মতামত

জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৮ এপ্রিল জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে ঢাকায়এবং আঞ্চলিকভাবে জেলা ভিত্তিক দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। একথা সত্য যে,মানুষ কাজ করে জীবন ও জীবিকার জন্য। একজন শ্রমিক কাজ করে যে মজুরি পায় তা দিয়ে যেন তার নিজের এবং পরিবারের নির্ভরশীল সদস্যদের ভবিষ্যত  নিশ্চিত হয় সেটাই তার মূল লক্ষ থাকে। কিন্তু ২০০৫ সালে সাভারে স্পেকট্রাম বিল্ডিং ধস, ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে কেটিএস গার্মেন্টস এ আগুন, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে আগুন, ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধস, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় আগুন,  ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণ এবং সর্বশেষ চলতি বছরে সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণসহ আরো ছোট-বড় একাধিক দুর্ঘটনায় ব্যাপক শ্রমিক হতাহতের পর একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায় কেবল মজুরি দিয়ে শ্রমিকের আর্থিক নিরাপত্তা হয়তো কিছুটা নিশ্চিত করা যায় কিন্তু শ্রমিকের সার্বিক পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি টেকসই শিল্প গড়ে তুলতে কর্মস্থলের অবকাঠামো, অগ্নি নিরাপত্তা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করা অপরিহার্য্য। এছাড়া সাধারণভাবে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কর্মস্থলে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস, শ্রমিকদের পান করার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, শ্রমিকের সংখ্যানুপাতিক এবং নারী ও পুরুষের জন্য পৃথকভাবে পর্যাপ্ত পরিমান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন টয়লেট-ল্যাট্রিন ইত্যাদি থাকাও খুবই জরুরী।

কাজের বৈশিষ্ট্যগত কারনেও অনেক সময় শ্রমিকের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। যেমন- স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরে যারা এক্সরে বিভাগে কাজ করে তারা রেডিয়েশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, উচ্চ শব্দ তৈরি হয় এমন জায়গায় কাজ করলে শ্রমিকের শ্রবণ ক্ষমতা কমে যেতে পারে, ক্যামিকেল সংশ্লিষ্ট এবং নানাবিধ ডাস্টমিশ্রিত কাজে যুক্ত শ্রমিকদের শ্বাসকষ্ট ও চর্ম রোগসহ বিভিন্ন পেশাগত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকলে শ্রমিকের মানসিক ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।

এই সকল বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কলকারখানা তথা শিল্প প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সচেতনতা সৃষ্টির জন্যই এই দিবস পালনের প্রধানতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ।

বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আগ্রাসন সত্ত্বেও বাংলাদেশে আজও শ্রমঘন শিল্প বিরাজমান। শ্রমঘন শিল্পের মূল উৎপাদিকা শক্তি শ্রমিক। কর্মস্থলের সম্পদ ও শ্রমিকের জীবন রক্ষার্থে টেকসই অবকাঠামো নির্মান এবং শ্রমিকের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব মালিকের। কেননা শ্রমিকের শ্রমের উপর ভর করেই মালিকের ব্যবসার প্রসার ঘটে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনার কারনে কোন শ্রমিক মারা গেলে তাতে অন্য শ্রমিকের মনে নিরাপত্তা শংকা তৈরি হয়। শ্রমিক নিজে আহত হলে বা পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে তার কর্ম দক্ষতা কমে যায়, শ্রমিককে কাজে অনুপস্থিত থাকতে হয় –যা প্রকারন্তরে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনকে ব্যাহত করে। তাই বলতে দ্বিধা নেই শিল্পের স্বার্থেই মালিককে শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

শিল্পের নিরাপত্তা বিধান মালিকের দায়িত্ব হলেও মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে নির্দেশনা দেয় তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা এবং কর্মকালীন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ঘাটতি চিহ্নিত করে তা মালিকের নজরে আনা -প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরকে অবহিত করাও শ্রমিকের দায়িত্ব। কেননা শ্রমিককে মনে রাখতে হবে কলকারখানায় দুর্ঘটনার শিকার  হয় প্রধানত শ্রমিকেরা। সুতরাং নিরাপত্তা ঘাটতি নজরে আসার সাথে সাথে মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারী দফতরের নজরে এনে কাজ বন্ধ করে দিয়ে কর্মস্থল ত্যাগের ক্ষমতা বা অধিকার শ্রমিকের থাকতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইনগতভাবে শ্রমিকের সেই সুযোগ আদৌ আছে কিনা বা থাকলেও তার চর্চা কতটুকু?

আমরা জানি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও কর্তৃক প্রনীত কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বর্ণিত ধারা ১৭৬ এ প্রত্যেক শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার এবং যোগদানের অধিকার রয়েছে আবার চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্ণিত ধারা ২০৯ ও ২১০ অনুসরণ করে  সিবিএ ইউনিয়ন শ্রম বিরোধ উত্থাপন এবং ধর্মঘট করার অধিকার রাখে। কিন্তু ইউনিয়ন গঠন, সিবিএ ইউনিয়নের স্বীকৃতি প্রাপ্তি এবং শ্রম বিরোধ উত্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে একদিকে আমাদের শ্রমিক সংগঠন সমূহের জানা এবং বুঝার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে অন্যদিকে বিষয়টিতে অনেক আইনগত প্রক্রিয়া ও শর্ত জড়িত থাকায় এবং সময়স্বাপেক্ষ ব্যাপার হওয়ায় শ্রমিকের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তা আদৌ কার্যকর কিনা সেই ব্যাপারে ভাবনার অবকাশ আছে। কেননা নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তা দ্রুততার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ব্যাপারে রানা প্লাজা ধসের অভিজ্ঞতা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। আমরা সবাই জানি, রানা প্লাজা ধসের আগের দিন শ্রমিকেরা সবাই নিয়াপত্তা শংকা আঁচ করতে পেরেছিল। এমনকি মিডিয়া কর্মীরাও বিষয়টা জেনেছিল। শুধুমাত্র ব্র্যাক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ছাড়া কেউ বিষয়টাকে আমলে নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে এবং ব্র্যাক ব্যাংকের কর্মচারী ছাড়া বাকী সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালে শ্রম আইনের সংশোধনীতে ৯০(ক) ধারা যুক্ত করে সেফটি কমিটি গঠনের যে বিধান করা হয়েছে সেটাকে আরো কার্যকর করে,  সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে সেফটি কমিটি গঠন করে এবং সেফটি কমিটিকে সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা দিয়ে প্রয়োজনে শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে।

শিল্প এবং শিল্পের শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে রাষ্ট্রেরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শিল্প ও শ্রমিকের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি  দেখার দায়িত্বে আছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে আছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, বয়লারের সক্ষমতা ও নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য প্রধান বয়লার পরিদর্শকের অধীনে একদল পরিদর্শক এবং বিস্ফোরন সংক্রান্ত ঝুঁকি নির্নয় ও নিরাময়ের জন্য আছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর।

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সাথে আমার কাজ করার তেমন সুযোগ হয়নি তবে দীর্ঘদিন মানব সম্পদ বিভাগে যুক্ত থাকার সুবাধে আমি ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এবং বয়লার পরিদর্শকদের সাথে কিছুদিন কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে যথাক্রমে ফায়ার লাইসেন্স এবং বয়লার লাইসেন্স ইস্যু করে এবং বছর শেষে নবায়ন করে। লাইসেন্স নবায়নের পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার নিয়ম থাকলেও রহস্যজনক কারনে তাদের সেই ব্যপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখিনি বরং প্রতিটি লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফী ছাড়াও তাদের একটা নির্দিষ্ট চার্জ থাকে, তা পেয়ে গেলেই নবায়ন নিশ্চিত হয়ে যেতে দেখেছি। আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অবস্থা খুব বেশি ভাল বলা যাবে না। কথিত আছে সেজান জুস কারখানায় আগুন লাগার এক মাস আগে সেখানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিদর্শন করা হয়েছিল। একইভাবে চট্টগ্রামে বি এম ডিপো এবং সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পূর্বেও তারা নাকি পরিদর্শন করেছিল। কোন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনের পরে যদি দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য নিরাপত্তা ঘাটতি নির্নয় করা নাকি অন্য কিছু সেটা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার আছে বলে মনে করিনা। সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, শিল্প সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের তদারকি সংস্থা সমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চরম ঘাটতি রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানগুলো কাংখিত ফলাফল অর্জনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষতার ঘাটতি অনেক সময় পূরন করা সম্ভব কিন্তু দুর্নীতির কারনে কিংবা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে যে সংকট তৈরি হয় তা কখনো পূরন হয়না। তাই রাষ্ট্রের তদারকি সংস্থা সমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দুর্নীতি মুক্ত করাই হোক এবারের  জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবসের অন্যতম অঙ্গিকার।

# লেখকঃ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক