মতামত

নিরাপদ মাতৃত্ব ও নারী শ্রমিকের অধিকার

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

২৮ মে, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। ’মা’ শব্দটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কিন্তু মধুরতম শব্দ। মাতৃত্ব একজন নারীকে পূর্ণতা দেয়। নারী তার মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিশ্বে বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বিশ্বের কোন কিছুরই বিনিময়ে মায়ের ঋন শোধ করা যায়না।
নারীর এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশে ১৯৯৭ সাল থেকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। মূলত নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া এবং গর্ভকালীন সময় হতে সন্তান প্রসব ও প্রসব পরবর্তী সময়ে নবজাতক ও মায়ের নিরাপত্তা বিধান করাই এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। প্রত্যেক মা যাতে নিরাপদে সন্তান প্রসব করতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সমাজের।
জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর তথ্যমতে, শিশু জন্ম দিতে গিয়ে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারী মারা যান। আর অন্ততপক্ষে সত্তর লক্ষ নারী প্রসব পরবর্তীতে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া আরও পাঁচ কোটি নারী প্রসবের পর নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভোগেন।
এদিকে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ হাজার নারী গর্ভধারণ ও গর্ভধারণ সংক্রান্ত কারণে মারা যায় বলে ডবিøউএইচও জানায়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৮৮৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। গত বছর তা কমে ৭৮৮ জনে নেমেছে।
এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ২০১০ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ছিল ১৯৪ জন। এক দশকে তা কমে ১৬৫ জনে নেমে এসেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর হার কমলেও বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় ধনীদের তুলনায় প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারীরা ৩০০ গুণ বেশী নিরাপদ মাতৃত্ব জনিত শঙ্কায় রয়েছে। এই সকল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ হচ্ছে কর্মজীবী নারী।
বাংলাদেশে মোট শ্রমিক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। তন্মধ্যে নারী শ্রমিককের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি হবে। এই বিশাল সংখ্যক নারী শ্রমিকের মধ্যে যারা প্রতি বছর গর্ভধারন করে থাকে, তারা একাধারে নবজাতককে পেটে ধারন করে এবং চাকুরী ও পারিবারিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই এই কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, অন্য দশ জন সাধারণ গর্ভবতী নারীর তুলনায় একজন কর্মজীবী গর্ভবতী নারীর নিরাপত্তা শঙ্কা থাকে অনেক বেশী। সুতরাং প্রত্যেক মা শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধান করা সংশ্লিষ্ট সবাইকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীদের জন্য শ্রম আইনের ৪৫ থেকে ৫০ ধারায় তাদের মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা ও বিভিন্ন কল্যানমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নারী মা শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে শ্রম আইনের ৪৫ ধারায গর্ভধারন পরবর্তী সময়ে তাদের দিয়ে দুষ্কর বা শ্রমসাধ্য, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অথবা তার স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এমন কোন কাজে নিয়োজিত না করার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আইনের এই ধারাটি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা তদারকির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
এছাড়া শ্রম আইনের ৪৫ থেকে ৫০ ধারা সমূহ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, একজন গর্ভবতী নারীর চাকুরীর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে এবং তার ২টির কম জীবিত সন্তান থাকলে, সন্তান প্রসবের পূর্বে ৮ সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের পরে ৮ সপ্তাহ সবেতন ছুটি প্রাপ্য। অর্থাৎ বেসরকারী খাতে কর্মরত একজন নারী শ্রমিক কেবল ১১২ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি পায় অথচ সরকারী খাতে কর্মরত একজন নারী শ্রমিক ছয় মাস তথা ১৮০ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়ে থাকে। এটা একটি বড় ধরনের বৈষম্য। একটি গণতান্ত্রিক ও কল্যণ রাষ্ট্রে যা কখনোই কাম্য হতে পারেনা। এ ধরনের বৈষম্য মূলক আইন সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সাথেও সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে ধারা ৪৭ এর ৪ উপ ধারার দফা ’ঘ’ তে উল্লেখ আছে প্রসূতি কল্যাণ ছুটিতে যাবার নির্ধারিত তারিখের পূর্বে কোন মহিলা শ্রমিকের গর্ভপাত ঘটলে তিনি প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাবেন না। এ ধরনের আইন করে রাষ্ট্র প্রসূতি নারী শ্রমিকদের প্রতি অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। যা মানবিধাকারের চরম লংঘন।
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের গর্ভবতী নারী শ্রমিকদেরকে শ্রমিক কল্যান ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে সর্বোচ্চ পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত মাতৃত্ব কল্যাণ সুবিধা প্রদান করার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকেরা এই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এব্যাপারে শ্রমিক সংগঠনগুলোর সীমাবদ্ধতা থাকায় তারাও খুব একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারছেনা বলে প্রতীয়মান হয়।
শ্রম আইনে বর্ণিত ধারাসমূহ নিরাপদ মাতৃত্ব রক্ষায় যথেষ্ট কিনা এ নিয়ে বিতর্ক থাকা সত্তে¡ও আইনের ধারা সমূহ মুষ্টিমেয় কিছু কমপ্লায়েন্ট পোশাক কারখানা ছাড়া অন্য কোথাও পালিত হয়না। ফলে গর্ভকালীন নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা অরক্ষিতই রয়ে গেছে। এইরূপ অবস্থায় সকল প্রতিবন্ধকতা ও নিরাপত্তা শঙ্কা পেরিয়ে একজন কর্মজীবী নারী যখন সন্তান প্রসব করে তখন তাকে সন্তান লালন পালন নিয়ে আরো কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় ।
আমাদের দেশের পোশাক কারখানা সহ অন্যান্য কারখানায় ব্রেস্ট ফিডিং সেন্টার স্থাপনের জন্য হাই কোটের্র নির্দেশনাও রয়েছে। কিন্তু হাই কোটের্র এই নির্দেশনা বাসÍবায়নে রাষ্ট্র এবং মালিক পক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। আবার শ্রম আইনের ধারা ৯৪ তে উল্লেখ আছে কোন প্রতিষ্ঠানে ৪০ জনের অধিক নারী শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে, তাদের ৬ বৎসরের কম বয়সী শিশু সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিশু পরিচর্যা কক্ষ থাকবে। এই ধারাটিও সঠিকভাবে অনুসরণ করতে দেখা যায় না। প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই কোন ডে কেয়ার সেণ্টার নাই বললেই চলে। ফলে নবজাতক সন্তানের প্রতিপালন নিয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মখোমুখি হতে হয় প্রত্যেক কর্মজীবী মাকে। সন্তান লালন পালনে নানাবিধ ঝক্কি ঝামেলার কারনে অনেকে বাধ্য হয়ে চাকরীই ছেড়ে দেয় আবার অনেক কর্মজীবি মহিলা গর্ভধারন থেকেও বিরত রয়েছে। এ ধরনের নেতিবাচক প্রবনতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
একজন গর্ভবতী মা শ্রমিককে জীবীকার সংগ্রাম এবং সন্তান লালন পালন যুগপৎ চালাতে হয়। এই কঠিন সংগ্রাম চালাতে গিয়ে একজন নারী শ্রমিককে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় যা তার মধ্যে তৈরি করে তীব্র মানসিক চাপ।
আমাদের মনে রাখতে হবে একজন মা শ্রমিক বিশ্বে মানব জাতির বংশানুক্রমিক ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল রাখে। সুতরাং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের অপরিহার্য দায়িত¦। এমতাবস্থায় কর্মজীবী নারী শ্রমিকদের প্রতি আরো দায়িত্বশীল হয়ে উপরোক্ত বিষয়ে মালিক, রাষ্ট্র এবং সমাজে ক্রিয়াশীল অপরাপর বিভিন্ন মহল গুরুত্ব সহকারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে, আজকের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রত্যাশা।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি