মতামত

কর্মক্ষেত্রে নারীর সম্ভ্রম সুরক্ষা প্রসঙ্গে

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৬ কোটির অধিক হলেও নারী শ্রমিকের সংখ্যা ২ কোটির কম অর্থাৎ নারী শ্রমিক মোট শ্রমজীবীর এক তৃতীয়াংশেরও কম। যদিও সর্বশেষ আদম শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন এবং পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন অর্থাৎ আনুপাতিক হারে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। এমনকি সর্বশেষ এইএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও দেখা যায় জিপিএ ফাইভ পাওয়া মোট ছাত্রীর সংখ্যা ৯৫ হাজার ৭২১ এবং ছাত্রের সংখ্যা ৮০ হাজার ৫৬১ জন। অর্থাৎ শিক্ষা ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে আছে। সুতরাং একটা বিষয় খুবই সুস্পষ্ট যে, আরো ব্যাপক নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে কিংবা বলা যেতে পারে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ব্যাপক সংখ্যক নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

কর্মক্ষেত্রে নারীর কম অংশগ্রহণের প্রধানতম কারনগুলো হচ্ছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কারের পাশাপাশি অনিরাপদ কর্মক্ষেত্র। বর্তমানে দেশে কর্মরত  নারী শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এবং গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে -যৌন হয়রানি সংক্রান্ত। হয়রানির শিকার অধিকাংশ নারী শ্রমিকদের অভিযোগ নিয়োগ কর্তা, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং পুরুষ সহকর্মীদের বিরুদ্ধে। সুতরাং কর্মকালীন পুরো সময় নারীদেরকে একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। এতে একদিকে নারী শ্রমিকদের মানসিক অশান্তি বাড়ে এবং অন্যদিকে তার কর্মদক্ষতাও হ্রাস পায়। প্রকারন্তরে যা দেশের অর্থনীতি ও শিল্পের জন্য ক্ষতিকর কারন হয়ে দাঁড়ায়। তাই দেশের অর্থনীতি এবং শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে নারী বান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা রাষ্ট্রের ও সমাজের দায়িত্ব।

সামাজিক দায়বদ্ধতার উপলদ্ধি থেকেই বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি বাদী হয়ে ৭ আগস্ট ২০০৮ সালে জনস্বার্থে একটি মামলা দায়ের করেন। ১৪ মে ২০০৯সালে মহামান্য হাইকোর্ট এ মামলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এক যুগান্তকরী রায় প্রদান করেন। রায়ে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মালিক ও নিয়োগকর্তার দায় দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা হয়। এছাড়া রায়ে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং অভিযোগের বিষয়ে মালিক বা নিয়োগকর্তার নিকট সুপারিশ পেশ করার জন্য একটি ৫ সদস্য বিশিষ্ট অভিযোগ কমিটি গঠন করতে বলা হয়। এতে আরো বলা হয়, জেন্ডার এবং যৌন হয়রানি বিষয়ে কাজ করে এমন কোন প্রতিষ্ঠান হতে ২ জন সদস্য কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।

আমরা লক্ষ করি, বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩৩২ ধারাতে উল্লেখ আছে কোন প্রতিষ্ঠানে কোন কাজে কোন মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে মর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ এমন কোন আচরণ করতে পারবেন না যা অশ্লীল বা অভদ্রজনোচিত বলে বিবেচিত হতে পারে, কিংবা যা উক্ত মহিলার শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী হতে পারে।

শ্রম আইনের উপরোক্ত ধারাটিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম বিধিমালার সংশোধনীতে ৩৬১ক বিধি নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে। যা হাইকোর্টের রায়ের অনুরূপ

উপরোক্ত বিধির উপবিধি ১ এ উল্লেখ করা হয়েছে –অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণ যেমন শারীরিক স্পর্শ বা অনুরূপ প্রচেষ্টা; প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা;  যৌন হয়রানী বা নিপীড়নমূলক উক্তি; যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ প্রস্তাব; পর্ণোগ্রাফি দেখানো; যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি; অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা বা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে কোন ব্যক্তির অলক্ষে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা; চিঠি,টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস বা বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোন কিছু লেখা; ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থির চিত্র বা ভিডিও চিত্র ধারণ করা; যৌন হয়রানির কারণে সাংস্কৃতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকতে বাধ্য করা;প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া বা চাপ প্রয়োগ করা; ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা ইত্যাদি যৌন হয়রানিমূলক কর্মকান্ড হিসাবে বিবেচিত হবে।

কিন্তু উপবিধি ২ এ কর্মক্ষেত্রে অন্যুন ৫ সদস্য বিশিষ্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে অভিযোগ তদারকির জন্য কমিটি গঠন করার কথা বলা হলেও হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখিত ২ জন সদস্য প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে । অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে কমিটিতে সদস্য অন্তর্ভূক্ত করা যাবে কিনা সেইব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি। এতে কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হতে পারে।  অতিত অভিজ্ঞতায় আমরা বলতে পারি, বেশীরভাগ কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন বা হয়রানীর অভিযোগ প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ক্ষমতাধর উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় ফলে বাইরে থেকে কোন সদস্য অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্য হতে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত অভিযোগ তদারকি কমিটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

শ্রম আইনের ৩৩২ ধারার সমর্থনে বিধিমালায় নতুন সংযোজিত বিধি ৩৬১ক এর মাধ্যমে কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনী বিষয়টির বিস্তারিত ধারণা পাওয়া গেলেও তা পরিপূর্ণতা পায়নি বলেই আমি মনে করি কেননা  ৩৩২ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তির বিধান খুঁজতে গিয়ে ৩০৭ ধারা ছাড়া আর কোন বিধান পাওয়া যায়নি। ৩০৭ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের কথা উল্লেখ আছে। ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়নের সময় কারাদন্ডের বিধান ছিল কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সংশোধনীর সময় রহস্যজনক কারণে কারা দন্ডের বিধান বাদ দেয়া হয়েছে। অবশ্য অর্থদন্ডের পরিমান বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রমের মূল্য কি কখনো অর্থ দিয়ে পরিশোধ করা যায়? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষেই শ্রম আইনে ৩৩২ ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ ধারা। সুতরাং ধারাটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে এর লঙ্ঘণের দায়ে সুনির্দিষ্ট দন্ডের বিধান থাকাও খুব জরুরি।

এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ উল্লেখিত বিভিন্ন দন্ডের বিধান বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। যেমন উক্ত আইনের ৯ ধারায় ধর্ষনের দায়ে ধর্ষনকারীর মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডের কথা বলা হয়েছে।

ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও কোন কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া নারীদের জন্য খুব সহজ কোন ব্যাপার নয়। পদে পদে তাদেরকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখমুখি হতে হয়। তাই আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় যে সকল সাহসী নারীরা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে তারা একদিকে সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। নিঃসন্দেহে তারা সমাজ প্রগতির এক লড়াকু সৈনিক এবং পথ প্রদর্শক ও অগ্রদূত। তাদের ঘরে-বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। এই লক্ষে আইনের ধারা ৩৩২ এবং বিধিমালায় নতুন সংযুক্ত বিধি ৩৬১ক যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। শ্রম আইনের উক্ত ধারা এবং বিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়নে নারী ও শিশু দমন আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুনির্দিষ্ট দন্ডের বিধান শ্রম আইনে যুক্ত করার জন্য জোরালো দাবি জানাচ্ছি।

লেখকঃ সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র