চলমান সংবাদ

“কাজ না দিয়ে গেইমের পথে যেতে চাপ দেয়া হচ্ছে”

ফাইল ছবি ) রোমানিয়ায় একদল অভিবাসী ছবিঃ পিকচার এলায়েন্স/মাইকেল বুনেল

গত বছরের মতো ২০২৩ সালেও কাজের ভিসা নিয়ে রোমানিয়া আসছেন বাংলাদেশিরা৷ আরো অনেক বাংলাদেশির মতো চাকরির স্বপ্ন নিয়ে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় রাজধানী বুখারেস্টে আসেন অভিবাসী ফারুক। মার্চে এসেছেন তিনি৷ এর মধ্যেই বুঝতে পেরেছেন প্রতারক কোম্পানির ফাঁদে পড়েছেন তিনি৷ চাকরি তো দূরের কথা, অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দিতে চাপ দেয়া হচ্ছে তাকে। বিস্তারিত পড়ুন সাক্ষাৎকারে।

২০২২ সালের মধ্যভাগ থেকে অনিয়মিত পথে রোমানিয়া থেকে শেঙেন সীমান্ত ঢুকতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয়ে নিয়মিত সংবাদের শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশিরা।

আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে ছোট ভাই ফারুককে আট লাখ টাকার চুক্তিতে রোমানিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন বড় ভাই আজিজ। এ লক্ষ্যে তিনি ঢাকার এক এজেন্টের সঙ্গে যথাযথ নিয়মে কাজ শুরু করেন। নিজের ভাইকে বিদেশে পাঠাতে জমানো সব টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি ও তার পরিবার।

আজিজ ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, “শেঙেনভুক্ত দেশগুলোতে স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া কাজের ভিসায় পাঠাতে ১৪/১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করে বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো। যার কারণে আমি আমার ভাইকে রোমানিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”

আজিজ তার ভাই ফারুকের জন্য একটি এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন৷ তারা জানিয়েছিলেন রোমানিয়ায় গিয়ে ফারুককে রেস্তোরাঁ অথবা ফুড প্যাকেজিং সেক্টরে কাজ দেয়া হবে।

ভিসার সব প্রক্রিয়া শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী পুরো টাকা পরিশোধ করেন তিনি। মার্চে ওই এজেন্সি থেকে ভিসা পাওয়া আরও ছয় জনের সঙ্গে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টের উদ্দেশে যাত্রা করেন ফারুক।

মিল নেই কথায় ও কাজে

রোমানিয়া পৌঁছানোর পর কোম্পানির নির্ধারিত থাকার জায়গায় নিয়ে আসা হয় ফারুককে। আর সেটি ছিল একটি অনানুষ্ঠানিক আশ্রয় শিবিরের মতো৷ আর সেখানে প্রতিটি কক্ষে ছয় থেকে সাত জন করে অভিবাসীর থাকার জায়গার ব্যবস্থা রয়েছে।

রোমানিয়ার সিবিউ শহরে একটি কারখানার ড্রেন পরিষ্কার করছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা।ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস।
রোমানিয়ার সিবিউ শহরে একটি কারখানার ড্রেন পরিষ্কার করছেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা।ছবি: ইনফোমাইগ্রেন্টস।

ফারুক ইনফোমাইগ্রেন্টসকে বলেন, “আসার পরে নিম্ন মানের থাকার জায়গা দেখে হতাশ হই। কোম্পানির নিয়োগ করা বাংলাদেশিরা আমাদের এখানকার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। তারা আমাদের খাবার দেয়৷ কিন্তু খাবারের মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। ডাল, আলু ভর্তা, সবজি এবং এক প্রকার মুরগির হাড় দেয়া হয় প্রায় সময়।”

তিনি ব্যখ্যা করেন, “রোমানিয়ায় আসার কয়েকদিন পরে আমাকে একটু কাঠের ফ্যাক্টরিতে কাজে পাঠানো হয়। অথচ আমার কাজের চুক্তি এবং বারবার আলোচনায় বলা হয়েছিল রেস্তোরাঁ অথবা ফুড প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে কাজ দেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখি সেটি আলোচনার পুরোপুরি বিপরীত।”

তবুও উপায় না দেখে কোম্পানির কথা অনুযায়ী কাঠের ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলেন ফারুক। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পান এটি পুরোপুরো একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রী বা কার্পেন্টারের কাজ। যেটি তার মতো একজন ব্যক্তির দ্বারা অসম্ভব। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে সেটি কোম্পানিকে জানান।

ফারুক পরবর্তীতে রোমানিয়ায় স্থায়ী হয়েছেন এমন বাংলাদেশিদের কাছে জানতে পারেন আসলে তিনি যেই কোম্পানিতে এসেছেন এটি এক প্রকার সাপ্লাই কোম্পানি। যারা তৃতীয় পক্ষ হয়ে কাজ করেন। যার ফলে এসব কোম্পানি সরাসরি অভিবাসীদের কাজ দিতে পারে না। তারা মূলত কর্মী সরবরাহ করে।”

তিনি যোগ করেন,

অনেক বাংলাদেশিরা না বুঝে গেইম বা অবৈধ উপায়ে শেঙেন সীমান্তে চলে যান। এই কোম্পানিগুলো এটি জানে। তারা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশি এজেন্টদের যোগসাজশে রমরমা ব্যবসা করছে। এটি একটি চক্র।

তার মতে, “রোমানিয়ায় আসার পর যারা আমার মতো বৈধভাবে কাজ করতে চান তাদেরকেও টাকার বিনিময়ে গেইমের পথে যেতে চাপ দেয়া হয়। আমাকে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে অতিরিক্ত তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা দেয়া হলে আমাকে লরিতে করে ইটালি পৌঁছে দেয়া হবে। তারা আমার সুবিধা অনুযায়ী কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না।”

“বৈধভাবে রোমানিয়ায় থাকতে চাই”

ফারুকের ভাই আজিজ* বলেন, “আমি অনেকদিন ধরে ইনফোমাইগ্রেন্টসের ফেসবুক পাতায় অনিয়মিত অভিবাসনের ঝুঁকি নিয়ে করা বিভিন্ন সংবাদ পড়ে আসছি। এ কারণে আমার ভাই রোমানিয়ায় যাওয়ার আগেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সে সেখানেই থাকবে ও কাজ করবে। অনেকের মতো অনিয়মিত পথে যাওয়ার ঝুঁকি নিবে না।”

অপরদিকে ফারুক* ব্যাখ্যা করেন, “রোমানিয়ায় ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আসা ব্যক্তিরা কোম্পানি পরিবর্তন করতে চাইলে অন্য একটি কাজ যোগাড় করতে বর্তমান নিয়োগকর্তা থেকে একটি এনওসি বা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে হয়। আমি নতুন আসায় আরেকটি কাজ দ্রুত যোগাড় করাও বেশ জটিল।”

তিনি আরও বলেন, “তারপরও আমি আমার বর্তমান সাপ্লাই কোম্পানির কাছে এনওসি দিবে কীনা জানতে চেয়েছিলাম। তারা এটির জন্যেও আবার টাকা দাবি করছে। এত টাকা খরচ করে এসে আমার পরিবার আমাকে আবারও টাকা পাঠানোর কোন পরিস্থিতি নেই।

আমাকে বারবার দেশ থেকে টাকা এনে গেইমের পথে যেতে মানসিক চাপ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি ও আমার পরিবার চায়না আমি অনিয়মিত পথে কোথাও যাত্রা করি। আমি এখানে একজন বৈধ অভিবাসী হিসেবে থাকতে চাই।

মূলত ‘গেইম’ মানে অনিয়মিত উপায়ে ইউরোপের পথে স্থল কিংবা জলপথ পাড়ি দেয়া। অভিবাসীরা অনেক সময় নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করলেও প্রায়শই মানবপাচারকারীদের সহায়তা নিতে বাধ্য হন।

ফারুকসহ তারা সঙ্গে থাকা আরও অনেকেই বর্তমানে একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন। ভবিষ্যতে কাজের ভিসায় রোমানিয়া আসবেন এমন ব্যক্তিদের তাদের কোম্পানি সম্পর্কে শতভাগ জেনে আসার পরিমার্শ দিয়েছেন এই ভুক্তভোগী। ঢাকা, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরে থাকা এজেন্টরা প্রায়শই বাংলাদেশি অভিবাসীদের হোটেল সেক্টরে কাজের কথা বলেন৷ কিন্তু রোমানিয়ায় এসে দেখা যায় এগুলো বেশিরভাগই সাপ্লাই অথবা নির্মাণখাত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি।

(ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)

# মোহাম্মদ আরিফ উল্লাহ

এমএইউ/টিএম