চলমান সংবাদ

বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে সরকারের প্রতিক্রিয়া

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পতাকা

যুক্তরাষ্ট্র- বাংলাদেশ সম্পর্ক বহুমাত্রিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, মিডিয়া সেন্সরশিপসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

তবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন এই প্রতিবেদনকে “অযৌক্তিক” বলে উল্লেখ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

‘২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত নতুন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির যে সরকার ব্যবস্থা রয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মত দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা। কারণ সেই নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগেই ব্যালট বাক্স ভরে যাওয়া, বিরোধী দলীয় এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়-ভীতি প্রদর্শনসহ নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।

ফলে পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বলে বিবেচিত হয়নি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনাও ঘটেছে। স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, সভা-সমাবেশে বলপ্রয়োগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে বাধা প্রভৃতি অন্যান্য সময়ের মতো অব্যাহত ছিল বলে উল্লেখ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে।

সেখানে আরও বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন ও দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক দায়মুক্তির অভিযোগের খবর এই সময়ে ছিল। যে সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করে, তদন্ত, বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে সরকার খুব কমই পদক্ষেপ নিয়েছে।

‘পৃথিবীর কোন দেশের গণতন্ত্র ত্রুটিমুক্ত?’

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন “মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উদ্দেশ্যে আমার প্রশ্ন হচ্ছে- পৃথিবীর কোন দেশের গণতন্ত্র ত্রুটিমুক্ত?”

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ত্রুটিমুক্ত নয় উল্লেখ করে ওবায়েদুল কাদের বলেন “কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশের নির্বাচনের বিরুদ্ধে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা বাঁধিয়েছেন, কয়টি প্রাণ ঝরে গেছে সেই ইতিহাস আমরা ভুলিনি। আমরাতো বলছি না আমরা পারফেক্ট। আমরা ত্রুটিমুক্ত করছি। ক্রমান্বয়ে আমরা রিফর্ম করছি। নির্বাচন কমিশনে এর আগে কখনও আইন ছিল না। সেই নির্বাচন কমিশনকে শেখ হাসিনা আইন করে স্বাধীনতা দিয়েছেন।”

বিদেশী লবিস্ট নিয়োগ করে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র বেশ কিছুদিন ধরেই ঘটছে বলে উল্লেখ করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

“এই প্রতিবেদন প্রত্যাশিত নয়” উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন: “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেভাবে লবিস্ট ফার্মের পিছনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে সরকারের বিরুদ্ধে, দেশের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে, আমি মনে করি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিবেদন সেখানে তারই প্রতিফলন থাকতে পারে।”

মত-প্রকাশের স্বাধীনতা ও মিডিয়া সেন্সরশিপ

প্রতিবেদনে ইন্টারনেটে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধার বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচক হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলো হয়রানির শিকার হয়েছে।

ওই সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন কাটছাঁট করা হয়েছে। এ কারণে অনেক মাধ্যম স্বেচ্ছায় সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে গেছে।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ মনে করছেন সরকারের নানান পদক্ষেপের প্রতিফলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন “এটাতো আন্তজার্তিক সংস্থাগুলো বলছে। বাংলাদেশে যারা ভিকটিম তারা তো নিজেরা দেখছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বারবার গুম, অত্যাচার নির্যাতন নিয়ে বলছে। এখানে মিডিয়া ফ্রিডম নাই। ডিজিটাল সিকিউরটি অ্যাক্ট-কালো এই আইন করে বিরোধী মতকে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। দেখেন বেশিরভাগ মিডিয়া কিন্তু সেলফ সেন্সরশিপে চলে গেছে।”

তবে বিপ্লব বড়ুয়া বলছেন, “সরকারের তরফ থেকে কোনও ধরনের বিধিনিষেধ নেই কোন সংবাদ প্রচার করা যাবে, কোনটা যাবে না তার ওপর। ডিজিটাল বাংলাদেশ জন্মলাভ করেছে এই সরকারের আমলে। কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে – ইন্টারনেটে স্বাধীনতা নেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই এমন সব কথা বলে।”

র‍্যাব
বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলেও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সেটা কমেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইন ও অফলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয়রানির ভয়ে মিডিয়া ও ব্লগাররা সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে সেলফ সেন্সর করছে।

করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের পরিচালনার বিষয়ে প্রশ্ন তোলাসহ সরকারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে সরকার। আইনটি ক্রমবর্ধমানভাবে দেশের বাইরে বসবাসকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে প্রতি মাসে গড়ে ৩২ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ২০২১ সালের তুলনায় নাটকীয়ভাবে কমেছে।

সরকারের উপর কি চাপ তৈরি করবে এই প্রতিবেদন?

জাতিসংঘের মানবাধিকার চুক্তিগুলোর আলোকে প্রণীত বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক এই বার্ষিক প্রতিবেদনে পৃথিবীর ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের স্থানীয় মানবাধিকার ও শ্রমিকদের অধিকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।

বিশ্বের ২০২২ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাতে সরকারের উপর আরও চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলছেন “যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশে মানবাধিকার বজায় থাকুক, গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরাতো মনে করি সরকারের উপর চাপ ইতোমধ্যেই আছে। এই সরকারতো কোনও কিছু দেখছে না ক্ষমতা ছাড়া। বাংলাদেশের মানুষ দেখছে এই সরকারের কী অবস্থা। এই ধরনের আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বাংলাদেশের সরকারের ওপর চপেটাঘাত করেছে। এমন প্রতিবেদন সরকারের উপর আরও চাপ তৈরি করবে বলে মনে করি”।

অন্যদিকে বিপ্লব বড়ুয়া বলছেন, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারের উপর চাপ তৈরি করা যাবে না।

“জনগণের রায় ছাড়া কখনও বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন নাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাংলার জনগণ ছাড়া তিনি আর কারও কাছ থেকে কোনও ভয়ভীতি বা এ ধরনের কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না,” বলছেন বিপ্লব বড়ুয়া।

“বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সময় দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। সরকারের অনেক মন্ত্রী কিন্তু দুদকের মামলায় কারাগারে গিয়েছেন। সাজাও পেয়েছেন। অন্য সরকারের আমলে কি এমন কোনও নজির কি ছিল?

“আমরা বলছি না ত্রুটি নেই। ত্রুটি আছে। কিন্তু আমাদের সরকার সেগুলো চিহ্নিত করে ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার জন্য সকলের কাছ থেকে সহযোগিতা প্রত্যাশা করে যাচ্ছি,” বলেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া।