বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৯১): নববর্ষ

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আজ ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষ। অবাক হচ্ছেন কেন ১৪ এপ্রিল বলছি, পয়লা বৈশাখ বলছি না? আসলে বিগত কয়েক বছর হল খেয়াল করেছি আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের মাটি একটু একটু করে ছেড়ে দিচ্ছি। ফলে বাংলা পঞ্জিকায় যে ফ্লেক্সিবিলিটি ছিল সেটা আমরা ধরে রাখিনি। ১৪ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ বানিয়েছি। যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা পঞ্জিকার ব্যবহার থাকত তাহলে হয়তো এর পেছনে একটা যুক্তি থাকত, কিন্তু যেহেতু বাংলা পঞ্জিকা মূলত ব্যবহার করা হয় পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, এগারোই জ্যৈষ্ঠ, বাইশে শ্রাবণ আর হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন পার্বণ বা সামাজিক রীতিনীতি যেমন বিয়ে ইত্যাদি পালন করার জন্য, ১৪ এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ না বানালে খুব একটা ক্ষতি হত না। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা যখন পঞ্জিকা পরিবর্তন করেন তিনি হয়তো ভেবেছিলেন এই পঞ্জিকা ধরেই সরকারি কাজকর্ম চলবে, কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। এ নিয়ে আগে লিখেছি, তাই নতুন করে পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটতে যাব না। আজকের লেখার মূল কারণ পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে এক আইনজীবীর রিট আবেদন নিয়ে।

যদিও বর্তমানে শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে রিট আবেদন করা হয়েছে কিন্তু একথা সত্য যে পঁচাত্তরের পর থেকেই আর বিশেষ করে বর্তমান সরকার হেফাজতে ইসলামীর সাথে আপোষ করার পর থেকেই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির উপর এক শ্রেণীর মানুষের আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। আর সেটা করতে গিয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এসবকে হিন্দুদের সংস্কৃতি বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে, হচ্ছে। যেখানে এই ধরণের লোকজন পারলে হিন্দুদের ভিটে ছাড়া, দেশছাড়া করতে এক পায়ে খাঁড়া, তাদের এভাবে পুরা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি বিনা শর্তে হিন্দুদের নামে উইল করে দেবার প্রচেষ্টা খুবই সন্দেহজনক। কারণ ভারত বিভাগের পর সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান প্রথমে এই ভাষার উপরই আঘাত হেনেছিল আর সেটা করেছিল বাংলা ভাষায় হিন্দুয়ানীর গন্ধ আছে এই ধোঁয়া তুলে। বাংলার দোষ একটাই – এটা একান্তই স্থানীয় ভাষা, এদেশের জলবায়ুতে জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা। উর্দু হিন্দির অনেক কাছাকাছি হলেও সেটা ছিল আরব ও পারস্য থেকে আমদানিকৃত, আরবী হরফে লিখিত। দেশ ভাগের মূল কথাই ছিল শুধু হিন্দুদের থেকে আলাদা হওয়া নয়, যা কিছু স্থানীয়, যা কিছুর উৎস এই ভারতবর্ষ তা থেকে নিজেদের আলাদা করা, এমনকি দীর্ঘদিন মুসলিম শাসকগণ ভারত শাসন করে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে তোলার পরেও সেই উত্তরাধিকার অস্বীকার করা। যেহেতু বাংলা ছিল পাণ্ডব বর্জিত, ভারতের পশ্চিম সীমান্ত থেকে বহু দূরে, তাই এই এলাকা কখনই ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না ইংরেজ এই বাংলা থেকেই ভারত বিজয় শুরু করে আর দিল্লির পরিবর্তে কোলকাতাকে ভারতের রাজধানী করে, যদিও গত শতকের গোঁড়ার দিকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলে কোলকাতা আগের গুরুত্ব হারায়। যাহোক, কথা হচ্ছিল বাংলা ভাষার উপর আঘাত নিয়ে আর যেটা সত্য তা হল সেটার শুরু আজ নয়, অনেক আগেই। তাই আজ যারা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির উপর আঘাত হানছে তারা আসলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উত্তরসূরি যিনি চালাকি করে স্টেটস এর পরিবর্তে স্টেট লিখে বলতে গেলে ষড়যন্ত্র করেই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেন।

কিছুদিন আগে এক পাকিস্তানি সিনিয়র বন্ধুর সাথে যোগাযোগ হয়েছিল। ভাষা নিয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম
পাঞ্জাবী সাহিত্য এক সময় খুব উন্নত ছিল। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবার পর পাঞ্জাবী ভাষা কি আগের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে? পাকিস্তানের অন্যান্য ভাষার কী অবস্থা?
দেখ, এই ভাষা প্রশ্নেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। তখন তোমরা বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানে সেটা সম্ভব হয়নি। এর ফলে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে সব দিক থেকেই। তবে বিগত কয়েক দশকে অন্যান্য ভাষা নিজেদের মর্যাদা ফিরে পেয়েছে। এমনকি অন্যান্য প্রদেশের নিয়ম কানুন এখন শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবির চেয়েও প্রগতিশীল, মানে তারচেয়ে বেশি স্বায়ত্বশাসন এসব প্রদেশ পেয়েছে। কিন্তু পাঞ্জাব সম্পর্কে সেটা বলা যাবে না। কারণ ভারত বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ থেকে আগত মুসলিম এলিট আর পাঞ্জাবীরা উর্দুকে সামনে নিয়ে এসেছে, ফলে পাঞ্জাবী ভাষা ও সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইদানীং চেষ্টা চলছে পাঞ্জাবি ভাষাকে স্কুলে ফিরিয়ে আনার। ভারতীয় পাঞ্জাবীদের আমরা বুঝলেও তাদের লেখা পড়তে পারি না, কারণ ওরা লেখে দেবনগরী হরফে, আমরা আরবিতে।

যার সাথে কথা বলছিলাম তিনি পাকিস্তানের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। এখানে দুটো জিনিস স্পষ্ট। মাতৃভাষা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা পাকিস্তানে বুঝতে শুরু করেছে আর একই সাথে একাত্তর পূর্ববর্তী ভুল থেকে শিক্ষা নিতে শুরু করেছে। এছাড়া খোদ পাকিস্তানে আজ প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করা হয়। বিভিন্ন দিকে পিছিয়ে গেলেও ও রাজনৈতিক ভাবে প্রায় দেউলিয়া হলেও আমার মনে হয় সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ মাথা উঁচু করেই কথা বলেন, বলতে পারেন। ডন পত্রিকার বিভিন্ন সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় লেখার মান দেখে আমার সেটাই মনে হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে যারা পাকিস্তান চায় তারা এই স্বাধীনতা চায় না, তারা বরং চায় দুর্বল সরকার যাদের ইচ্ছে মত চালানো যায় আর সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা যায়। যে আইনজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে রিট আবেদন করে সে এই দলের লোক বলেই মনে হয়।

আমার মনে প্রায়ই একটা প্রশ্ন জাগে – তা হল বাংলা ভাষার প্রতি তাদের এই বৈরিতা কেন? এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। ২০১৪ সাল মনে হয়। মস্কো থেকে দেশে ফিরছিলাম। শারজায় ছিল ট্র্যানজিট। প্রায় পাঁচ ঘন্টা। সব জায়গায় লোকের ভিড়। বসায় জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে আছি। একজন ডেকে বসার জায়গা করে দিল। কথায় কথায় জানলাম এই গ্রুপের সবাই কাতারে কর্মরত শ্রমিক। আগে শারজায় ছিল। কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজনের জন্য ওদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বেতন কম। খাবার দাবারে সমস্যা। পাকিস্তানি, ভারতীয় আর বাংলাদেশিরা একসাথে থাকে, কাজ করে। কিন্তু সমস্যা খাবার নিয়ে। খেতে দেয় মূলত রুটি। আর এরা ভাত ছাড়া থাকতে পারে না। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা। তাই সবাইকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। গল্পটা এজন্যেই বলা যে চাইলেই ভাষা সংস্কৃতি এসব ত্যাগ করা যায় না, যেমন ত্যাগ করা যায় না খাদ্যাভ্যাস। যারা ভাষা, সংস্কৃতি এসব ত্যাগ করতে চায় এদের তার আগে কয়েক মাস যা কিছু স্থানীয় সব কিছুই ত্যাগ করার চেষ্টা করে দেখা উচিৎ। যদিও অনেকেই বলার চেষ্টা করে ধর্ম হল সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, সত্যটা হচ্ছে সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হল সংস্কৃতি – সেটা শুধু ভাষা বা সাহিত্য বা শিল্প নয়, সেটা খাদ্যাভ্যাস, চলন বলন, জীবনের খুঁটিনাটি সব।

যারা মনে করে চাইলেই ভাষা ত্যাগ করা যায় তাদের বলি, কয়েক মাস বাংলা না বলে বাংলাদেশে চলার চেষ্টা করেন। যদি ভাবেন দুই দিনেই সবাই উর্দু বা আরবি শিখে যাবে তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। শুধু তাই নয়, যারা আরবির কথা বলেন চেষ্টা করে দেখেন তো আরব দেশে গিয়ে সেই আরবি ব্যবহার করে দিন কাটাতে। বইয়ের ভাষা আর জীবনের ভাষা একেবারেই ভিন্ন। বিভিন্ন দেশের মানুষের বিভিন্ন ধরণের আক্সেন্ট থাকে। আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ ভাষা শিখতাম বিভিন্ন দেশের ছেলেমেয়ে বিভিন্ন আক্সেন্টে কথা বলত। আর এই আক্সেন্টের কারণে অনেক বিদেশী শব্দ একেবারে ভিন্ন অর্থ বোঝাতে পারে। মনে করার কারণ নেই যে আরবিতে খারাপ শব্দ নেই, সেদেশের লোকজন ঝগড়া বিবাদ করে না। তাছাড়া বাংলা ত্যাগ করা মানে শুধু ভাষা ত্যাগ করা নয়, জীবনের সব কিছু বদলানো। এটা তিন তালাক দেবার মত নয়, অনেক দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া। কয়েক দিন আগে একটা রিপোর্ট দেখলাম গোবিন্দ (বা ঐ রকম কিছু একটা) নামে এক গ্রামের উপর।  একসময় সেটা হিন্দু প্রধান গ্রাম ছিল, মূলত স্বর্ণের কাজ করত। এখন প্রায় ৩০ হাজার মানুষের এই গ্রামে কোন হিন্দু নেই, এমনকি তারা গ্রামের নাম বদলিয়ে ফেলেছে, কিন্তু কাগজে কলমে গোবিন্দ নাম রয়ে গেছে। কারণ হাজার হাজার পুরানো দলিল তার সাথে জড়িত। সেটা করতে গেলে তাই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। ভাষাটা মুখের ডগায় মনে হলেও সেটা আরও গভীরে। এখন দেখুনতো ভাষা বাদ দিতে হলে বাংলাদেশের ৬৬ হাজার গ্রামের অর্ধেকের বেশির নাম বদলয়াতে হবে, বদলাতে হবে গাছপালা, নদী নালা, পশুপাশি – অর্থাৎ যা কিছু দেখছেন সব কিছুর নাম। আপনি কি সেটা করতে রাজি? কিসের জন্যে? সেটা করলে একদিনে আপনার সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে, এতদিন যা কিছু জানতেন সব ভুল হয়ে যাবে। এটা অনেকটা টাকা অচল করে দেবার মত। লাখ লাখ টাকার মালিক, অথচ ঘুম থেকে উঠে দেখলেম – সব অচল টাকা। তাছাড়া ঐ গ্রামবাসীরাই বলল, স্বর্ণের কাজে খাঁদ ব্যবহার করা হয় যেটা হারাম। তাই ওটা করে হিন্দুরা। এরকম অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে জীবনে যা হামার। সেগুলো কে করবে ভেবে দেখেছেন?

আচ্ছা, কেন বাংলার প্রতি এই বিদ্বেষ? এটা কি শুধু অতীতকে অস্বীকার করার জন্য, এদের অনেকেই যে এক সময় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিল সেই দাগ মুছে ফেলার জন্য? মনে হয় না। কারণ একজন শিশুর ইতিহাস তার জন্মের সাথে শুরু হয় না, শুরু হয় আরও নয় মাস আগে। আর সত্য কথা হল তার বাবা, মা ও অন্যান্য পূর্বপুরুষের ইতিহাস থেকে। ধর্ম বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্ম বা রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়, তবে সেটার থাকে পূর্ব কথা। যদি হিন্দু ধর্মের কথাই বলি, আর্যরা এ দেশে আসার আগে স্থানীয় ধর্মবিশ্বাস ছিল আর আর্যরা সেই ধর্মবিশ্বাসের অনেক কিছুই গ্রহণ করেছিল। যদি ইসলামের কথা বলি তাহলে তারাও ইহুদী ও খ্রিস্টান ধর্মের অনেক রীতিনীতি গ্রহণ করেছে। মানে কোন কিছুই শূন্য থেকে আসেনি, প্রতিটি আগমনের পেছনে পটভূমি ছিল। তাই ইতিহাস হয়তো যে ভাবে খুশি সে ভাবে লেখা যায় কিন্তু তাই বলে বাস্তবতা বদলানো যায় না। আরবের ইসলাম যদি প্রাকইসলামী যুগের অনেক কিছুই গ্রহণ করতে পারে, আমাদের দেশে কেন পারে না? এই যে আমরা ইসলামি নাম বলি সেটা তো আসলে আরব নাম। আরবি ভাষা ইসলামের আগেও ছিল, নাম ছিল। এমনকি কাবা শরিফের কালো পাথর – সেটাও আগে ছিল। তারা যদি অনায়াসে সেসব গ্রহণ করতে পারে আমাদের কি সমস্যা বাংলা নাম গ্রহণ করতে। ধর্ম তো নামে নয়, ধর্ম মানুষের ব্যবহারে, তার হৃদয়ে। তার পরেও তারা বাংলাকে মেনে নিতে পারে না। পারে না কারণ তারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের ভাগ হয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে না। আর যেহেতু ভাষা প্রশ্নে মতবিরোধ থেকেই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্ম তাই তারা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না। যেভাবে পারে সেভাবেই ভাষার উপর আক্রমণ করে। আক্রমণ করে সংস্কৃতির উপর।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ থেকে দেখি আরবের, বিশেষ করে সৌদি আরবের লোকজন বাংলাদেশের সহি মুসলমান বলে মনে করে না। কারণ কি তারা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বলে? ইন্দনেশিয়ার লোকজনও তো ধর্মান্তরিত। সেই অর্থে যেহেতু ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে ইসলামের আগমন সবার পরে তাই বলা যায় প্রাকইসলামী যুগে এদের পূর্বসূরিরা অন্য কোন না কোন ধর্মের অনুসারি ছিল। কিন্তু ইন্দনেশিয়া বা অন্য কোন দেশের ইসলাম নিয়ে আরবদের বিরূপ মন্তব্য করতে শুনিনি। কারণ মনে হয় এরা নিজেদের অতীত নিয়ে হীনমন্যতা বোধ করে না। ইন্দনেশিয়ার লোকজন এখনও গর্বের সাথে স্থানীয় নাম রাখে, সেদেশের প্রাকইসলামী সংস্কৃতি রক্ষা করে। আর যে লোক বা যে জাতি নিজের অতীতকে শ্রদ্ধা করে, অন্যেরাও তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

ছাত্র জীবনে শতাধিক দেশের ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে, সুযোগ হয়েছে কাছ থেকে তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার। যে উলুধ্বনি দেশে অনেকের অনুভূতিতে আঘাত হানে আরবের মেয়েরা অবলীলায় সেই উলুধ্বনি দেয়। তারাও গান গায়, নাচে। আজকাল ইউটিউবে তো সেসবের ছড়াছড়ি। তাই নিজেদের সহি মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিজের সংস্কৃতি ত্যাগ করার দরকার নেই, বরং সেটাকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন, সেটাকে বিকশিত করতে শিখুন। এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুরি বলা হত। বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এখন আর কেউ সেটা বলে না, বরং বাংলাদেশকে আদর্শ মনে করে। যদি সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রেও সেভাবে উন্নত হতে পারেন দেখবেন তখন কেউ আপনার ধর্ম নিয়ে কিছু বলবে না। যদি ভালো মানুষ হতে পারেন অটোম্যাটিক্যালি ভালো হিন্দু, ভালো মুসলমান, ভাল বৌদ্ধ, ভালো খ্রিস্টান এসব হবেন।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সরকার যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহ নববর্ষ পালনের জন্য দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এটা অবশ্যই সুখের খবর, তবে যে বা যারা এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে যদি এখনই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া না হয় সেই দিন বেশি দূরে নেই যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সত্যিই নিষেধাজ্ঞা নেমে আসবে। তখন শুধু আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়, এমনকি ধর্মও সংকটের সম্মুখীন হবে, কারণ প্রতিটি দেশে প্রতিটি ধর্মের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য থাকে, তা হারানো মানে ধর্মকেও বিপন্ন করা। ভয়ভীতি দেখিতে মহান হওয়া যায় না, মহৎ হতে হলে মহত্ব দেখাতে হয়। নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই তাই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পাশে দাঁড়ানো এখন আপনার কর্তব্য।

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা!

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া