বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৮৮):একুশের আয়নায় স্বদেশ

-বিজন সাহা  

গণতন্ত্র মানে শুধু জনগনের শাসন না, গণতন্ত্র মানে বিভিন্ন মতের ও পথের অবাধ বিকাশের সুযোগ, যদিও তা হতে হবে একটা নির্দিষ্ট অবকাঠামোর মধ্যে। আর যেকোনো দেশের জন্য সেই অবকাঠামো হচ্ছে দেশের সংবিধান। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের কোনো সরকারই বিরোধী দলগুলোকে গঠনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে অবাধে কাজ করার সুযোগ দেয়নি, আবার কোনো বিরোধী দলই (প্রধান বিরোধী দল) যেটুকুবা সুযোগ ছিল তাকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্রের ভিতকে পোক্ত না করে নেমেছে রাস্তায়, সর্বত ভাবে চেষ্টা করেছে গণতন্ত্রের ভিতটাকে আরো নড়বড়ে করে দেবার। যে হরতাল, অবরোধ একসময় ছিলো শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার, অতিব্যবহারে ও অপব্যবহারে তা হযেছে আজ সাধারণ মানুষ মারার অস্ত্র।

 

রাজনীতিতে বিশ্বাসঘাতকতা আজকে নতুন কিছু নয়। সেই জুলিয়াস সিজারের সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতকতা রাজনীতির সাথে পায়ে পায়ে চলছে। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে বাংলা তথা ভারতবর্ষে শুরু হয় ইংরেজ শাসন। আর ইংরেজদের কূটকৌশল আর মুসলিম লীগের ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ভেতর দিয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান। তা না হলে যে মুসলিম জনগোষ্ঠির জন্য পাকিস্তান তৈরী তাদের এক বিরাট অংশ ভারতে থেকে যাওয়ায় অবিভক্ত ভারতে মুসলিম হিসেবে তারা যে অধিকার লাভ করতে পারত, বিভক্ত ভারতে তাদের সেই অধিকার আর রইলো না। এ ব্যাপারে মওলানা আবুল কালাম আজাদ বার বার হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে পাকিস্তানের অবস্থা দেখলে মনে হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আসলে পাকিস্তানের জনগণের প্রতিই সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। আবার এই বিশ্বাসঘাতকতার সূত্র ধরেই ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তন – সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যা। জনগণের দোহাই দিয়ে এক রাজনৈতিক জোট জনগণকে পুড়িয়ে মেরেছে – আর সরকার যেখানে শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বিল দিয়ে এ সমস্যার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারত সেটা না করে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যাপারটা জিইয়ে রেখেছে। বোমা হামলা মামলায় যদি জেএমবিসহ অন্য জঙ্গিবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ করা যায়, তাহলে অনেক বেশী অপরাধে অপরাধী জামাত-শিবির কে কেন নিষিদ্ধ করা যাবে না? আসলে এই সহিংসতাকে মদদ দিয়ে বা সময় মত তা দমন না করে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে।

 

এখন আর সময় নেই নতুন করে ভাবার। দেশ আরেকটা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এটা গৃহ যুদ্ধ নয়, এটা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রের যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কলকারখানা নড়ছে আমেরিকা, পাকিস্তান আর আরব বিশ্বে। যদি তাই না হত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের এত আপত্তি ছিল কেন? কিন্তু তারা তো বিনা বিচারে গাদ্দাফি, সাদ্দামসহ যারা পশ্চিমের স্বার্থের বিরোধী ছিল তাদের হত্যায় তো টু শব্দটি করেনি। টু শব্দ করেনি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সময়, বরং এখনও পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বঘোষিত হত্যাকারীকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। তবে একাত্তরে এখানে ছিল পাক সেনারা, এখন বাঙালি নিধন যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে এদের দেশীয় দোসররা। ফলে কেউ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে, কেউ বা ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। একাত্তরে তাদের শিকার ছিল হিন্দু, প্রগতিশীল আর আওয়ামী লীগ – এখন হিন্দু, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবক্তারা, মুক্তচিন্তার মানুষ।

তাই আজ সময় এসেছে দল মত নির্বিশেষে যারা বাংলাদেশকে, বাংলা ভাষাকে, বাংলার মানুষকে ভালোবাসে তাদের সবার একত্রিত হওয়ার, একত্র হয়ে যারা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে, দেশের প্রগতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে বা নামছে তাদের প্রতিহত করার, পরাজিত করার – তা সে যুদ্ধ দুর্বলের ঘরবাড়ি পড়ানো বা দখল করেই হোক, ভিন্ন মত প্রকাশে বাধা দিয়েই হোক আর ভিন্ন ধর্ম ও মতের বিরুদ্ধে জনসভা বা সামাজিক মাধ্যমে ঘৃণা ও কুৎসা প্রচার করেই হোক। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা দিয়ে জনগণের ভালোবাসা অর্জন করা যায় না, জনগণের আস্থা লাভ করা যায় জনগণকে ভালোবেসে, জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে। তাই আমাদের এক হতে হবে, এক হয়ে দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে।

লেখাতে বেশ কযেক জায়গায় ভারত বিভাগের কথা এসেছে। তার মানে এই নয় যে আমাদের আবার পুরানো দিনে ফিরে যেতে হবে, আবার এক দেশ গড়তে হবে। সেই অবকাশ আর নেই, যদিও প্রায় একই সময়ে বিভক্ত দুই জার্মানি এক হযেছে, দুই কোরিয়া এখনও এক হবার স্বপ্ন দেখে। তবে ভারত, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের এক হবার কোন সম্ভাবনা নেই, যদিও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ প্রচুর। যে কারণে কথাগুলো লেখা তার একটা হল, মাঝে মধ্যে ইতিহাসের দিকে তাকালে অনেক ভুল এড়ানো যায়। বাংলাদেশ তার বর্তমান ভুখন্ড পেয়েছে ১৯৪৭ সালে। তার মানে এই নয় ১৯৪৭ এর আগে আমাদের কোন ইতিহাস ছিলো না। এমন কি সম্রাট অশোকের সময়েও, যা ছিলো খ্রিস্টের জন্মেরও আগে, বঙ্গ অনেক উন্নত ছিল। তাম্রলিপ্ত ছিল তাম্র যুগের প্রধান কেন্দ্রগুলোর অন্যতম। বিভিন্ন সময়ে এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম শাসকরা শাসন করেছেন। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একটু একটু করে আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। আমরা যদি আমাদের কযেক হাজার বছর পুরনো ইতিহাসকে, ঐতিহ্যকে সম্মান করতে শিখি, আমাদের আজকের অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। আমরা যে এগুচ্ছি না তা কিন্তু নয়। আমার ছোট বেলায় পহেলা বৈশাখ, গায়ে হলুদ এসব মূলতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধেই সীমাবদ্ধ ছিল, অন্তত গ্রাম এলাকায়। আজ পহেলা বৈশাখ আমাদের জাতীয় উত্সব, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সারা দেশের মানুষ পালন করে পহেলা বৈশাখ। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছাড়া আজকাল কোন বিয়ের কথা চিন্তা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের চর্চা আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের কবি আর লেখকেরা বাংলা সাহিত্যকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। আবার একই সঙ্গে বাঙ্গালী বঁধুর শাড়ির জায়গা দখল করেছে মাক্সি। আগে আমাদের মা বোনেরা ঘোমটা দিয়ে নিজেদের পর্দানশীন করতে পারতেন, আজ তাদের হিজাব পরতে হয়। এসব নিঃসন্দেহে আমাদের স্বকীয়তা থেকে দূরে নিয়ে যায়। নিজস্ব সংস্কৃতির গন্ডীর মধ্যে থেকে যে কাজগুলো করা যায়, সে কাজগুলো বাইরে থেকে আমদানী করা রীতিনীতি দিয়ে না করলেই ভাল। কই, আমরাতো ইউরোপিয়ান বা আরবদের মত করে খাইনা, তাদের মত করে মনের ভাব প্রকাশ করি না, চলি না, ফিরি না। মানুষের চলন, বলন, খাদ্যাভ্যাস এসব গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে, তার ভৌগলিক অবস্থানের কারণে। তাই আমরা যদি ভাত-মাছ খেতে ভালবাসি, মাকে মা ডাকতে পছন্দ করি, ভোরের পাখির ডাক বা নদীর বয়ে যাবার শব্দ যদি এখনও আমাদের শিহরিত করে, তবে আমাদের পোশাক আশাক সেটা পারবে না কেন? তাই আসুন একুশের শপথ হোক, আমরা যেন শুধু কথায়ই না, কাজে-কর্মে, চলনে-বলনে, পোশাকপরিচ্ছদে বাঙালি হতে পারি।

আমাদের নিজেদের স্বার্থেই রাজনীতি থেকে ভারত বা পাকিস্তান বিরোধিতা দূর কতে হবে, যেমন দূর করতে হবে ভারত বা পাকিস্তান তোষণ। চাই বা না চাই, ভারত ও পাকিস্তান আমাদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারব না, ভারত আমাদের পাশের দেশ থেকেই যাবে। ১৯৪৭ এর আগে আমরা ছিলাম অখণ্ড ভারতের অংশ আর ১৯৭১ এর আগে পাকিস্তানের অংশ। তাই আমাদের অতীত ওতপ্রোতভাবে এই দুই দেশের সাথে জড়িত, তাদের, বিশেষ করে অখণ্ড ভারতকে বাদ দিয়ে বাংলার ইতিহাস কল্পনা করা যাবে না, ঠিক যেমন কল্পনা করা যাবে না স্বাধীন বাংলাদেশের কথা পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে। বিরোধিতা বা তোষণ নয়, নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই শুধু আমরা এই উপমহাদেশের মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারব। আমাদের এই তিন দেশে যেমন ভারত বা পাকিস্তান বিরোধিতা, বর্তমানে আমেরিকার রাজনীতিতে তেমনি রুশ ও চীন বিরোধিতা ডমিনেট করে, যেমন ইউরোপে করে রুশ বিরোধিতা। এটা করে ভোট পাওয়া যায় কিন্তু মানুষের সমস্যার সমাধান করা যায় না। সমস্যা সেখানেই থেকে যায়। তাই আমাদের রাজনীতির মূল মন্ত্র হতে হবে বাংলাদেশ পন্থা যার ভিত্তি বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি। আর এটা করতে হলে আমাদের তাকাতে হবে নিজেদের অতীতের দিকে। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান – সব আমলের দিকে। সমস্ত ঐতিহ্যকে ধারণ করেই গড়ে উঠছে এই দেশ, এই জাতি – সেটাকে মেনে নিয়ে, মনে নিয়ে শুরু করতে হবে আমাদের যাত্রা।
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া