বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১১) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমরা

-বিজন সাহা

গত কয়েক পর্বে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে কথা বলেছি, দেখানোর চেষ্টা করেছি যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যতটা না ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ কোন দেশ, তার চেয়ে বেশি একটা আইডিয়া, একটা ধারণা। ফলে সারা বিশ্ব জুড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে যে আবেগ সেটা আর কোন হারিয়ে যাওয়া দেশ বা সাম্রাজ্যকে নিয়ে নেই। তার চেয়েও বড় কথা এই আবেগ শুধু যারা এই ভোউগলিক সীমানায় বাস করেছে তাদের মধ্যেই সীমাবন্ধ নয়, সেটা সারা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মনে এখনও জীবিত। আর এদের সবাই যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক ছিল তা নয়, এমনকি যারা এর বিরোধিতা করত তাদের অনেকেই এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের মত একটা দেশের উপস্থিতির অভাব অনুভব করে। কারণ সব কিছুর পরেও সেই দেশ বিশ্ব রাজনীতিতে একটা ভারসাম্য তৈরি করেছিল, তৈরি করতে পেরেছিল। তার অনুপস্থিতিতে বিশ্ব এখন এক লাগামহীন ঘোড়ায় পরিণত হয়েছে। এমনকি জারের রাশিয়াও এক সময় আশেপাশের বিভিন্ন দেশের ত্রাণকর্তার ভুমিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখব অটোমান, পারস্য ও অন্যান্য সাম্রাজ্যের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন দেশ রুশ জারের আছে আবেদন জানিয়েছে। এভাবেই আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, জর্জিয়া, এমনকি ইউক্রেন এক সময় রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সমস্ত ইউরোপ জার্মানির বশ্যতা স্বীকার করে একযোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর চড়াও হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তখন কে না যুদ্ধ করেছে বিভিন্ন দেশে কিছু কিছু কমিউনিস্ট ছাড়া? এর পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের সেনাদের জীবনের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে সমস্ত পূর্ব ইউরোপকে মুক্ত করেছে। আর যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছে। সে সময় এমন দেশ খুঁজে পাওয়া কষ্ট যারা নিজেদের মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পাশে পায়নি। আর বর্তমানে? একটু খেয়াল করলে দেখবেন আজ রাশিয়া নিজে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় অনেক দুর্বল, তারপরেও সারা বিশ্বের উপর পশ্চিমা বিশ্বের চাপিয়ে দেয়া নিও লিবারেলিজমের ভূতের হাত থেকে নিজদের ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ ও জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করার যুদ্ধে নেমেছে সে। অবশ্যই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ, তারপরেও যেকোনো যুক্তি বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের উচিৎ এই প্রশ্নটা করা – কেন এমন হল, কেন রাশিয়া এই পদক্ষেপ নিল। এ কথাগুলো বলছি এ কারণেই যে এই যুদ্ধের ফলে আমরা যারা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি, যারা এক সময় রুশপন্থী রাজনীতি করেছি বা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলাম, কিছুদিন আগেও নিজেদের বন্ধু মনে করতাম, আজ তারা দ্বিধাবিভক্ত। তাই আজ সে সম্পর্কে কিছু বলব।

সোভিয়েত ইউনিয়ন হারিয়ে গেছে ৩২ বছর আগে, তবে সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আজও বাস করছে লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে আবার আমরা এক হবার সুযোগ পেয়েছিলাম, বিশেষ করে করোনাকালীন গৃহবন্দিত্ব আমাদের আবার কাছে নিয়ে এসেছিল, সেই মুহূর্তে আবার এই বিভক্তি। কেন?

অনেকেই এই যুক্তি দেন যে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি, রাশিয়ায় নয়। তাহলে আমরা কেন আজ রাশিয়ায় পক্ষে কথা বলব? প্রশ্নটা রাশিয়ার পক্ষে বলা বা না বলার নয়, প্রশ্নটা রাশিয়ার ভাষ্য শোনার, ঢালাও ভাবে এদের ঘাড়ে সব দোষ না চাপানোর। কারণ এক হাতে তালি বাজে না। আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করেছি, রাশিয়ায় নয়। কিন্তু আমরা সবাই জানি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সর্বসম্মতিক্রমে বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থায় রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থান দখল করেছে। শুধু তাই নয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত ঋণ রাশিয়া নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ল্যান্ডলিজের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা থেকে যে ঋণ গ্রহণ করেছিল, যে অর্থ সোভিয়েত ইউনিয়নের সবগুলো প্রজাতন্ত্রের জন্যই খরচ করা হয়েছিল, সেটা রাশিয়া এই শতকে পরিশোধ করেছে। তাই সব দিক থেকে রাশিয়াই যে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী সে নিয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কয়েক বছর আগেও একাধিক বার রাশিয়া সোভিয়েত আলুম্নিদের একসাথে করার চেষ্টা করেছে, একাধিক কংগ্রেস হয়েছে, শুধু রাশিয়া নয়, অন্যান্য প্রজাতন্ত্রে যারা পড়াশুনা করেছেন তারাও এসব সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তখন কিন্তু কেউ বলেননি যে রাশিয়া তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। তবে এখানেই শেষ নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু ভূখণ্ড নয়, সেটা আইডোলোজি, সেটা এক বিশেষ ধরণের জীবনযাত্রা যার কথা আমরা সবাই বলি, অনেকেই সেই সময়ের জন্য, সেই জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আসলে আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলি, তারা যতটা না সে দেশের ভৌগলিক সীমানার কথা বলি, তারচেয়ে বেশি বলি সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা, সেই সমাজের, সেই শিক্ষার কথা। আর এসব মনে করেই আমরা নস্টালজিক হই। তার মানে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে বাল্টিকের দেশগুলোয় আর ২০০৪ সালে অরেঞ্জ বিপ্লবের পর ইউক্রেনে যখন যা কিছু সোভিয়েত সেটা ধ্বংস করা শুরু হল তখন কিন্তু কেউ মুখ খুলেনি। অর্থাৎ এই সোভিয়েত প্রেমীরা তখন সোভিয়েত লিগেসি রক্ষার জন্য টু শব্দ করেননি। বিভিন্ন দেশে সোভিয়েত আলুম্নাইদের সংগঠন আছে, তারা প্রায়ই একত্রিত হন, নিজদের সমস্যায় রুশ দূতাবাসের শরণাপন্ন হন, রুশ দেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস সেসব দূতাবাসে বা রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে মহাসমারোহে পালন করেন, তখন কিন্তু ইউক্রেনযুদ্ধের কারণে খাদ্য বা পানীয় গলাধঃকরণ করতে তাদের এতটুকু অসুবিধা হয় না। কিন্তু যখনই কেউ এসব গ্রুপে যুদ্ধের রুশ ভার্সন নিয়ে দু’ কথা বলতে যায়, তখনই এরা রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন নয় বলে ঢাল তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই যে আমাদের দ্বিচারিতা সেটাই মনে হয় আমাদের স্বপন ভঙ্গের প্রধান কারণ।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১০):সাম্য-বিজন সাহা

সোভিয়েত আমলে সারা বিশ্বেই ছিল প্রচন্ড রকম সোভিয়েত বিরোধী প্রোপাগান্ডা। তাদের চোখে এ দেশ ছিল নরকসম। অন্যদিকে বিশেষ করে বাম দলগুলোর প্রোপাগান্ডায় এটা ছিল স্বর্গের মত। তবে ১৯৮৩ সালে এখানে এসে দেখি কোনটাই ঠিক নয়। এখানে আমাদের মতই সাধারণ মানুষ বসবাস করে নিজেদের সমস্যা নিয়ে, সুখ দুঃখ নিয়ে। তবে গত ৪০ বছরে এ দেশে বসবাস করে যেটুকু বুঝেছি তা হল একটু হলেও অন্যরকম এদের চিন্তাভাবনা, অন্যরকম জীবন দর্শন।

কি সেই আমলে কি এখন, যখন এখানে বিদেশি ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে তাদেরকে দেশপ্রেম শেখানো হয়, তাদের নিজ নিজ দেশকে ভালবাসতে শেখানো হয়। আমরা নিজেরাই তার সাক্ষী। শুধু বাংলাদেশ থেকে এখানে যারা পড়াশুনা করেছে তাদের সিংহভাগ আজ বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচণ্ড সুনামের সাথে কাজ করেছে। এরা অনায়াসে এদেশেও কাজ করতে পারতেন, কিন্তু আমাদের কখনই দেশে না ফিরে এ দেশের উন্নয়নে কাজ করতে উৎসাহী করা হয়নি। একই কথা বলা যায় এখন যারা রাশিয়ায় পড়াশুনা করছে তাদের ক্ষেত্রেও। সঠিক বলতে পারব না তবে মনে হয় ইউরোপা আমেরিকায়  সেটা এভাবে করা হয় না, তাদের শেখানো হয় ইউরোপ, আমেরিকাকে ভালোবাসার কথা। অন্তত আমার সেটাই মনে হয়।

৯০ দশকে রাশিয়া প্রচন্ড দ্রুত গতিতে চেষ্টা করেছিল সোভিয়েত উত্তরাধিকারকে ভুলে যেতে। গাইদার, চুবাইস – এদের ভাষায় তারা সোভিয়েত অর্থনীতিকে এমন ভাবে ধ্বংস করেছেন যেন সেই দেশ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, যাতে সোভিয়েত ব্যবস্থা আর ফিরে না আসে। বিগত ১৫-১৬ বছর হয় এরা অন্যদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। অনেক কিছুই এখন ফিরে আসছে। এখন সোভিয়েত উত্তরাধিকার এরা আর অস্বীকার করে না। সরকারি ভাবেই স্বীকার করে যে জারের রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমান রাশিয়ার ইতিহাস, দেশের মানুষের ভাগ্য একই সুতায় বাঁধা। কয়েকদিন আগে এক অধ্যাপক, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বর্তমান সরকার বিরোধী, ফেডারেল টিভি চ্যানেলের এক টক শোতে বললেন যে গত দেড় বছর রাশিয়া আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মাইনাস কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ

উনি বলতে চাইলেন যে এখানে অলরেডি সোভিয়েত শাসন চলছে, তবে সেটা কমিউনিস্ট পার্টি না করে অন্যরা করছে। আমি অবশ্য সেটা মনে করি না কারণ ইতিমধ্যেই মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে। আগে যদি বেশিরভাগ লোকজন সরকারের উপরে নির্ভর করতে চাইতো বা নির্ভরশীল ছিল এখন ৪০% এর বেশি লোকজন মনে করে যে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক তারা নিজেরাই। এটা একটা বিরাট মানসিক পরিবর্তন। তবে এখানে অনেক কিছুই ফিরে আসছে। তাই মনে হয় যে ঢালাওভাবে রাশিয়াকে দোষ দেওয়ার আগে আমরা অন্তত যারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভালবাসি বা ভালবাসতাম তাদের রাশিয়ার বর্তমান পরিবর্তন নতুন করে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। অন্ধভাবে গ্রহণের প্রশ্ন আসে না তবে শুধুমাত্র পশ্চিমা  আয়নায় না দেখে অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ পাওয়ার চেষ্টা করা দরকার।

আর সবচেয়ে বড় কথা অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবেও শক্তিশালী হচ্ছে। তারা সেই সোভিয়েত ব্যবস্থায় ফিরে যেতে না চাইলেও ওই ধরনের একটা রাষ্ট্র চায় যেখানে রাষ্ট্র হবে গণমুখী, জনমুখী, জনকল্যাণমূলক। দেখতে হবে এখনও এরা আগের মতই গরীব দেশগুলোকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সাহায্য করছে।  ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন গরীব দেশগুলোকে নিজ খরচে বিনামূল্যে শস্য ও সার পৌঁছে দেবার কথা ঘোষণা করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব বাধার সৃষ্টি না করলে সেটা যে তারা করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। হয়তো আগের মত নিঃস্বার্থভাবে নয়, নিজেদের স্বার্থ দেখে, তারপরেও চাইছে এই দেশগুলো যেন নিজের পায়ে দাঁড়ায়, যেন অন্যদের উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল না হয়। এই যে ব্রিক্স, সাংহাই চুক্তি – এখানে কিন্তু কেউই একক ভাবে প্রধাণ নয়। এরা চায় সব দেশ সমান অধিকার ভোগ করুক, সব দেশ নিজ নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক নিজেরাই হোক। কারণ একমাত্র তখনই মাল্টিপোলার বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠন যদি রাশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতির সার্বিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়, সেটা শুধু এদের নয়, নিজেদের পক্ষেও মঙ্গলজনক হবে। একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের দেশগুলোর উপনিবেশ বিরোধী মুক্তির সংগ্রামে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, আমাদের দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনে সার্বিক ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আজ এরা যখন নিওকলোনিয়ালিজমের বিরুদ্ধে, নিও লিবারেলিজমের বিরুদ্ধে আমাদের সকলের হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তখন সাহায্য না করতে পারলেও রাশিয়াকে বোঝা, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া তৃতীয় বিশ্বের প্রগতিশীল ও সাম্রজ্যবাদ বিরোধী  শক্তির কর্তব্য বলে মনে করি।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো