চলমান সংবাদ

এত বিস্ফোরণ, এত প্রাণহানির পরও উদাসীনতা!

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন স্থানে একের পর বিস্ফোরণ হয়েছে, প্রাণহানিও হয়েছে অনেক৷ কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আগের মতো এখনো নেওয়া হচ্ছে না৷

প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে একটি রিপোর্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে৷ এখন পর্যন্ত সেই রিপোর্ট ধরে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন নজির নেই৷ ফলে সেই রিপোর্টগুলো মন্ত্রণালয়ে ফাইলচাপা পড়ে থাকে৷ ফায়ার সার্ভিসের হিসেবে, গত ৩ বছর দুই মাসে দেশে ৩৪৪টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩৬ জন৷ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক মানুষ৷ তারপরও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না৷

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘‘এই দুর্ঘটনাগুলোর জন্য আমি ভবন মালিকদের চেয়ে সরকারী এজেন্সিগুলো বেশি দায়ী বলে মনে করি৷ কারণ, একটা বিল্ডিং হওয়ার পর ৫ বছর অন্তর সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা তা পরিদর্শন করে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হয়৷ সেটা হচ্ছে না৷ আবার রাজউক বা ফায়ার সার্ভিসও একটা বিল্ডিং নির্মাণের সময় পরিদর্শন না করেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে৷ এখানে ঘুস বাণিজ্য চলে৷ এই ঘুস বাণিজ্য চললে সঠিক চিত্র কখনো পাওয়া যাবে না৷ ঢাকা শহরে ৬ লাখ বিল্ডিং৷ অধিকাংশই একইভাবে তৈরি হয়েছে৷ ফলে মাঝেমধ্যে এখানে একটা-দুটো ঘটনা তো কিছুই না৷ আরো বেশি দুর্ঘটনা ঘটার কথা৷ যতদিন না আমাদের এজেন্সিগুলো এই অবস্থা থেকে বের না হবে, ততদিন পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা উচিত হবে না৷’’

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৩৪টি এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত ১০টি ছোট বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে৷ এতে ১৩৬ জন নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা সহস্রাধিক৷

২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই সীতাকুণ্ডে গত ৪ মার্চ অক্সিজেন-গ্যাস উৎপাদন কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হন ৬ জন৷ অভিযোগ রয়েছে, কারখানার নিরাপত্তা ও কর্তৃপক্ষের সচেতনতা নিয়ে৷ কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি৷ এখনও সীতাকুণ্ডের পরিস্থিতি একইরকম৷

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর আরেকজন শিক্ষক ইয়াসির আরাফাত খানও মনে করেন, ‘‘বিস্ফোরণের প্রতিটি ঘটনায় যথাযথভাবে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার৷ বাসা, বাড়ি, কারখানা, গোডাউন এবং দাহ্য পদার্থ রাখা স্থানের বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে৷ কারখানা ও সরকারি সংস্থাগুলোতেও দক্ষ জনবল থাকতে হবে৷ রাসায়নিক শিল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই৷ পাশাপাশি যেসব কারণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বা মানুষের জীবনের ঝুঁকি আছে, সেগুলোতে অবহেলা করা উচিত নয়৷’’

প্রতিদিনই দেশের অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি, ছোট-বড় কারখানা, শপিং মল, মার্কেট, কেমিক্যাল গোডাউন ও গ্যারেজে কোথাও না কোথাও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে৷ ফায়ার সার্ভিস বলছে, সেফটি ট্যাঙ্কিতে জমে থাকা গ্যাস, গ্যাস লাইন, কারখানার বয়লার, গ্যাস সিলিন্ডার, এসির কম্প্রেসারের ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ঘটছে৷ এছাড়া যত্রতত্র দাহ্য পদার্থ রাখা, বৈদ্যুতিক লাইনের ত্রুটি বা নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক না করার কারণে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছে৷

গত তিন বছরে যেসব বিস্ফোরণ ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ৷ ওই বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩১ জনের মৃত্যু হয়৷ ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয় এবং ২০২২ সালের ৪ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়৷ এবং সর্বশেষ পুরোনো ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ভবনে বিস্ফোরণে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ এই ঘটনাগুলো মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে৷ প্রত্যেকটি ঘটনায় তদন্ত হয়েছে৷ রিপোর্টও জমা পড়েছে৷ কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷

মগবাজারের ‘রাখি নীড়’ ভবনে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ সদরদপ্তরের গঠিত অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনে বিস্ফোরণের জন্য তিতাস গ্যাস, রাজউক, ভবন মালিক, দোকান কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়েছে৷ দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করতে সরকারের আরো কয়েকটি সংস্থা অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিল৷ পুলিশের কমিটি ২৮টি সুপারিশ করলেও তা ফাইলবন্দি হয়ে গেছে৷ বিস্ফোরণের ঘটনায় অবহেলাজনিত পাঁচটি কারণ তারা সামনে এসেছে৷ সেগুলো হলো, ভবনটির নকশা অনুযায়ী নিচতলার পেছনের অংশে গ্যারেজ ও বারান্দা এবং সামনের অংশ শুধু বাণিজ্যিক অনুমোদন ছিল৷ বাড়ির মালিক মূল নকশা অনুসরণ না করেই নিচতলার পুরোটা বাণিজ্যিক ব্যবহার করেছেন, যা ইমারত আইন ও বিধির লঙ্ঘন৷ পুরাতন ভবন হওয়া সত্ত্বেও ভবনে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছিল৷ পাশাপাশি ওই বাড়ি থেকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ২০১৪ সালে গ্যাস সংযোগ থেকে শুধু রাইজার বিচ্ছিন্ন করে৷ তবে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি৷ বিস্ফোরণস্থল থেকে গ্যাস নির্গমনের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ ফায়ার সার্ভিসের রিপোর্টেও এই তথ্য উঠে আসে৷

সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে প্রাণহানির ঘটনায় পুলিশের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি৷ মামলার আট আসামি গ্রেপ্তার হলেও এখন জামিনে রয়েছেন৷ মামলার অগ্রগতি বলতে থানা-পুলিশ থেকে তদন্তের দায়িত্ব গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে স্থানান্তর করা হয়েছে৷ চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে ২০১৯ সালে বিস্ফোরণের পর ৭১ জন মারা যান৷ এই ঘটনায়ও চকবাজার থানায় একটি মামলা হলেও বাড়ির মালিকসহ কাউকেই বিচারের আওতায় আনা যায়নি৷

প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বলেন, ‘‘এখানে যে বিস্ফোরণগুলো হচ্ছে, সেটা ভিন্ন ভিন্ন কারণে৷ এখানে সিটি কর্পোরেশনের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই৷ প্রতিটি সংস্থা পৃথক এবং তারা মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করে৷ বিশ্বের অন্য শহরগুলোতে সিটি কর্পোরেশনের হাতে ক্ষমতা থাকে, তারা তদারকি এবং ব্যবস্থা নেয়৷ বিষয়টি যখন মন্ত্রণালয়ে চলে যায়, তখন প্রক্রিয়া অনেক জটিল হয়ে যায়৷ এখানে কারো সঙ্গে কারো সমন্বয় নেই৷ ওয়াসা কাজ করছে তাদের মতো, গ্যাস কোম্পানিগুলো কাজ করছে তাদের মতো, রাজউকও নিজেদের মতো করে কাজ করে৷ ফলে সমন্বিত ব্যবস্থা ছাড়া ভালো ফল পাওয়া যাবে না৷ এখানে গ্যাসের সেই পুরনো লাইন৷ কোনো মেরামত হচ্ছে না৷ এর সঙ্গে আছে চোরাই লাইন৷ কোথায় লিকেজ হচ্ছে, কোনো লাইন ভালো আছে, কোনোটি নেই এগুলো দেখা হচ্ছে না৷ এমন পরিস্থিতিতে আমরা কোনো ভালো ফল আশা করতে পারি না৷ এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে৷’’

ঢাকায় বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো তদন্ত করছে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)৷ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংস্থাটির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ও সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয় দলের প্রধান রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘সায়েন্স ল্যাবের বিস্ফোরণ ও গুলিস্তানের বিস্ফোরণের ধরন একই৷ আবার এই দুটির সঙ্গে ২০২১ সালের মগবাজারের বিস্ফোরণেরও মিল রয়েছে৷ ভবনগুলোতে কোনো না কোনোভাবে গ্যাস জমে ছিল৷’’

# সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে,  ঢাকা