স্বাস্থ্য

বহুগুণ সম্পন্ন সজনে হতে পারে আপনার হৃৎপিন্ডের বন্ধু

-ড. রতন চৌধুরী।

বেশ ক’বছর আগের কথা। তখন পিএইচডি করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন দু’জন শ্রদ্ধেয় স্যার- অধ্যাপক ড. শহিদুল আলম ও অধ্যাপক ড. শাহ্ আলম। স্যারদের পরামর্শ ও নিজের আগ্রহ থেকে গবেষণার শিরোনাম ঠিক করলাম- “Studies on seed borne fungi associated with pulses and their control”। গবেষণা তখন শুরু করেছি। গবেষণা মূলতঃ Seed Pathology এবং Microbiology নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিন কাঠা জমিও বরাদ্দ পেয়েছি একই সাথে ল্যাবরেটরী ও মাঠ গবেষণার জন্য। গবেষণা কাজে সহায়তা নেয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে আমার প্রায়ই যেতে হতো। এমনই এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শ্রদ্ধেয় স্যার বিজন কৃষ্ণ মৃধা’র (Bijan Krishna Mridha) সাথে ক্যাম্পাসের রাস্তায় দেখা হলো। স্যার আমার পূর্ব পরিচিত ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আমার পিএইচডি করার কথা উনি জানতেন কিন্তু কোন বিষয়ে করছি তা জানতেন না। সব কিছু শুনে আমার প্রতি তিনি ভালোবাসা প্রকাশ করলেন। পাশাপাশি বললেন, তুমি সজনে’র উপরে পিএইচডি করলে আরো ভালো হতো। তার ভাষায়- ‘আমার এতো প্রিয় একটি সবজি কিন্তু খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। বছর পরে আবার পাওয়া যায়। এটা বারোমাস ফলানো যায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। ভবিষ্যতে সম্ভব হলে এ নিয়ে কিছু করো”। স্যারকে আমি চিনি ও জানি। উনার বাসায় বেশ ক’বার খেয়েছিও। উনার ভাড়া বাসাতেও বেশ ক’টি সজনে গাছ দেখেছি। সজনে গাছের ছায়ায় তার বাসা সারা বছরই শীতল থাকতো।
আমার নিজেও সজনের প্রতি অসম্ভব ভাললাগা কাজ করে। আমার গ্রামের বাড়ীতে সজনে গাছ আছে। পাশাপাশি বছরে দু’বার সজনে ফলে এমন গাছও আছে। আমি নিজেও চাই বারোমাসি সজনে গাছ হোক। স্যার ও আমার মতো সজনে প্রেমীদের চাহিদা পূরণ হোক। কারণ সজনে যেমন পুষ্টিকর তেমন সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর বটে।
সজনে খুব দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদ। সজনে (বৈজ্ঞানিক নাম: Moringa oleifera) হচ্ছে Moringaceae পরিবারের Moringa গণের একটি বৃক্ষ জাতীয় গাছ। সজনের কাঁচা লম্বা ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়, পাতা খাওয়া হয় শাক হিসেবে। খরা সহিষ্ণু ও গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের একটি উদ্ভিদ। শাখা ও বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করলেও আমাদের দেশে সাধারণত শাখার মাধ্যমে বা অঙ্গজ জননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করানো হয়। গ্রীষ্মকাল বিশেষত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত শাখা মাটিতে লাগানোর উপযুক্ত সময়।
সজনে গাছের পাতাকে বলা হয় অলৌকিক পাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হার্ব। গবেষকরা সজনে পাতাকে বলে থাকেন নিউট্রিশন্স সুপার ফুড এবং সজনে গাছকে বলা হয় মিরাক্কেল ট্রি।
এটির শাক হিসেবে ব্যবহৃত পাতা ভিটামিন এ-এর এক বিশাল উৎস। সজনের পাতা এবং ফল উভয়ের মধ্যেই বিপুল পরিমাণে পুষ্টি আছে। এতসব পুষ্টিগুণ একসাথে আছে বলেই এর মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং জীবন ধারনের পুষ্টি দু’টোই পাওয়া যায়।
সজনের উপকারী গুণাবলী
০১। প্রতি গ্রাম সজনে পাতায় একটি কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি, দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও দুই গুণ বেশি প্রোটিন, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম বিদ্যমান। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতি জনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ ভাবে কাজ করে।
০২। এতে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে এবং পালংশাকের চেয়ে তিন গুণ বেশি আয়রণ বিদ্যমান, যা এ্যানেমিয়া দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
০৩। সজনে শরীরে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রনেও অন্যতম অবদান রাখে। ঘাতক কোলেস্টেরলকে হত্যা করে সজনে হৃদপিন্ডের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। এটি ৩ মাসের ব্যবহারে কোলেস্টেরল লেভেল অর্ধেকে নামিয়ে আনতে পারে।
০৪। মানুষের শরীরের প্রায় ২০% প্রোটিন যার গাঠনিক একক হলো এমাইনো এসিড। শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মেটাবোলিজম এবং অন্যান্য শারীরবৃত্ত্বীয় কার্যাবলী পরিপূর্ণরূপে সম্পাদনে এমাইনো এসিড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষের শরীরের যে ৯ টি এমাইনো এসিড খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়, তার সবগুলোই এই সজনের মধ্যে বিদ্যমান।
০৫। এটি শরীরে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ডায়াবেটিসের মত কঠিন রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে।
০৬। নিয়মিত দৈনিক সেবন শরীরের ডিফেন্স মেকানিজমকে আরো শক্তিশালী করে এবং ‘ইমিউনিটি স্টিমুল্যান্ট’ হওয়ার দরুন এটি ‘এইডস’ আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
০৭। এটি শরীরের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পুষ্টিবর্ধক হিসেবে কাজ করে।
০৮। শরীরের ওজন কমাতেও ব্যায়ামের পাশাপাশি এটি বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
০৯। এটি মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। পাতা থেকে তৈরি এক টেবিল চামচ পাউডারে ১৪% প্রোটিন, ৪০% ক্যালসিয়াম, ২৩% আয়রণ বিদ্যমান, যা ১ থেকে তিন বছরের শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় এবং বুকের দুধ খাওয়ানোকালীন সময়ে ৬ টেবিল চামচ পাউডার একজন মায়ের প্রতিদিনের আয়রণ এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
১০। এটির এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এটি যকৃত ও কিডনী সুস্থ রাখতে এবং রূপের সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবেও কাজ করে থাকে।
১১। সজনে-তে প্রায় ৯০টিরও বেশি এবং ৪৬ রকমের এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। যা জীবের জীবনীশক্তি বাড়ায়।
১২। এতে ৩৬ টির মত এন্টি-ইনফ্ল্যামমেটরি বৈশিষ্ট্য আছে। এছাড়াও এটি অকাল বার্ধক্যজনিত সমস্যা দূর করে এবং ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
১৩। পানিতে আর্সেনিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই সমস্যা নিরোধে সজনের বীজ কিংবা পাতা ভূমিকা রাখে। এমনকি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করতে সজনে বীজ বা পাতা ব্যবহার কার্যকরী।
১৪। সজনের বীজের তৈরি তেলে সত্যিই তেলেসমাতি আছে। অন্য যেকোনো ভেজিটেবেল অয়েল-এর চেয়ে এর গুণাগুণ বেশি। দীর্ঘদিনের লিভারের রোগীর জন্য এ তেল খুব উপকারী। সজনে গ্রহণে খাদ্যের গুণগত মান অটুট থাকে। পচনশীল খাবারকে দীর্ঘস্থায়ীত্ব দিতেও সজনের তেলের তুলনা নেই। বাতের ব্যথা-বেদনায় যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি শীতের আর্দ্রতা থেকে ত্বককে রক্ষা করা, রূপচর্চাতেও এই তেল কাজে লাগে।
১৫। সজনের মধ্যে আইসোথিয়োকাইনেটস নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, যা গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং গ্যাস্ট্রিকজনিত ক্যান্সার ঠেকাতে সহায়তা করে।
সতর্কতা
সজনে এর মূল অনেক সময় বিষাক্ত হতে পারে, যা স্নায়ুকে অবশ করে দিতে পারে। তাই খাওয়ার ক্ষেত্রে এটি বর্জন করাই শ্রেয়। এছাড়া এর বীজ মাছ এবং র‌্যাবিট এর জন্যেও বিষাক্ত হতে পারে। তাই সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ নেট থেকে।
(সজনে থেকে যেকোনো ধরণের পুষ্টি ও ভেষজ উপকারিতা পেতে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ভেষজবিদের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক)
# ড. রতন চৌধুরী নিসর্গবিদ, উদ্ভিদ গবেষক ও কবি