বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১০২)  দুনিয়া কাঁপানো একদিন: বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

 ইউক্রেনে স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন শুরু হবার পর থেকে রাশিয়ায় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এর উপর বিভিন্ন টকশো হয়। অনেক সময় সেটা বিরক্তিকর হলেও যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। বিশেষ করে যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সাংবাদিক বা সেনা, সেনাপতিরা সেখানকার অবস্থা বর্ণনা করে। তাই সে সব প্রোগ্রামের প্রতি দৃষ্টি রাখি। এছাড়া কিছু কিছু প্রোগ্রামে সত্যিকার অর্থেই ঠাণ্ডা মাথার বিশেষজ্ঞরা আসেন, যারা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন। যেহেতু সেখানে কমবেশি সব পক্ষের লোকজন থাকে তাই একটা অভারঅল পিকচার পাওয়া যায়। এছাড়া বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেল তো আছেই।

শুক্রবার রাতে রুশ টিভিতে সেরকম কোন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম থাকে না আন্তর্জাতিক রিভিউ ছাড়া। এটা মনে হয় যাতে ছুটির দিনগুলো মানুষ একটু নির্বিঘ্নে অবসর যাপন করতে পারে সেজন্য। শনিবার ও রবিবার দিনের বেলায় একই অবস্থা, মানে শুধুই বিভিন্ন ধরণের বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম আর রাতে বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রোগ্রাম। তাই শুক্রবার রাতে সাধারণত মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম বা ঐ ধরণের কিছু দেখি। এবার দেখলাম অসাধারণ মানুষ বলে একটা প্রোগ্রামের ফাইনাল। সেখানে বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন দেশের এগারোটা দল ছিল। বেশ উপভোগ করলাম বিভিন্ন জনের বিভিন্ন অসাধারণ কাজকর্ম। তবে যেটা হয়, দিনের খবর না দেখলে তেমন ভালো লাগে না। তাই এসবের পরে নিউজ চ্যানেল ঘোরালাম। আসলে আমার টিভি দেখা মানে সাথে অন্য কোন কাজ করা – সেটা বই পড়া হোক বা কোন ক্যালকুলেশন হোক। টিভি অনেকটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত কাজ করে। তাই সেখানে কি হয়েছিল বা কি বলেছিল সেটা বলতে পারব না। এটা এক সমস্যা।

এরকম ভাবে শুক্রবার রাতে ঠিক ঘুমুতে যাবার আগে টিভিতে জেনারেল সুরাভিকিনের ছবি ভেসে উঠল। আর এ কারণেই ওটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনি ভাগনার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন ব্যারাকে ফিরে যেতে। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারলাম সিরিয়াস কিছু ঘটেছে, তা না হলে এই সময় এমন আবেদন জানানোর কথা নয়। কিন্তু টিভি চ্যালেন সার্চ দিয়ে তেমন কিছুই পেলাম না। আমি কিছু ওয়ার করেসপনডেন্টদের টেলিগ্রাম চ্যানেল নিয়মিত দেখি ফ্রন্টের অবস্থা জানার জন্য। ওখানেও তেমন কিছু নেই। ও বিভিন্ন খবর পেয়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে অবস্থিত নিজের পরিচিত সেনাদের প্রশ্ন পাঠাচ্ছে আর ওদের উত্তরের স্ক্রিন শট দিচ্ছে। ভাষা দেখেই বোঝা যায় এটা ফ্রন্ট থেকে লেখা। এরা স্ল্যাং-এর জন্য বিখ্যাত। ওখানে বোঝা গেল ফ্রন্টে সব স্বাভাবিক। তাই সকালের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সকালে টিভি অন করতেই দেখলাম জনগণের প্রতি পুতিনের আহ্বান। কয়েক মিনিটের এই আহ্বানে তিনি রুশ দেশের ইতিহাস, ১৯১৭ সালের কথা, এই যুদ্ধে ভাগনারের সদস্যদের আর্মির সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করার কথা বলেছেন আর বলেছেন তাদের বর্তমান বিদ্রোহের কথা। শুধু  তাই নয়, তিনি এটাকে দেশদ্রোহ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন রাশিয়া বারবার কিভাবে আভ্যন্তরীণ অনৈক্যের কারণে বিশাল মূল্য দিয়েছে। তিনি একদিকে যেমন বিদ্রোহীদের ব্যারাকে ফিরে যাবার আহ্বান জানিয়েছেন অন্যদিকে তেমনি শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, একজন নাগরিক হিসেবে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে সমস্ত ধরণের ব্যবস্থা নেবার প্রতিজ্ঞা করেছেন। এই বক্তব্য এই  ঘটনা যে রাশিয়ার জন্য প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলে দেয়। এই বক্তব্যে অনেক কিছুর সাথে ভ্লাদিমির পুতিন ১৯১৭ সালের কথা উল্লেখ করেন। বলেন সে সময় আভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও কিছু মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায়। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি অক্টোবর বিপ্লবের কথা বলছেন। অবাক হয়েছিলাম। কেননা তাঁর বর্তমান রাজনীতি জারের রাশিয়া, সোভিয়েত আমল ও বর্তমান রাশিয়াকে এক সূত্রে গাথার রাজনীতি। পরে এক বন্ধু বলল ওটা আসলে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কথা আর তাতে দুটো ঘটনা – কেরেনস্কির কারণে যুদ্ধ হেরে যাওয়া আর সেই সময়ে পিতেরবুরগে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত জর্জ বিউকেনেনের সরাসরি হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে তিনি শুধু প্রিগঝিনের কথাই বললেন না, এতে বিদেশী হস্তক্ষেপের কথাও বললেন।

যাহোক, একটু পরে হাঁটা দিলাম সেলুনের দিকে। উদ্দেশ্য চুল কাটা আর শহরের অবস্থা দেখা। পথে ভিক্তরকে ফোন করলাম। ও ভোলগার তীরে ঘুরছিল। কথা শুনে মনে হল ও এসব এখনও জানে না। সেলুনে, পরে দোকানে – কোথাও কোন লোকের মাঝে কোন পরিবর্তন দেখলাম না। সব স্বাভাবিক। যেহেতু ইতিমধ্যে দেশ ও অন্যান্য জায়গা থেকে লোকজন খবর জানতে চাইছিল, বুঝলাম ঘটনা সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, অথচ এরা বরাবরের মতই নিজ নিজ কাজকর্মে ব্যস্ত। বাসায় ফিরে দেখি স্ত্রী মস্কোয় ছেলেমেয়েদের লিখছে বাইরে না যেতে, কাউকে ঘর না খুলতে আর ওরা এসব শুনে বিরক্তি প্রকাশ করছে। তাই লিখলাম, “ভয়ের কিছু নেই। কাজকর্ম থাকলে বাইরে যেয়ো, তবে চোখ কান খোলা রেখ।” এটা এ জন্যে বলা যে খুব কম ঘটনাই এদেশের জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। এদের মানসিকতা সম্পর্কে বলা হয় “বারীন মানে মহাজন এসে সব ঠিক করে  দেবে।” এরা এখনও অনেকটা সেভাবেই ভাবে “সরকার আছে। তারা ভালো জানে কি করতে হবে।” আসলে এরা বিশেষ করে এ ধরণের ঘটনার খবর প্রচারে একটা ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দেয় – মানুষকে ঘটনা জানানো তবে প্যানিক তৈরি না করা। এমনকি কোন দুর্ঘটনার সময়েও তারা প্রথমে চেষ্টা করে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, প্যানিক না ছড়াতে আর সমস্যার সমাধান করতে। তাই লোকজন নিশ্চিন্ত মনে দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিই। বছর খানেক আগে দুবনায় আমাদের ইনস্টিটিউটে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন। রাতের খবরে সেটা জানলাম। রাস্তাঘাটে বা অন্য কোথাও এ নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি ছিল না। আমার মত অনেক লোক হয়তো রাতের খবরে জানত পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দুবনা সফরের কথা।

ভাগনার – এটা ভাড়াটে সেনাদল। সিরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার স্বার্থে যুদ্ধ করেছে। তবে তারা রাশিয়ায় সংবাদের শিরোনামে আসে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যেহেতু নাম ভাগনার তাই এখানে তাদের বলা হয় মিউজিশিয়ান – বিখ্যাত জার্মান কম্পোসার রিচার্ড ভাগনারের অনুকরণে। এই দলের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগঝিন সোভিয়েত আমলে এমনকি জেল পর্যন্ত খেটেছিলেন। তাকে অনেক সময় পুতিনের প্রধান বাবুর্চি বলে ডাকা হায়। আসলে তিনি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের মালিক আর তাঁর রেস্টুরেন্ট থেকে ক্রেমলিনে খাবার পরিবেশন করা হয়। সেদিক থেকে বলা যায় তিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠ লোকদের একজন। একজন সফল বিজনেসম্যান, বিলিয়নিয়ার তিনি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার গোয়েন্দা সংস্থার সাথে জড়িত বলেও ধারণা করা হয়। দীর্ঘ দিন অস্বীকার করলেও ২০২১ সালে তিনি নিজেকে ভাগনার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বলে স্বীকার করেন। ২০১৪ সালে গঠিত এই গ্রুপ প্রথম থেকেই দনবাসের পক্ষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ২০১৪ সালে যখন দনবাস স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন রুশ সেনা সেখানে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও অনেকেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেখানে যায় যুদ্ধ করতে। অনেকের ধারণা সে সময় স্ত্রেলকভ, যিনি এক সময় স্থানীয় প্রশাসনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি অবশ্য সেখান থেকে সরে আসেন। সেই সময়ই ভাগনার গ্রুপ জন্ম নেয়। ভাগনার গ্রুপের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এখানে সেনাদের অধিকাংশ জেল খাটা অপরাধী। হতে পারে এটাও এক ধরণের রাজনীতি। কারণ সেখানে মূলত নেয়া হয় সেই সব অপরাধীদের যাদের অপরাধ খুব গুরুতর নয়। এর সামাজিক দিক হল, অধিকাংশ মানুষ জেল থেকে বেরিয়ে সমাজে স্থান পায় না, মানুষ তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে, ফলে কি কাজকর্ম, কি ব্যক্তি জীবন – সব ক্ষেত্রেই তারা অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু যদি এরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তবে জেলের দাগ অনেকটাই মুছে যায়, সে আসে নতুন মানুষ হয়ে – সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে। ফলে ভাগনার গ্রুপ শুধু ভাড়াটে সেনাই নয়, এটা এক ধরণের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে বলেই অন্তত এতদিন বিশ্বাস করা হত।

ভাগনার গ্রুপ ও এভগেনি প্রিগঝিন একাধিক টেলিগ্রাম চ্যানেল চালাতেন, আমি নিজের কয়েকটা গ্রুপ থেকে নিয়মিত খবরাখবর পেতাম। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেসব ছিল অভিযোগ অনুযোগ আর নিজেদের বড় করে দেখানোর প্রবণতা। বিশেষ করে শউগুর উপর বিভিন্ন ব্যক্তিগত আক্রমণ। তখন থেকেই জানি বর্তমান সামরিক নেতৃত্বের প্রতি গ্রুপ প্রধান প্রিগঝিনের অবিশ্বাস, এদের ধীরে চলার নীতির বিরোধিতা। এর আগেও একাধিকবার অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। এক কথায় ভাগনারের প্রধান প্রিগোঝিন, যিনি নিজে বিলিওনিয়ার, যে অন্যদের নেতৃত্বে সহজে মেনে নিতে পারবেন না সেটা তার সফল বায়োগ্রাফি বলে দেয়।

ইউক্রেনে অপারেশনের শুরুতে, বিশেষ করে বাখমুত বা আর্তিওমভস্ক দখলে ভাগনার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে শইগু বা গেরাসিমভ বা সুরাভিকিন – যারা এই যুদ্ধ পরিচালনার সরাসরি দায়িত্বে আছেন তাদের নেতৃত্ব মেনে না নেয়ার কারণে তা বিভিন্ন সময়ে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।  মে মাসের শুরুতে ভাগনার গ্রুপ বাখমুত ছেড়ে চলে যাবার কথা ঘোষণা করে। বিগত মাস দেড়েক তারা আর লাইম লাইটে নেই। হয়তো এটাও প্রিগোঝিনকে প্রভোক করেছে। আর তাই গতকাল রুশ আর্মি তাদের ঘাঁটিতে হামলা করেছে বলে অভিযোগ করে তিনি টেলিগ্রাম চ্যানেলে খবর প্রকাশ করেন। যুদ্ধের সময়ে এ ধরণের খবর প্রকাশ আইনত দ্বন্দ্বনীয়। রুশ আর্মি কোন রকম আক্রমণের কথা অস্বীকার করে। তাছাড়া তিনি যে ভিডিও প্রকাশ করেন সেটা তাঁর দাবীর সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে প্রশ্ন করেছে অনেকেই। পরবর্তীতে প্রিগঝিন শইগু ও গেরাসিমভকে গ্রেফতার করার জন্য কোর্টে আবেদন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে প্রিগঝিনের এ ধরণের ব্যবহার নতুন নয়। এর আগেও একাধিকবার পুতিনের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে এসব সমস্যা মেটাতে হয়েছে।  তবে সেই ভিডিও প্রকাশের পরে ভাগনারের সদস্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।  তাদের অনেকেই অস্ত্রশস্ত্র ট্যাঙ্ক নিয়ে রোস্তভে আসে ও সেখানকার প্রাশাসনিক ভবন ও রোস্তভে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের আর্মির হেড অফিস ঘেরাও করে। ঘটনাস্থল থেকে যেসব ভিডিও প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায় সাধারণ মানুষ দারুণ নাখোশ। অনেকেই সেনাদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রশ্ন করে “তোমরা এখানে কি চাও? যদি দেশপ্রেমিক হও যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যাও। ” এটা দেখে আমার মনে পড়ল ১৯৯১ সালের কথা। আগস্টের পুতচা মানে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় রেড স্কয়ারে আমি নিজে এক সেনাকে একই প্রশ্ন করেছিলাম।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (১০৩): ভাগনার বিদ্রোহ – এর পর কি? -বিজন সাহা

প্রিগঝিন হিসেবি মানুষ। সফল মানুষ। ভ্লাদিমির পুতিনের বিশ্বস্ত মানুষ। কেন তিনি এমন করলেন এ প্রশ্ন তাই সামনে চলে আসে। বর্তমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনি বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখেন। হয়তো বা এই সব অনুসারীর সংখ্যা তাঁকে এ ধরণের পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে। হতে পারে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কোন টোপ। অথবা হতে পারে তিনি এর মাধ্যমে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বরাবরের মত সেটাকে এড়িয়ে না গিয়ে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব ও প্রেসিডেন্ট এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ করা যেতে পারে বিভিন্ন প্রশ্নে আর্মির নেতৃত্বের সাথে প্রিগঝিনের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। অতীতে একাধিক বার সেটা প্রকাশ্যে এসেছে। তবে কি এটা কেউ ইচ্ছে করে করেছে? সে যাই হোক না কেন এটা যে রাশিয়ার ভবিষ্যত রাজনীতিতে  বড় দাগ রাখবে তাতে সন্দেহ নেই। যদিও ভাড়াটে সেনা রাশিয়ায় বেআইনি, তবে ভাগনারের সাফল্য রুশ দুমাকে এ ব্যাপারে কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করতে উদ্বুদ্ধ করে। এখন কি হবে সে সব আইনের? কেননা তখন সমাজে ও দুমায় এ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল। হাজার বছরের ইতিহাসে রাশিয়া প্রায় কখনই বাইরের শক্তির কাছে পরাজিত হয়নি। এদের পরাজয় ঘটেছে আভ্যন্তরীণ অনৈক্যের কারণে। এতদিন পর্যন্ত সমাজে সেই ঐক্য ছিল। এখন কি দাঁড়াবে সেটা দেখার বিষয়। তবে ঘটনা যে সিরিয়াস তাতে সন্দেহ নেই। পুতিন বিদ্রোহীদের দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করেছেন মস্কো সহ বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস বিরোধী আইন জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মাস প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছে। সোমবার মস্কোয় সরকারি ছুটি। বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তবে আর্মিতে প্রিগঝনের সমর্থন আছে বলে মনে হয় না।

রাশিয়া এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধে আবাসিক এলাকা আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছে। ভাগনারের সেনাদের বড় অংশই জেল খাটা আসামীদের দ্বারা গঠিত, তাই তারা কি করবে সেটা দেখার বিষয়। রোস্তভে তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। তাই সেখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু। শোনা যাচ্ছে তারা ধীরে ধীরে মস্কোর দিকে এগুচ্ছে। ফলে মস্কো যাবার পথে বেশ কড়াকড়ি। মস্কোর প্রবেশ পথে সাজোয়া গাড়ি বসাচ্ছে বলে শুনলাম। তবে ইতিমধ্যে রাশিয়ার সমস্ত প্রদেশের প্রধানগণ সেনাবাহিনী ও প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছেন, তারা নিজ নিজ এলাকার ভাগনার গ্রুপের সদস্যদের ব্যারাকে ফিরে যাবার ডাক দিয়েছেন। কাদিরভ বাহিনী রোস্তভের কাছে পৌঁছে গেছে যদি ভাগনার বাহিনীকে বাঁধা দিতে হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কাদিরভ বাহিনী মানে চেচেন বাহিনী নয়। চেচনিয়ার গুদেরমেসে আহমাদ হাজী কাদিরভের নামে স্পেশাল ফোর্সের এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গঠন করা হয়েছে যেখানে রাশিয়ার সমস্ত এলাকার লোকজন প্রশিক্ষণ নেয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এদের হলা হয় কাদিরভ বাহিনী।

আলক্সান্দর লুকাশেঙ্কো ঘোষণা করেছেন যে প্রিগঝিনের সাথে তার কথা হয়েছে। তারা একমত হয়েছেন যে কোন মতেই রাশিয়ার মাটিতে যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। এখন নেগোসিয়েশন চলছে যাতে প্রিগঝিন সহ ভাগনারের সদস্যরা এই অবস্থা থেকে নিরাপদ ভাবে বেরিয়ে আসতে পারে। সেটাই হবে সব চেয়ে ভালো আউটকাম। প্রিগঝিন তার ভিডিও বার্তায় যেসব অভিযোগ তুলেছেন সেটা মূলত পশ্চিমা মাধ্যমের ভার্সনের প্রতিধ্বনি। তাই সেটা নিঃসন্দেহে রাশিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ করবে। গত দেড় বছরে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে পেরেছিল। সেটা হয়তো ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাছাড়া ন্যাটোর ভিতরেও ইউক্রেনের ভাগ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। বর্তমান ঘটনা তাদের নতুন করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে।

তবে জনজীবন কমবেশি আগের মতই আছে। টেলিগ্রাম চ্যানেলে রোস্তভ সহ বিভিন্ন শহরের যে ছবি তাতে জীবন কমবেশি আগের মতই, যদিও বিশেষ করে গাড়ি নিয়ে চলাফেরা একটু ব্যাহত হচ্ছে। একই কথা বলা যায় মস্কো বা অন্যান্য শহর সম্পর্কে। পিটারে ভাগনারের হেড অফিসে তল্লাশি চালানো হয়েছে। দুবনায় লোকজন চলছে, ফিরছে, ঘরাফেরা করছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে। এক কথায় সূর্য আগের মতই পূব দিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত গেছে। আবহাওয়া ভালো। ১৯ ডিগ্রি। ভোলগায় নামা হয়নি মেঘের বিশ্বাসঘাতকতায়।

আজ সকালে এখানকার জনজীবন স্বাভাবিক। যেসব এলাকায় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন জারি করা হয়েছিল তা তুলে নেয়া হচ্ছে। পিতেরে গত রাতে বরাবরের মতই বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে এবার সারা দেশ থেকে যারা স্কুল শেষ করল তারা অংশ নিয়েছে। সত্তর হাজার তরুণ তরুণী আনন্দে মেতে উঠেছে। আতশ বাজি, লাল পালের জাহাজ – সবই ছিল আগের মতই। ভাগনারের সেনারা ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রিগঝিন বেলারুশ চলে যাবেন। ভাগনার বাহিনীর যারা যুদ্ধে অংশ নিতে চায় তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের সাথে চুক্তি করতে হবে, অর্থাৎ এরা এখন রেগুলার আর্মির অংশ হবে। যারা চায় না তারা বাড়ি ফিরে যাবে। তাদের বিরুদ্ধে কোন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। সেদিন থেকে মনে হয় ভাড়াটে বাহিনীর ইতিহাস এখানেই শেষ হয়ে যাবে। এই চুক্তি নিয়ে কথা থাকবে, তবে সত্যটা এই যে একটা আসন্ন রক্তক্ষয়ী ও ভ্রাত্রিঘাতী যুদ্ধ এড়ানো গেছে। এখানে লুকাশেঙ্কো, পুতিন, প্রিগঝিন সবাই ম্যাচুরিটির পরিচয় দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যে দ্বৈত ব্যবস্থা চালু ছিল আর যার কারণে বার বার বিভিন্ন ছোটখাটো সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেটা দূর হবে। এটা মনে হয় পুতিনের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। ইতিমধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে গতকালের ঘটনা রাশিয়ার ইউক্রেন নীতির পরিবর্তন হবে না। যুদ্ধ আগের মতই চলছে। যতদূর জানা যায় ভাগনারের সদস্যরা ইতিমধ্যেই নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছে। প্রিগঝিন বেলারুশ চলে গেছেন। কেন তিনি এভাবে চলে গেলেন সে প্রশ্ন থেকেই যাবে। আমার মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। তখন ইনায়েভ ও কোম্পানি জনগণের সমর্থন পাননি আর এ কারণেই বাধ্য হয়েছেন হার মানতে। এখানেও মনে হয় সেটাই ঘটেছে। রাশিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তো বটেই, বিভিন্ন এলাকার প্রধান ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানালে তিনি বাধ্য হন আপোষে। কারণ বুঝতে পারেন এতে শুধু অযথা রক্তক্ষয় হবে কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হবেন না।

শুধু এতুকু বলা যায় অকস্মাৎ যেভাবে ঘটনার শুরু হয়েছিল ঠিক সেভাবেই শেষ হয়ে যায়। তবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে প্রিগঝিনের এই কাজে বিদেশী সমর্থন ছিল। তাই আগামী কিছু দিন এ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলবে। সঙ্গত কারণেই তিনি রাশিয়ায় অবাধে চলাচল করতে পারবেন না, অন্তত এই মুহূর্তে। তাঁর বাইরে কোথাও যাবার উপায়ও নেই বললেই চলে, কেননা তিনি বিভিন্ন দেশের নিষিদ্ধ তালিকায় আছেন। কিছু কিছু অসমর্থিত খবর আসছে তাঁর বর্তমান অবস্থান নিয়ে তবে সঠিক ভাবে না জেনে সেটা না বলাই ভালো। তাই এর শেষ কোথায় ও কিভাবে হবে সেটা একমাত্র ভবিষ্যৎ বলবে। আপাতত পশ্চিম রণাঙ্গনে সব শান্ত।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো