বিজ্ঞান প্রযুক্তি

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের অত্যাশ্চর্য ছবিটি কীভাবে তোলা হয়েছে?

-অপর্ণা চক্রবর্তী

আজ লিখতে বসলাম আমাদের মিল্কিওয়ে র কেন্দ্রের সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের এই অত্যাশ্চর্য ছবিটি কীভাবে তোলা হয়েছে?
ধরো তোমাকে বলা হলো তেঁতুলিয়ায় দাঁড়িয়ে টেকনাফের নাফ নদীর তীরের এক বালুকণার ছবি তুলতে।
তুমি হেঁয়ালি ভেবে উত্তরই দেবে না তাইতো? ভাববে, পাগলের কথা। এক অসম্ভব কাজ। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞানীরা সেই অসাধ্য কাজটিই করেছেন ভীষণ ভীষণ দক্ষতার সাথে।
মিল্কিওয়ে র কেন্দ্রে যে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল রয়েছে সেই গল্পটা লিখেছিলাম আমি। প্রত্যেক গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই রয়েছে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল। তো আমাদের এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের গাল ভরা একটা নাম আছে, Sagittarius A*!
সংক্ষেপে SgrA*, আমি সংক্ষেপে লিখবো। বার বার কীবোর্ড চেঞ্জ করা তো!!!
পৃথিবী থেকে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে তাকালে দেখা যাবে, কিছু নক্ষত্র একটি অদৃশ্য বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাদের ঘূর্ণন গতিও অস্বাভাবিক।আর যে অদৃশ্য বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে নক্ষত্ররা সেই অদৃশ্য বিন্দুটিই SgrA*।
Sgr A* আমাদের পৃথিবী থেকে ২৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। আমাদের সূর্যের চেয়ে ৪১ লক্ষ গুণ বড় এই SgrA*।
এখন এই এতদূরের কোনো বস্তুর সার্ফ ইমেজ ক্যাপচার করতে গেলে আমাদের পৃথিবীর সমান টেলিস্কোপ দরকার। কিন্তু বাস্তবে তো তা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীরা ২০১৭ সালে একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, পৃথিবীর চারপাশে বিভিন্ন দিকে ছোট ছোট টেলিস্কোপ বসিয়ে কেন্দ্রের এই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলবেন।
এই ভাবে ছোট ছোট টেলিস্কোপের মাধ্যমে বহুদূর পর্যবেক্ষণের নাম ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ। তাঁরা দুটো সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল এর ছবি তুলেছেন। আরেকটি হলো ম্যাসিয়ার ৮৭ বা M87 ।
M87 এর ছবি প্রকাশিত হয় ২০১৯ এর ১০ ই এপ্রিল। আর SgrA* এর ছবি প্রকাশিত হয় ২০২২ এর ১২ মে।
প্রশ্ন করবে নিশ্চয়ই, কারণ কী?
প্রথম কারণ M87 আমাদের গ্যালাক্সি নয়, আর প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। ফলে তার ছবি তোলা তুলনামূলক সহজ ছিল।কারণ M87 আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল নয়। তাই তার সার্ফ ইমেজ ক্যাপচার করা তুলনামূলক সহজ ছিল বিজ্ঞানীদের জন্য।
আমাদের কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোলকে পৃথিবী থেকে দেখলে দেখা যায় বহু গ্যাস, ধুলো বালির ভেতর রয়েছে সে।
তাই M87 এর ছবি আগে প্রকাশিত হয়। আর তার ছবি SgrA* থেকে অনেকটা পরিষ্কার। কিন্তু আমাদের SgrA* র ছবি ঘোলা বা অপরিষ্কার কেন?
এটা আসলে আমাদের ফিজিক্যাল লিমিট। একই গ্যালাক্সিতে থেকে তার কেন্দ্রের ছবি এর চেয়ে স্পষ্ট আর তোলা সম্ভব নয়।
M87 এর ব্যাস আমাদের SgrA* থেকে ১০০০ গুণ বড়। তার ইভেন্ট হরাইজন এর ব্যাস আমাদের পুরো সোলার সিস্টেমের সমান।
যে ছবি তোমরা দেখতে পাচ্ছো তা কিন্তু ব্ল্যাকহোলের ইভেন্ট হরাইজনের ছবি। ব্ল্যাকহোলের ছবি তোলা কোনোদিন সম্ভব নয়, কারণ তার থেকে কোনো আলোই নির্গত হয় না। SgrA* কে M87 থেকে কিছুটা বড় দেখায়, কারণ SgrA* আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল, কিন্তু M87 ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তাই একটু ছোট দেখায়। প্রত্যেক ইভেন্ট হরাইজনের ম্যাটার প্রচন্ড গতিতে ঘুরতে থাকে।
M87 এর ইভেন্ট হরাইজনের ব্যাস বড় হওয়ায় তার এক একটি ঘূর্ণন সম্পন্ন হতে সময় নেয় কয়েকদিন থেকে এক সপ্তাহ আর সেখানে SgrA* এর ঘূর্ণন সম্পন্ন হতে সময় নেয় মাত্র কয়েক মিনিট।
আমাদের SgrA* সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল খুব এক্টিভ নয়। তার ইভেন্ট হরাইজনে ম্যাটার অনেক কম। সেই তুলনায় M87 সক্রিয় ব্ল্যাকহোল। তার ইভেন্ট হরাইজনে প্রচুর ম্যাটেরিয়াল। তাই M87 ছবি কিছুটা পরিষ্কার।
এখন আসি, বিজ্ঞানীরা, ছবি তুললেন কীভাবে?
প্রতিটি ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের সাথে যুক্ত করা হয় এটমিক ঘড়ি। কারণ এটমিক ঘড়িতে লক্ষ বছরে এক সেকেন্ডের গরমিল হতে পারে। তারপর সমস্ত টেলিস্কোপ একই সময়ে তাক করা হয় SgrA* এর দিকে। ছবি তোলা হয় রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে। এই রেডিও ওয়েভের শক্তি এতটাই ছিল যে প্রত্যেক টেলিস্কোপের সাথে যুক্ত ছিল একটি করে হার্ড ডিস্ক। এরপর সকল হার্ডডিস্ক কে একত্রিত করে সুপার কম্পিউটারে স্পেশাল আলগরিদমের সাহায্যে এই ছবি তে আনা হয়। হাজার খানিক ছবিকে এক করে এরকম ইমেজ প্রকাশ করা হয়। রেডিও ওয়েভ সংক্রান্ত বহু জটিল কিছু অত্যন্ত সাবধানতার সাথে সমাধান করা হয়।
রেডিও ওয়েভ তো দৃশ্যমান নয়। তাই দৃশ্যমান আলো হিসেবে দেয়া হয়েছে কমলা রঙ। কারণ কমলা রঙে সব কিছুর তাপমাত্রা খুব সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এই SgrA*. এর ছবি তোলা ছিল বিজ্ঞানীদের ভয়ানক চ্যালেঞ্জিং। দিনরাত এক করা কত শত বিজ্ঞানীর মেধা শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই দুঃসাধ্য Sagittarius A* এর এই অসামান্য ছবি।
আমার কসমোলজী প্রিয় বন্ধুদের জন্য অল্প করে লিখলাম।
লেখক পরিচিতি  – অপর্ণা চক্রবর্তী ১৯৮৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কিশিনেভ স্টেট ইউনিভার্সিটি যান। পিওর কেমিস্ট্রিতে ১৯৯১ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন। পরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কেমিস্ট হিসেবে তিনবছর কাজ করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত একটি বেসরকারি স্কুলে প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেঁচে থাকার জন্য বহু কিছু ভালবাসেন। তার মধ্যে বাগান করা, গান শোনা, বেড়ানো, ছবি তোলা, রান্না করা অপর্ণার বিশেষ শখ।