বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১১০):সাম্য

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ফটো)

আমরা হাঁটছি মস্কো নদীর ধার দিয়ে গল্প করতে করতে।

আচ্ছা সোভিয়েত ইউনিয়ন না হয় বুঝলাম কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনেক কিছু যদি নতুন ব্যবস্থায় থাকে তবে সাম্য আসবে কোত্থেকে?

সাম্য কি? এটা কি শুধুই সবাইকে কোন কিছু সমান ভাগ করে দেয়া? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেনিনগ্রাদ যখন অবরুদ্ধ ছিল তখন সবাইকে দিনে ১০০ গ্রাম করে রুটি দেওয়া হত। কই, আমরা তো বলি না যে সেখানে সাম্য ছিল। মহাবিশ্বের সব কিছুর মত সাম্যের ধারণাও আপেক্ষিক। এই যে আমি ভাত পছন্দ করি আবার কেউ গ্রেচকা বা রুটি। এখন সাম্যের কথা বলে সবাইকে যদি একই খাবার দেই সেটা কি অন্যদের প্রতি অবিচার হবে না? আমার ছাত্রজীবনের একটা গল্প বলি। আমার সাথে এক ছেলে পড়ত, মানে আমরা একই বছর মস্কো এসেছিলাম। ওর খুব শখ ছিল নিজের ফোর্ড ফোকাস গাড়ির। ও এখন আমেরিকায় থাকে, কয়েকটা বাড়ি, প্রিয় গাড়িও আছে। কয়েক বছর আগে একদিন ফোন করে বলল, “তুই আমাদের ব্যাচের ভালো ছাত্রদের একজন ছিলি। আমার তো আমেরিকায় বাড়ি গাড়ি আছে, কিন্তু তোর কি আছে?” আমি আর কি বলব। আমার তো সে রকম চাহিদাই ছিল না। একটাই চাহিদা ছিল স্বাধীন ভাবে কাজ করার, কাজ করে আনন্দ পাওয়ার। আমি কিন্তু সেটা পাচ্ছি। কিন্তু ওকে কখনই বোঝানো যাবে না যে বাড়িগাড়ি না করেও ভালো থাকা যায়, সুখে থাকা যায়। ওর মত ও সুখী, আমার মত আমি। আমার ধারণা যদি প্রিয় কাজ না করে বেশি বেতনের চাকরি করতাম তাহলে হয়তো অর্থনৈতিক ভাবে অনেক ভালো থাকতাম, কিন্তু মানসিক ভাবে? যদি কেউ প্রিয় কাজ থেকে অনেক অর্থ উপার্জন করে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু কারো কাছে কাজ মানে বেতনের অংক, কারো কাছে কাজ মানে কাজ – যা করে সে আনন্দ পায় আর বেতনটা তার কাছে বোনাসের মত মনে হয়। তাই বেতনে সমান না করে সবাইকে যদি যার যার প্রিয় কাজ করার সুযোগ দেয়া হয় আর কাজের উপযুক্ত বেতন দেয়া হয় যাতে সে ফ্যামিলি নিয়ে ভদ্র ভাবে জীবন যাপন করতে পারে সেটা হবে অনেক বেশি ন্যায়সঙ্গত।

কিন্তু যদি কেউ কাজ করতে না চায়? মানে কিছু না করে ভালো থাকতে চায়? অথবা এমন কাজ করতে ভালবাসে যা কারো কোন উপকারে আসে না?

দেখ, কাজ বলতে আমরা সেটাই বুঝি যা সমাজের জন্য কোন না কোন উপকার বয়ে আনে। যে কাজ করে সেও সমাজের অংশ। তার কাজ যদি সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় না হয় তাহলে সেটা তার নিজের জন্যও প্রয়োজনীয় হবে না। তাই প্রিয় কাজ মানে যা খুশি তাই নয়, যেসব কাজ সমাজের জন্য দরকারী সেসবের মধ্যে যেটা তার প্রিয় সেটা করার সুযোগ। কিন্তু শুধু চাইলেই হবে না। সেটা করার জন্য শিক্ষা লাভ করতে হবে, দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই যে আমি চাইলেই তো আর ডাক্তার হবে পারব না। তাই এসব কথা মাথায় রাখতে হবে। তাছাড়া সেদিন তো বললাম সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সবাইকে নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দিত। এটা কথার কথা নয়, এটা আমার নিজের চোখে দেখা, সেটা প্রমানিত সত্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোভিয়েত মানুষের সাফল্য তার প্রমান।

এসব তো পুঁজিবাদের মধ্যে থেকেই করা যায়।

না। আসলে যেকোনো কাজের কি ফলাফল হবে সেটা নির্ভর করে আমাদের লক্ষ্যের উপর। পুঁজিবাদ কখনই সব  মানুষের জন্য ভদ্রস্থ ও নিরুদ্বেগ জীবন তার এজেন্ডায় রাখেনি। এর মূলমন্ত্র হল মুনাফা আর সে জন্য দরকার অন্যদের শোষণ করা। শোষণ তখনই করা যায় যখন মানুষের অভাব থাকে, কারণ তখন সে কম মূল্যে নিজের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। যত বেশি শোষণ করবে, তত বেশি মুনাফা অর্জন করবে। দেখ সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন বিপ্লবের পর ভেঙেপড়া অর্থনীতি নিয়ে সব মানুষের জন্য ফ্রি শিক্ষা, চিকিৎসা এসব নিশ্চিত করেছে আমেরিকা অনেক ভালো অর্থনীতি নিয়েও সেটা করেনি। করতে পারত না তা নয়, করতে চায়নি। এমনকি আজ আমেরিকা যখন কী সামরিক, কী প্রযুক্তিগত, কী অর্থনীতি সব দিক থেকেই বিশ্বের এক নম্বর দেশ তখনও সেখানে প্রচুর মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, বঞ্চিত চিকিৎসার সুযোগ থেকে। করোনায় সে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। কেন? একটাই কারণ – কে কোন বিষয়টাকে প্রায়োরিটি দেয় তার উপর নির্ভর করে শেষ ফল। এই যে আজ ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে আর সেটা চলছে আমেরিকা চালিয়ে যাচ্ছে বলেই। আমেরিকা সব সময় জীবনের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। অথচ তার কারণেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। আর এ থেকে সে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে অস্ত্র বিক্রি করে, মৃত্যু বিক্রি করে। এমনকি যেসব দেশ, যাদের আমরা ওয়েলফেয়ার স্টেট বলি তাদের উপর চাপ দিচ্ছে যুদ্ধের পেছনে খরচ বাড়াতে। এতে লাভ? তাহলে এসব দেশ সামাজিক খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হবে। তখন আর আমেরিকাকে এতটা অমানবিক মনে হবে না। তাই পুঁজিবাদের মধ্যে সাম্য সম্ভব নয়, সাম্য আর পুঁজিবাদ আন্টিগনাস্টিক।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১১১) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমরা -বিজন সাহা

কিন্তু তাহলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যবহারের কথা যে বললে।

বললাম কারণ এখন পর্যন্ত উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই অর্থনীতিই সবচেয়ে সফল। এই দেখ, আমরা যদি নদীর ধারের এই রেলিঙের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে চাই তাহলে সোজা যেতে পারব না। আমাদের কখনও ডাইনে কখনও বামে ঝুঁকে ব্যাল্যান্স রক্ষা করতে হবে। কিন্তু ব্যাল্যান্স রক্ষা করতে গিয়ে আমরা যদি কোন দিকে খুব বেশি ঝুঁকে পড়ি তাহলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা বাড়বে। তার মানে দরকারে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করতে হবে কিন্তু দেখতে হবে সেটা যেন ডোমিনেটিং না হয়, তাহলে সোভিয়েত ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের মূল পার্থক্য উৎপাদিত সম্পদের বণ্টন নিয়ে। পুঁজিবাদে পুঁজির মালিক তার সিংহ ভাগ নিজে নিয়ে নেয়, সমাজতন্ত্র বলে সেটা শ্রমিকদের মধ্যে বন্টন করতে। পুঁজিপতি একাই বেশির ভাগ ভোগ করে আর খরচ করে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে কিন্তু খুব কম অংশই বেতন হিসেবে দেয় শ্রমিকদের। কেন? ইচ্ছে করে শ্রমিকদের দায়বদ্ধ করে রাখা। কারণ সে জানে শ্রম ছাড়া পুঁজি অচল। যদিও নতুন বাস্তবতায়, যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেক্ট অনেক কিছুই করতে পারবে তখন হয়তো পুঁজিপতিরা শ্রমিকই রাখতে চাইবে না। সমাজতন্ত্রে শ্রমিকরা মুনাফার অপেক্ষাকৃত বেশি অংশ পায়, তবে যেহেতু উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত করতে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি ফলে সময়ের সাথে মুনাফা বাড়েনি, বাড়েনি জীবনের মান। তাই দেখা যায় উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়িয়ে পুঁজিবাদ তাদের শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে পারলেও সমাজতন্ত্র সেটা পারেনি। এর অর্থ সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। সেটা শোধরানোর জন্যই দরকার পুঁজিবাদ থেকে কিছু কিছু বিষয়ে শিক্ষা নেয়া।

কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রও সমান অধিকারের কথা বলে। তাহলে?

সমান অধিকার আর সাম্য এক নয়। কেন? এটা এদের মার্কেট ভ্যালু ভিন্ন বলে। মানে সমান অধিকারের দাওয়াই সবাইকে গেলানো যায়, সাম্যের দাওয়াই গেলানো যায় না। প্রায় সব ধর্মীয় গ্রন্থেই অসাম্যের কথা লেখা আছে, বিশেষ করে নারী পুরুষে অসাম্য। কোথাও কোথাও আছে বর্ণ প্রথা। আর মানুষ এসব খুব বিশ্বাস করে। মানে মার্কেট ভ্যালু তো আমরা নিজেরাই তৈরি করি। তাহলে আমরা কেন সাম্যবাদের মার্কেট ভ্যালু বাড়াতে পারি না? কারণ সমান অধিকার এটা অনেকটা মৃত্যুর পরে স্বর্গ লাভের মত, অধিকারের কথা বলে আজীবন মানুষকে স্বপ্ন দেখানো যায়, শোষণ করা যায়। সাম্যবাদ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, সবাইকে তার সুফল দিতে হয়, আর সেটা দিতে হয় এই জীবনেই। অধিকাংশ মানুষ ভাবে যেখানে আমরা নেই সেখানেই সব সুখ, নিজের দুই বেলার ভাত কাপড়ের চেয়ে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে স্তরে স্তরে সাজানো পোলাও কোর্মা আর মিষ্টির ভান্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্সরাদের বেশি বাস্তব মনে করে। আর এখানেই হয়তোবা কমিউনিজমের সাম্যবাদ পুঁজিবাদের সমান অধিকারের কাছে হার মেনে যায়।

 তার মানে কি সাম্য আমাদের অধরাই থেকে যাবে?

আসলে সেটা করতে হলে আমাদের সাম্যের সংজ্ঞা বদলাতে হবে। সমতা বলতে আমরা সাধারণত মাথাপিছু সম্পদের সমান বা কমবেশি ন্যায্য বন্টন বুঝি, কিন্তু কখনোই কার মাথার ভেতরে কি আছে, মানে মানুষের মেধা  আমলে নেই না। মাথার সাথে সাথে যদি তার ভেতরের বস্তু, মানে মেধা, কর্মোদ্যম এসব মাথায় রেখে সম্পদের বন্টন করা হয় তাহলেই সেটা হবে সত্যিকারের সাম্য। কারণ তাহলেই সবার জন্য নূন্যতম চাহিদা নিশ্চিত করার পাশাপাশি উদ্যোগী, কর্মঠ ও মেধাবী মানুষের জন্য স্বপ্ন দেখার ও তা বাস্তবায়নের পথ খোলা থাকবে। পুঁজিবাদে উদ্যোগী মানুষ অনেক কিছু পেলেও সাধারণ মানুষ ন্যুনতম চাহিদা প্রায়ই মেটাতে পারে না, সমাজতন্ত্রে প্রায় সব মানুষের ন্যুনতম চাহিদা মেটানো হয়েছিল, কিন্তু উদ্যোগী ও মেধাবী মানুষ প্রায়ই তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পায়নি। দুটো দুই দিক থেকে এক্সট্রিম, আমাদের দরকার মাঝামাঝি পথ।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো