চলমান সংবাদ

বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বাড়ার নেপথ্যে কী?

বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। বেড়েছে ভোগ বৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে প্রমাণ হয় দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে।

একটি উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করতে হলে আয় বৈষম্য কমাতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫.৬ শতাংশ কমেছে। তবে দারিদ্র্য কমলেও বড়েছে বেড়েছে আয় বৈষম্য। আয় বৈষম্য পরিমাপকারী জিনি সহগ ২০২২ সালে বেড়ে ০.৪৯৯ শতাংশ পৌঁছেছে। ২০১৬ সালে এটি ছিল ০.৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। ফলে যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরো কমে গেছে। গরীবদের আয়বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আয় বাড়িয়ে আরো ধনী হয়েছেন।

জিনি সহগ শূন্য (০) দ্বারা সম্পূর্ণ সমতা প্রকাশ পায়। আর এ সহগ ১ হলে তা সম্পূর্ণ অসমতাকে নির্দেশ করে।

ভোগ-সম্পর্কিত জিনি সহগ গত বছর ছিল ০.৩৩৪। বিবিএস-এর উপাত্ত অনুযায়ী, এই সহগ ২০১৬ সালে ০.৩২৪ এবং ২০১০ সালে ০.৩২১ ছিল।  তাই দেশে আয় বৈষম্য এবং ভোগ বৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিবিএস-এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২ হাজার ৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি।

২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরো কম ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।

২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবেচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ।

আর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাব-এর ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ ছিল কেবল এক শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিলো ১৭ শতাংশ।

বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ।

ধনীদের হাতে শহুরে ভূমির পরিমাণ বেশি

পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচাক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, তিনিটি কারণে এই আয় এবং ভোগ বৈষম্য বেড়েছে।

১. ধনীদের হাতে শহুরে ভূমির পরিমাণ বেশি। প্রতিবছরই এই জমির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আর তারা এই জমি ফেলে রাখছেন। ফলে কোনা বিনিয়োগ ছাড়াই তাদের আয় বাড়ছে।

২. নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এই সব পণ্য ব্যবসা আবার পাইকাারি ও আমদানি পর্যায়ে কিছু লোকের হাতে। ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ার সঙ্গে তাদের আয়ও হু হু করে বাড়ছে।

৩. যারা যত ধনী তারা তত বেশি কর ফাঁকি দেয়। তাদের কাছ থেকে কর আদায় করা যাচ্ছেনা।

“এর ফলে ধনী আরো ধনী হচ্ছে। যাদের আয় কম তাদের সম্পদে প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে। ফলে যারা গরিব তারা আরো গরিব হচ্ছে। এটা একটা অসম অর্থনৈতিক অগ্রগতি। দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। তাই জমির ফেলে না রাখার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেলে রাখলে ট্যাক্স বেশি  দিতে হবে। আর ট্যাক্স আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা ট্যাক্স দেয়ার যোগ্য তাদের পুরো ট্যাক্স আদায় করতে হবে। তাহলে আয় বৈষম্য কমবে। স্বল্প আয়ের মানুষের সম্পদে প্রবেশাধিকার বাড়বে,” বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

 

ভোগ বৈষম্যের কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং সেই অনুযায়ী আয় না বাড়া। আহসান এইচ মনসুর মনে করেন,” তবে যারা ভোগ করছে তারা করুক। তাদের ভোগে আরো উৎসাহিত করা দরকার। এতে অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে। ভোগে বাধা দিলে তারা তো  দেশের টাকা নিয়ে বিদেশে ভোগ করবেন।”

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যয়বহুল

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন,” আয় বৃদ্ধির সঙ্গে যদি আয় বৈষম্য বেড়ে যায় তাহলে ফসলটা  সমাজের উচ্চ বিত্তদের হাতে চলে যায়। সাধারণ মানুষ এর সুফল পায়না। দেশে এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন ব্যয়বহুল হয়ে গেছে এবং তারা কষ্ট পাচ্ছে।”

তার কথায়,” জিনি সহগ ০.৫ হলে সেদেশকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ বলা হয়। আমাদের এখানেও তো এটা তো প্রায় ০.৫ হয়ে গেছে। ফলে  আমাদের দেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। এর ফলে একদিকে নিম্ন আয়ের মানুষ বাড়বে, অন্যদিকে উচ্চ আয়ের মানুষের আয় আরো বাড়বে। এটা অব্যাহত থাকলে কোটিপতি বাড়তে থাকবে। শুধু ধনীরাই যদি সরকার চালায় তাহলে এই অবস্থাই হবে।”

তিনি বলেন,” এ থেকে বেরিয়ে আসার অনেক মডেল আছে। কেরালা মডেল তার একটি। শিক্ষার অধিকারে বৈষম্য কমাতে হবে, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। আরো অনেক ব্যবস্থা আছে।”

দুইজন অর্থনীবিদই মনে করেন, গড় আয় দিয়ে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায়না। কারণ গড় আয় দিয়ে কার কত আয় তা বোঝা যায়না।

# হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে, ঢাকা