শিল্প সাহিত্য

পহেলা বৈশাখ : বিশ্ব বাঙালির আন্তর্জাতিক উৎসব

-সুভাষ দে

সুভাষ দে (ফাইল ছবি)

এক সময় পয়লা বৈশাখ কিংবা চৈত্র সংক্রান্তি আমাদের গ্রামীণ জীবনের এক তোলপাড় করা অনুষঙ্গ ছিলো। চৈত্র সংক্রান্তির আচার অনুষ্ঠান প্রধানত হিন্দু বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে পার্বত্য জনপদের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে হালখাতা গ্রাম শহরে বৈশাখের অর্থাৎ নতুন বছরের প্রারম্ভে নানাভাবে প্রচলিত ছিলো প্রধানত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে।
গ্রামে আমাদের ছোটবেলায় চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন ফুলবিসু উৎসবে আমরা বিপুল আনন্দে অংশগ্রহণ করেছি। বাড়িঘর, আঙিনা নতুনভাবে সাজানো-নিকানো হতো, নতুন জামা কাপড়ের গন্ধ শুকে নিতাম যদিও সেটি পহেলা বৈশাখের জন্য অর্থাৎ নতুন বছরের প্রথম দিনের জন্য বরাদ্দ ছিলো। বড়রা যারা শহরে কিংবা গঞ্জে ব্যবসা, চাকরি উপলক্ষে অবস্থান করতেন তাঁরাও এ সময় কয়েকদিনের জন্য বাড়ি চলে আসতেন ।
চৈত্র সংক্রান্তি কিংবা পয়লা বৈশাখের আনন্দ গ্রামীণ লোকজীবনের সকল সম্প্রদায়কে স্পর্শ করতো। একটি অঞ্চলের সকল ধর্ম-গোত্রের মানুষ এই কয়েকটি দিন অন্যরকম এক সামাজিক ও মানবিক সম্মিলনীতে অংশগ্রহণ করতেন। গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় মেলা, কুটির শিল্পের সমাহার, গ্রামীণ খেলাধূলা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বিশেষ করে লোকজ সংস্কৃতির নানা আয়োজন এতে যুক্ত থাকতো। একটি নির্মল আনন্দের আবহ ঘিরে রাখতো সব ধর্মের মানুষদের, সামাজিক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল স্মারক অনেকদিন পর্যন্ত গ্রামের মানুষদের আলোড়িত করে রাখতো ।
পহেলা বৈশাখ ক্রমান্বয়ে লোকজীবন কিংবা গ্রামীণ আবহ ছাড়িয়ে বিগত শতকের চল্লিশ পঞ্চাশ দশকে পূর্ব বাংলার শহরের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। পাকিস্তানোত্তর পূর্ব বাংলায় যখন বাঙালি দ্বিজাতিতত্তের খোলস ছেড়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তার দিকে তাকালো এবং এক সময় পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র নজরুল জন্মজয়ন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছায়ানটের বর্ষবরণ বাঙালির মর্মমূলে নাড়া দিতে শুরু করলো এবং বাঙালি এই সময়ে সগৌরবে, বিস্ময়ে, নান্দনিকতায় চিনলো তার শেকড়ের শাখা প্রশাখাগুলো। নিজেদের জানলো, দেখলো নতুন করে এবং এই চেনা-জানা বাঙালিকে তার স্বাধীনতার ঠিকানায়, স্বতন্ত্র অস্তিত্বের ঠিকানায় নিয়ে গেলো। এভাবে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের চেতনায় প্রোথিত হয়ে গেলো ।
পহেলা বৈশাখ এখন গ্রাম-জীবনের মতো নগর-জীবনেও সামাজিক সম্প্রীতির বার্তাবহ। এই একটি দিন যা জাতি ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষকে রাখিবন্ধনে আবদ্ধ করেছে। বলা যেতে পারে আমাদের অসম্পূর্ণ রেনেসাঁয় পয়লা বৈশাখ নব জাগরণের বার্তা এনেছে। গ্রামে যেমন, তেমনি শহরেও নববর্ষ উদযাপন শত আয়োজনে, শত সমারোহে জাতীয় জীবনের বিপুল উদ্ভাসনকেই মেলে ধরেছে প্রতিবছর। গ্রামের নানা খেলনা, মিষ্টি, গ্রামীণ কুটির শিল্প নিয়ে মেলা এখন শহরে।
ছেলেমেয়ের হাত ধরে মা বাবা, স্বজন পরিজন- শত দুঃখ অভাব মলিনতার মাঝেও এদিন উজ্জ্বল। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমঅংশীদারিত্বে সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- এই ধরনের মানব সম্মিলনী মানুষকে ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে নিয়ে যায়, সকল হীনমন্যতা ছাপিয়ে সকলের সাথে নিজের অনুভূতি ভাগ করে নিতেই আনন্দ ।
পহেলা বৈশাখ, বর্ষ বিদায়, নববর্ষ যে ভাবেই আবাহন করি না কেন তা আজ বিশ্ব বাঙালির আন্তর্জাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। উপমহাদেশে বাংলা ভাষাভাষী তো বটেই, নববর্ষের আয়োজন ইউরোপ, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায়, এশিয়ার নানা দেশে এমন কি মধ্যপ্রাচ্যেও বাঙালির হৃদয়ে আবেগের কাঁপন ধরায়। এই দিন বিশ্ব বাঙালি অন্য এক মহিমায় মানবিক সম্প্রীতির প্রসারণ ঘটায়।
বলা যায় রবীন্দ্রনাথ যেমন বিশ্ব বাঙালি সংস্কৃতির সেতুবন্ধ তেমনি নববর্ষ কিংবা পহেলা বৈশাখ আজ বাঙালির আন্তর্জাতিক সম্মিলনী ও উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ যে বাঙালির কত বড় পাওয়ার আনন্দ; নানারূপে, নানা বর্ণে, নানা অনুভূতিতে পরস্পরকে জড়িয়ে রাখার মহা-সাংস্কৃতিক-উৎসব তা বিশ্বের নানা প্রান্তের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি অনুভব করছে।
জীবনানন্দের কথায় বলি,
‘আরো নব সূর্যে দীপ্ত হয়ে প্রাণ দাও-
প্রাণ দাও পাখি
নববর্ষে এই হোক সম্মিলিত প্রার্থনা।’
লেখক : সাংবাদিক