতিক জীবনে শুধু অসুবিধার সৃষ্টিই করে না, বিকল্প পথ খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই ইরানকে বাধ্য করেছে নিজের শক্তিতে সব কিছু করতে। চারিদিক থেকে শত্রু ভাবাপন্ন আরব দেশ দ্বারা অবরুদ্ধ থাকার কারণে ইসরাইল প্রথম থেকেই নিজের আভ্যন্তরীণ শিল্প গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়। ষাট বছরের বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বাস করে কিউবা শুধু টিকেই নেই, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্ব সেরা। আমি বলছি না যে এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য ভালো কিছু। কিন্তু সেটাকে আমরা অভিশাপ হিসেবে দেখব নাকি নতুন সুযোগ হিসেবে দেখব সেটাই আসল কথা। এ থেকে আমাদের একটা শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন – উন্নত বিশ্ব আমাদের আমাদের বন্ধু নয়, আমাদের প্রভু, অন্তত সেভাবেই তারা আমাদের দেখে। তাদের সমস্ত কাজকর্ম, তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ বার বার এটাই বলে দেয় যে তাদের চোখে এই পৃথিবীতে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী। আমরা যদি আসন্ন নিষেধাজ্ঞার ভয়ে তাদের আজ্ঞাবাহী না হয়ে মেরুদণ্ড সোজা করা দাড়াই, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছোটখাটো অসুবিধাগুলো মেনে নিয়ে বিকল্প পথের সন্ধান করি দেখবেন এ থেকে আমরা বিজয়ী হয়েই বেরিয়ে আসব। একাত্তরে সপ্তম নৌবহর দিয়ে পারেনি, ২০২৩ এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েও পারবে না যদি আমরা আবার একাত্তরের মতই গর্জে উঠি, সেভাবেই ত্যাগ স্বীকার করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বুক উঁচু করে দাড়াই।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো