বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (১০০): কাউন্টার অ্যাটাক 

– বিজন সাহা  

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

বহু প্রত্যাশিত ও বহুল প্রচারিত ইউক্রেনের কাউন্টার অ্যাটাক শেষ পর্যন্ত শুরু হয়েছে। যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে। এমনকি মস্কোও ড্রোন আক্রমণের শিকার হয়েছে। রাশিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা আক্রমণের শিকার হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারণ এসব আক্রমণ হচ্ছে মূলত আবাসিক এলাকায়। অনেকের ধারণা রুশ সেনাবাহিনীকে এসব আক্রমণের মাধ্যমে মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টা এটা। আবার কেউ কেউ বলছে চেচনিয়ার যুদ্ধের সময় বাসায়েভ যেমন একটা হাসপাতাল দখল করে রাশিয়ার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করেছিল ইউক্রেন তেমনটাই চাইছে। কয়েকটা সীমান্তবর্তী এলাকা অতর্কিত আক্রমণ করে দখল করে রাশিয়াকে ইউক্রেন থেকে সেনা সরাতে বাধ্য করবে অথবা শান্তি চুক্তির জন্য কিছু সুবিধা আদায় করতে চাইবে। এসব স্ট্র্যাটেজি যে বিভিন্ন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার তৈরি তাতে এদের সন্দেহ আছে বলে মনে হয় না। আর এর বাইরে ইনফরমেশন যুদ্ধ তো আছেই। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন কাখভ বাঁধ ধ্বংস করেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক গ্রাম আর শত শত মানুষ। দুই পক্ষই চেষ্টা করছে একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে। স্বাভাবিক ভাবেই ইউক্রেন তথা পশ্চিমা বিশ্ব এর দায়দায়িত্ব রাশিয়ার কাঁধে চাপাতে চাইছে, প্রমাণ না দিতে পেরে বলছে রাশিয়া যদি ইউক্রেন আক্রমণ না করত তাহলে এমনটা ঘটত না। একই সাথে তারা বলতে ভুলে যাচ্ছে যে ন্যাটো যদি ইউক্রেনকে সদস্য করতে না চাইত, ইউক্রেনকে অস্ত্রসজ্জিত না করত তাহলে রুশ আক্রমণ হত না, যদি তারা ক্যুর মাধ্যমে ইনুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত না করত তাহলে এসব কিছুই ঘটত না।

কয়েক মাস আগে যখন দনেপার নদের ডান দিক থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার করা হয় তখন অনেকেই গেল গেল রব করতে শুরু করে। কিন্তু জেনারেল সুরাভিকিন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তখন এ নিয়ে সমাজে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠে, জনমনে এক ধরণের অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। সেই সিদ্ধান্ত অজনপ্রিয় জেনেও পুতিন তাকে সমর্থন করেন এই বলে যে যুদ্ধের মাঠে সেনাবাহিনীকে নিজেদের মত করে কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। রাজনৈতিক ভাবে অজনপ্রিয় হলেও যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য সঠিক। সে সময় এর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ যুক্তি দিয়েছিলেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন জার্মান বাহিনী এসব অঞ্চল দখল করে তখন সোভিয়েত সরকার দনেপারের বাঁধ খুলে দেয়। এখানেও সে যুক্তিই দেয়া হচ্ছে। তখন থেকেই ইউক্রেনের সেনারা একাধিক বার কাখভ বাঁধের উপর আক্রমণ চালায়। শুধু তাই নয়, ইউক্রেনের সেনাপতিরা সেই আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশও করে। মূল উদ্দেশ্য জাপারঝিয়ার পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কুলিং সিস্টেম অকেজো করা। তবে সোভিয়েত সরকার সে সময়ই রিজার্ভ জলাশয় তৈরি করে, ফলে এখনও পর্যন্ত বিপদ এড়ানো যাচ্ছে। কিন্তু যেটা ভাবার বিষয় তা হল তখন যদি রুশ সেনাদের প্রত্যাহার না করা হত তাহলে এরা আজ অন্য তীরে আটকা পড়ে যেত যার দুটো আউটকাম – হয় বীরের মৃত্যু বরণ না হয় আত্মসমর্পণ। বর্তমানে ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্যে সে এলাকায় যে পরিমাণ সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র জড় করেছে সেখানে হাজার পঁচিশ তিরিশ রুশ সেনা খুব বেশি কিছু করতে পারত না। বরং দুদিক থেকে আটকা পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারাত। তাই বলা যায় সেই সিদ্ধান্ত শুধু সঠিকই ছিল না, ছিল সুচিন্তিত। ভালো দাবাড়ু আক্রমণে যাবার আগে দশ চাল ভাবেন, প্রতিরক্ষা ঠিক আছে কিনা সেটা দেখেন। এখানেও মনে হয় সেটাই কাজ করেছে। এটা করে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, কিন্তু আসল কথা হল সেই আক্রমণ যে সাফল্য লাভ করবে না ওরা সেটা জানত, তবে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে পড়ে সেটা করতে বাধ্য হয়েছে। এখন পাল্টা আক্রমণ যদি নাও করে তার একটা অজুহাত থাকবে। আর সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে রুশ অনুগত অংশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তো করেছেই, আগামী অনেক কালের জন্য ক্রিমিয়ার জল সরবরাহে বিশাল সমস্যা সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বাঁধ ভাঙার ফলে রুশরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পরিবেশ। শুধুমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। কিন্তু এক্ষেত্রে পরিবেশবাদীরা স্পিকটি নট। যাহোক, পশ্চিমা বিশ্ব যতই বলার চেষ্টা করুক না কেন এই আক্রমণ যে ইউক্রেন করেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারচেয়েও বড় কথা ইউক্রেন যদি এ আক্রমণ না করত, তাদের পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত না করতে পারলেও বিলম্বিত করতে পারবে এই ভাবনা থেকে রাশিয়া যদি এই আক্রমণ করত তাহলে কেন ইউক্রেন দনেপারের উপরের দিকে বাঁধ খুলে গিয়ে অবস্থা আরও খারাপ করছে, কেন তারা বন্যায় আটকে যাওয়া মানুষের উপর গুলিবর্ষণ করছে? যেকোন ঘটনার সঠিক বিশ্লেষণের জন্য সঠিক প্রশ্ন করতে হয়, নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করতে হয় – একমাত্র তখনই ঘটনার সঠিক চিত্র পাওয়া যায়। এর আগে বুচা, নর্থ স্ট্রীম এসব নিয়েও রাশিয়ার ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা হয়েছে, দোষ চাপানোর চেষ্টা হয়েছে মালয়েশিয়ার বিমান ভূপাতিত করা নিয়েও – কিন্তু ইউক্রেন বা আন্তর্জাতিক মহল কেউই এসব অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। শুধু মিথ্যে কথা দশবার বললে সেটা সত্য হয়ে যাবে সেই তত্ত্ব অনুযায়ী কাজ করে গেছে। আসলে তাদের সত্য মিথ্যা প্রমাণের দায়িত্ব ছিল না, নেই – তাদের একটাই উদ্দেশ্য এভাবে মিথ্যা প্রচার করে নিজেদের জনমতকে ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। যখন দেশে দেশে রাজনৈতিক এলিট শ্রেণী দেউলিয়া তখন যুদ্ধই একমাত্র উপায় এ থেকে বেরিয়ে আসার। এমনকি সেইমুর হেরস পর্যন্ত তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে আমেরিকা আর ব্রিটেন নর্থ স্ট্রীম ধ্বংস করেছে আর এখন জার্মানি আর ডেনমার্কের সাহায্যে এর দোষ ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমা মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে এটা করেছে জালুঝনি, যিনি নিজেই এখন জীবন সংকটে।  মনে রাখতে হবে নর্থ স্ট্রীমে বিস্ফোরণ শুরু রাশিয়ার বিরুদ্ধেই নয়, মিত্র দেশ জার্মানির বিরুদ্ধেও। এটাই যদি হয় আমেরিকার রাজনীতির মূলধারা তাহলে বিশ্বে শান্তিই বা আসবে কোত্থেকে আর আন্তর্জাতিক আইন শৃঙ্খলাই বা পালিত হবে কিভাবে?

আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব কি ইউক্রেনে শান্তি চায়? মনে হয় না। তাহলে প্রথম থেকেই অশান্তি করত না। ২০১৪ সালের ক্যু হত না, মিনস্ক শান্তি চুক্তি এভাবে পদদলিত হত না, এমনকি ইস্তানবুল চুক্তি ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হত না। এদের একটাই লক্ষ্য স্লাভিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করা। আর ইউক্রেন স্লাভিক দেশ যেমন পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো, স্লভেনিয়া সহ আরও অনেক দেশ। রুশ জাতি, যদি ভুল না করি শ্বেতাঙ্গ রেসের সবচেয়ে বড় একক জনগোষ্ঠী। কী নেপোলিয়ন, কী হিটলার এরা সবাই ইউরোপের শক্তি দিয়ে বার বার রাশিয়া আক্রমণ করেছে, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ইউক্রেন এখানে শিখণ্ডীর ভূমিকা পালন করছে, যদিও রাশিয়া মোটেই দ্রোণাচার্য নয়, মানে প্রয়োজনে ইউক্রেন বাহিনী ধ্বংস করতে সে দ্বিধাবোধ করবে না। কিন্তু ইউক্রেন দিয়ে যুদ্ধ শেষ হবে বলে মনে হয় না। কারণ বিভিন্ন মহল ইতিমধ্যে বাল্টিকের দেশগুলো আর পোল্যান্ডকে যুদ্ধে নামাতে চাইছে। এরপর আসবে চেখ, আসবে জার্মানি। রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যেকোন জাতিতেই উৎসর্গ করতে রাজি। তাদের একটাই উদ্দেশ্য নিজেদের ভবিষ্যৎ কণ্টক মুক্ত করা। আর যেভাবেই হোক রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া।

পড়ুন:  বিজ্ঞান ভাবনা (৯৯): হিন্দু সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার - বিজন সাহা

বিভিন্ন ডকুমেন্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় লেনিনগ্রাদের ৯০০ দিন অবরোধের সময় মানুষ দিনে ১২৫ থেকে ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত খাবার পেয়েছে, প্রচুর মানুষ অনাহারে মারা গেছে, ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মৃত মানুষের মাংস পর্যন্ত খেয়েছে, কিন্তু শহরের চিরিয়াখানার একটি প্রানীও অভুক্ত মানুষের শিকার হয়নি। এখনও এদেশে অধিকাংশ মানুষ পশুপাখিদের বাঁচাতে এগিয়ে আসে। অথচ কাখভ বাঁধ ধ্বংস করায় ন্যাশনাল পার্কে হাজার খানেক প্রাণী মারা গেছে। এখন সেনাবাহিনী আর স্বেচ্ছাসেবকরা আটকে পড়া মানুষের পাশাপাশি জীবজন্তু বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ছাদের উপরে কুকুর, বিড়াল, শুয়োর এসব মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে।

অনেকদিন পর্যন্ত ট্রুডোকে ভদ্রলোক বলেই জানতাম। ২০১৯ সালে রাশিয়া করোনার প্রচুর টেস্ট কানাডায় পাঠায় সাহায্য হিসেবে। বিনিময়ে ধন্যবাদ দেবার পরিবর্তে কানাডা এদের কার্গো বিমান আটকে রাখে। এখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তর করবে। ইতালিও পিছিয়ে নেই। করোনা কালে রাশিয়া সেখানে শুধু টেস্ট, মাস্ক এসব নয়, ডাক্তার পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। এখন তারা ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে রুশদের হত্যা করার জন্য। কবি কালিদাস এমনি এমনি বলেননি যে যদি শত্রু চাও তাহলে অন্যদের সাহায্য কর। যখন কানাডা নিজে বনে অগ্নিকান্ডের ফলে বিপদের সম্মুখীন, ট্রুডো এসেছেন ইউক্রেনে জেলেনস্কির হাতে নতুন করে অস্ত্র তুলে দিতে যাতে আরও বেশি মানুষ মারা যায়। কেননা পশ্চিমা অস্ত্র যতটা না যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে তারচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণে। হ্যাঁ, ভোটের রাজনীতি কানাডায়ও পৌঁছেছে। কে জানে, হয়তো বেগম পাড়ার চক্রান্ত।

আগে যদিও রাখঢাক করে বলত, এখন আর ইউক্রেনের নেতারা তার ধার ধারছে না। বিভিন্ন ইন্টার্ভিউতে বলছে ক্রিমিয়া দখল করলে সেখানকার চার মিলিয়ন মানুষকে তারা হত্যা করবে অথবা রাশিয়ায় ডিপোর্ট করবে। এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের এক সেনাপতি বলেছে আমেরিকা চাইছে ইউক্রেন যেন যত বেশি সম্ভব রুশদের হত্যা করে। ইয়াহিয়া খান পাক সেনাদের যত বেশি সম্ভব বাঙালি নিধন করতে বলেছিল। পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য রুশদের মানুষ মনে করে না, তাই মানবতাবাদীরা কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। মানুষ চেনা যায় কঠিন সময়ে, ক্রিটিক্যাল সময়ে। মূলত রুশ দেশের সস্তা কাঁচামালে উন্নয়নের শিখরে বসে ইউরোপ মানবতা দেখাতে পেরেছে, কিন্তু আজ যখন নিজেদের দোষে তা পাচ্ছে না তখন তারা নতুন করে মধ্যযুগের হিংস্রতা দেখাচ্ছে যখন তারা একের পর এক দেশ দখল করে সেসব দেশের মানুষ হত্যা করেছিল অথবা তাদের দেউলিয়া করেছিল। সাধারণ মানুষ হয়তো এখনও এতটা নষ্ট হতে পারেনি, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে পচে গেছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথায় বলে মাছ পচতে শুরু করে মাথা থেকে।

গত ১৩ জুন ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধক্ষেত্রে কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন কাউন্টার অ্যাটাকে যে পরিমাণ ইউক্রেন সেনা নিহত বা আহত হয়েছে সেটা প্রায় ক্যাটাস্ট্রফিক। মাত্র কয়েক দিনে সাড়ে নয় হাজার সেনা হারিয়েছে ইউক্রেন, আহত বা নিহত রুশ সেনাদের সংখ্যা এক হাজারের কম। এই কয়দিনে ইউক্রেন ১৬০ ট্যাঙ্ক ও ৩৬০ সাজোয়া গাড়ি হারায়, সেক্ষেত্রে রুশদের ক্ষতির পরিমাণ ৫৪ টি ট্যাঙ্ক। যদিও যুদ্ধে নিহত ও আহতের অনুপাত সাধারণত ৩০/৭০, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে সেটা প্রায় ৫০/৫০। এতসবের পরেও পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে দিয়ে যুদ্ধ করাবেই। ফ্রান্স, জার্মানি ও পোল্যান্ড ঘোষণা করেছে কাউন্টার অ্যাটাক চালিয়ে যেতে তারা ইউক্রেনকে সাহায্য করে যাবে, প্রয়োজনে শেষ ইউক্রেনিয়ান পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। কাখভ বাঁধে আক্রমণের ব্যাপারে বাইডেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি এক গাল হেসে বলেন আমরা সেখান থেকে কোথাও যাব না। কিন্তু সমস্যা হল এই যুদ্ধ, বিশেষ করে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলাফল ভোগ করতে হবে ইউক্রেনের জনগণকেই।  ইউক্রেনের মানুষ কি যুদ্ধ চায়? ওখানে কি গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়েছে? বলতে গেলে লোকজনকে জোর করে ধরে এনে যুদ্ধে পাঠাতে হচ্ছে। কেন? মনে হয় অধিকাংশ লোক বুঝে গেছে যুদ্ধটা তাদের নয়, এটা আমেরিকা আর পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ। হয়তো তাই আর যুদ্ধ করতে চাইছে না। তবে একথা সত্য যে এই যুদ্ধ আসলে ভবিষ্যতের সর্বগ্রাসী যুদ্ধের রিহার্সাল। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এসব জায়গায় আমেরিকা বা ন্যাটো কোন বাধা পায়নি বলে নিজেদের অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারেনি। এখন সেটা হচ্ছে। দু পক্ষই নতুন নতুন অনেক অস্ত্র পরীক্ষা করছে যাতে ভুলত্রুটিগুলো শোধরাতে পারে। এমন সুযোগ খুব একটা মেলে না। তাছাড়া বর্তমান ইউক্রেন সেনারা ন্যাটোর সেনাদের কৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধ করছে। সেটাও রুশদের সাহায্য করছে অভিজ্ঞতা অর্জনে। কারণ এরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে যে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড যতদিন পর্যন্ত না তাদের বিদেশ নীতির পরিবর্তন করবে, যতদিন পর্যন্ত না তারা অন্যদের ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করবে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধের আগুন জ্বলতেই থাকবে – কখনও দাউ দাউ করে, কখনও তুষের আগুনের মত। পুতিন ঘোষণা করেছেন যে প্রথম দিকে পরিমানগত সমস্যা থাকলেও এখন আর সেটা নেই, কলকারখানা দুই এমনকি তিন শিফটে কাজ করছে। অনেক প্রাইভেট কোম্পানি এখন সেনাবাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসছে। শুধু তাই নয় বদলে যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, তৈরি হচ্ছে নতুন এলিট শ্রেণী। যদি ইউক্রেন রুশ ভূখণ্ডে তার আক্রমণ অব্যাহত রাখে তাহলে রাশিয়া বাধ্য হবে সেখানে স্যানিটারি করিডোর তৈরি করতে যেখান থেকে রুশ এলাকায় কোন গুলি এসে পৌঁছুতে পারবে না। শস্য চুক্তি হয়তো আর নবায়ন করা হবে না। রাশিয়া এই চুক্তি করেছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দরিদ্র ও বন্ধু দেশগুলোর কথা ভেবে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব যেহেতু কথা রাখছে না তাই এই চুক্তি মেয়াদ বাড়ানো নাও হতে পারে। রাশিয়াও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেই মনে হয়। পশ্চিমা বিশ্ব চেয়েছিল এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়াকে দুর্বল করতে, এদের মধ্যে ফাটল ধরাতে। এখনও পর্যন্ত উল্টোতাই হচ্ছে – এরা অনেক বেশি শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী হয়েছে, এদের ঐক্যও আগের যেকোন সময়ের চেয়ে দৃঢ়।

গতকাল থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরাম শুরু হয়েছে। ১৪ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত এই ফোরামে শতাধিক দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়েছেন বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যার সামাধানের খোঁজে। পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে প্রতিটি ফোরামে ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা টেনে সেটাকে রুশ বিরোধী রাজনৈতিক নাটকে পরিণত করতে চায়, সেখানে রাশিয়া এ রকম বিভিন্ন ফোরামে বিশ্বের অন্যান্য সমস্যা নিয়ে কথা বলে, সেসবের সমাধান খোঁজে। এটাও প্রমাণ করে যে যুদ্ধটা আসলে কার দরকার – রাশিয়ার নাকি আমেরিকার। যতদিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণ বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের ধোঁকা দিতে দেবে ততদিন শান্তি আসবে না। শিক্ষার মূল কথা প্রশ্ন করা। আজ দেশে দেশে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্ন না করার এই যে সংস্কৃতি গড়ে তোলা হচ্ছে সেটাই আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো