মতামত

গর্ভপাত অতঃপর চাকুরিচ্যুতি, পায়নি বকেয়া মজুরি

-ফজলুল কবির মিন্টু

সম্প্রতি আফরোজা শারমিন নামের একজন নারী শ্রমিক আমার কাছে এসে জানাল সে বায়েজিদ থানাধীন ড্রাগনি ফ্যাশন নামের একটি পোশাক কারখানায় স্যুইং অপারেটর হিসাবে চাকরি করতো। প্রায় এক বছর পূর্বে অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তার গর্ভপাত ঘটে। গর্ভপাত পরবর্তী কিছুদিন উক্ত শ্রমিক কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিল। পরে সে সুস্থ্য বোধ করলে কাজে যোগ দিতে যায়। তখন মালিক পক্ষ তাকে কাজে যোগদানে বাধা প্রদান করে। শ্রমিক হতাশ হয়ে বাসায় চলে যায়। উল্লেখ্য গর্ভপাত ঘটার আগ পর্যন্ত শ্রমিক ২২ দিন কাজ করেছিল। তাকে উক্ত ২২ দিনের মজুরিও দেয়া হয়নি। ভুক্তভোগী শ্রমিক কেবল ২২ দিনের মজুরিই চেয়েছিল। যদিও এই বিষয়টি টার্মিনেশনের পর্যায়ে পড়ে। শ্রমিকের বক্তব্য হচ্ছে, “আমি পেটে বাচ্চা নিয়ে কাজ করেছি। যদি কাজ না করতাম তাহলে হয়তো আমার বাচ্চাটা নষ্ট হতো না। এখন আমি বাচ্চাও হারালাম অন্যদিকে মজুরিও পাচ্ছি না”।

অতঃপর শ্রমিক বকেয়া মজুরি পাওয়ার জন্য মালিক পক্ষের সাথে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করেও বকেয়া মজুরি পায়নি। এক সময় সে হতাশ হয়ে টাকা পাওয়ার আশাই ছেড়ে দেয়। এরমধ্যে তার পরিচয় হয় একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা  দীপ্তি সরকারের সাথে।  দীপ্তি দি’র মাধ্যমেই ভুক্তভোগী শ্রমিকের সাথে আমার পরিচয় হয়। বিষয়টি জানার সাথে সাথে আমি প্রক্রিয়া শুরু করি। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে হটলাইনের মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করি। বিগত ৩০ মার্চ, ১২৪(ক) ধারায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে সালিশী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মালিক পক্ষ স্বীকার করে যে, শ্রমিকের সর্বশেষ চাকরির ২২ দিনের মজুরি দেয়া হয়নি। কিন্তু তাদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু অনুপস্থিতির দিন হতে শ্রমিক রিজাইন কার্যকর হয়েছে এবং যেহেতু শ্রমিক ২৭(১) ধারা অনুসারে ৬০ দিন পূর্বে রিজাইন নোটিশ দেয়নি সেহেতু মালিক শ্রমিকের নিকট হতে ৬০ দিনের মজুরি প্রাপ্য। সেই কারনে শ্রমিককে তার সর্বশেষ ২২ দিনের মজুরি প্রদান করা হয়নি। অর্থাৎ তারা সজ্ঞানে তার মজুরি প্রদান করেনি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মালিক পক্ষের বক্তব্য কি আইন সম্মত? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের শ্রম আইন ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা একটু ভালো করে লক্ষ করলে দেখবো, ২৭(১) ধারায় ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ প্রদান করে কোন স্থায়ী শ্রমিক রিজাইন করতে পারবে বলা হয়েছে আবার ২৭(৩) ধারায় নোটিশের পরিবর্তে নোটিশ মেয়াদের জন্য মজুরির সমপরিমান অর্থ মালিককে পরিশোধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ২৭(৩ক) ধারায় আবার বলা হয়েছে ২৭(৩) ধারায় যা কিছুই থাকুক না কেন বিনা নোটিশে বা বিনা অনুমতিতে ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত থাকলে মালিক ১০ দিন পরে ১০ দিনের সময় দিয়ে শ্রমিকের নিকট হতে অনুপস্থিতির কারন ব্যাখ্যা করতে এবং পুনরায় কাজে যোগদান করতে নোটিশ প্রদান করবেন। উক্ত সময়ের মধ্যে শ্রমিক চাকরিতে যোগদান না করলে বা অনুপস্থিতির ব্যাখ্যা প্রদান না করলে মালিক শ্রমিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরো ৭ দিন সময় দিয়ে দ্বিতীয় চিঠি প্রদান করবেন। তাতেও যদি শ্রমিক কাজে যোগদান বা আত্মপক্ষ সমর্থন না করেন তাহলে অনুপস্থিতির দিন হতে শ্রমিক চাকরি হতে ইস্তফা দিয়েছেন বলে গন্য হবে।

২৭(৩ক) ধারায় এর বাইরে আর কিছু উল্লেখ নাই এবং এই ধারায় শুরুতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে –“২৭(৩) ধারায় যা কিছুই থাকুক না কেন . . . . . . .” এর অর্থ ২৭(৩ক) যখন প্রয়োগ করা হবে তখন ২৭(৩) ধারায় যা কিছুই উল্লখ আছে তা বিবেচনায় নেয়া যাবে না। এটা খুবই পরিস্কার শ্রমিক ২৭(৩ক) ধারায় কোন শ্রমিকের চাকুরী ইস্তফা হয়ে গেলে তার নিকট হতে নোটশ পিরিয়ডের জন্য টাকা কর্তন করা যাবে না । এখানে ভুল বুঝাবুঝির কোন অবকাশ আছে বলে মনে হয় না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে মালিক পক্ষ ২২ দিনের মজুরি বকেয়া রয়েছে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করার পরও ভুক্তভোগী শ্রমিককে তার কাজের বকেয়া টাকা আদায় করা যায়নি।

এখানে মনে রাখতে হবে, প্রথমত একজন গর্ভবতী মা শ্রমিক গর্ভপাত করার পর তাকে চাকুরিচ্যুত করে তার প্রতি সীমাহীন অমানবিক এবং বেআইনি আচরন করা হয়েছে এবং চাকুরিচ্যুতির পর শ্রম আইন মোতাবেক চাকুরির ক্ষতিপূরন তো রয়েছেই, শ্রমিক সেই বিষয়গুলির দাবি না তুলে কেবল তার পারিশ্রমিক বাবদ ২২ দিন  বকেয়া মজুরি দাবী  করেছিল  সে টাকাও সে পায়নি। আরো স্পষ্ট করে বললে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর আদায় করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কারন সালিশী সভায় মালিক পক্ষ কোন লুকোচুরি না করেই সবার সামনেই স্বীকার করেছে আইন অনুসারে তারা শ্রমিকের ২২ দিনের পারিশ্রমিক দিচ্ছে না। সেখানে আমরা শ্রমিকের পক্ষে আইনের ব্যখ্যা দিয়েছি। কিন্তু সালিশী সভায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নীরবতা পালন করে পরোক্ষভাবে মালিক পক্ষকে শ্রমিককে বকেয়া পাওনা না দেয়ার সুবিধা করে দিলেন।

একজন অসহায় ভুক্তভোগী শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল। যে প্রত্যাশা নিয়ে সে আমার কাছে এসেছিল তা আমি আপাতত পূরন করতে পারিনি তবে হাল ছাড়িনি। লড়াই চলবে।

লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেদ্রীয় কমিটি