চলমান সংবাদ

নগরে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ

নগরের পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটাল এবং একে খান আল আমিন হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা দুটি ‘নীরব এলাকা’ শ্রেণিভুক্ত। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর বিধি ২ (ঞ) অনুযায়ী, এসব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের সহনীয় মানমাত্রা হচ্ছে ৫০ ডেসিবল। যা রাতের বেলা ৪০ ডেসিবল এ নির্ধারিত। অথচ এলাকা দুটিতে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম গবেষণাগারের রেকর্ডকৃত শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৭২ দশমিক ৫০ ডেসিবল।

শুধু এলাকা দুটি নয়। শহরের অন্যান্য ‘নীরব এলাকা’য়ও শব্দের সহনীয় মানমাত্রার চেয়ে বেশি রেকর্ড করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটির গবেষণাগার প্রতিমাসে শহরের ৩০টি স্পটের শব্দের মানমাত্রা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ১৫টি ‘নীরব এলাকা’, দুইটি ‘মিশ্র এলাকা’, ‘সাতটি আবাসিক এলাকা’ এবং ছয়টি বাণিজ্যিক এলাকা রয়েছে। গত মাসে (ফেব্রুয়ারি) পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে জানা গেছে, সবক’টি এলাকায় শব্দের নির্ধারিত মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে নগরবাসী।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত এ শব্দদূষণের জন্য গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, মোটরযানের অতিরিক্ত হর্ন, শিল্প–কারখানার মেশিনের শব্দ, বাসাবাড়ি ও শপিং মলে জেনারেটর ও উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজানো, নির্মাণ কাজের পণ্য ওঠানামা ও নির্মাণ কাজ চলাকালে সৃষ্ট শব্দ এবং মাইকিং দায়ী। চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দদূষণের কারণে বাড়ছে নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগ করতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শব্দের সহনীয় মাত্রা কত? : শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এ পাঁচটি এলাকায় ভাগ করে দিন ও রাতের শব্দের সহনীয় মানমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় (আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প এলাকা একত্রে থাকলে) দিনে ৬০ ডেসিবল এবং রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল এবং রাতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল এবং রাতে ৭০ ডেসিবল নির্ধারণ করা আছে।

শহরের নীরব এলাকার চিত্র : ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী এলাকাগুলোর মধ্যে পাহাড়তলী গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৯ ডেসিবল, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের সামনে ৬৬ দশমিক ৫০ ডেসিবল, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) সামনে ৬৭ ডেসিবল, চিটাগাং গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭০ ডেসিবল, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুলের (বাওয়া) সামনে ৬৬ ডেসিবল, ডা. খাস্তগীর গভর্মেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৬৯ ডেসিবল, চট্টগ্রাম কলেজের সামনে ৭০ ডেসিবল, সিটি কলেজের সামনে ৭২ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে ৭০ দশমিক ৫ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের সামনে ৬৫ দশমিক ৫০ ডেসিবল, আন্দরকিল্লা জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে ৬৮ দশমিক ৫০ ডেসিবল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের সামনে ৭১ ডেসিবল, একে খান আল আমিন হসপিটালের সামনে ৭২ দশমিক ৫০ ডেসিবল, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটালের সামনে ৭২ দশমিক ৫০ ডেসিবল এবং পূর্ব নাসিরাবাদের সাদার্ন হসপিটালের সামনে ৬৭ দশমিক ৫০ ডেসিবল রেকর্ড করা হয়।

আবাসিক এলাকার চিত্র : চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৬৮ দশমিক ৫০ ডেসিবল, আমিরবাগ আবাসিক এলাকায় ৭৩ দশমিক ৫০ ডেসিবল, হালিশহর কে–ব্লক আবাসিক এলাকায় ৭৩ ডেসিবল, কল্পলোক আবাসিক এলাকায় ৭২ দশমিক ৫০ ডেসিবল, হিলভিউ আবাসিক এলাকায় ৭১ ডেসিবল, কসমোপলিটন আবাসিক এলাকায় ৭০ ডেসিবল এবং দক্ষিণ খুলশী আবাসিক এলাকায় ৭২ ডেসিবল রেকর্ড করা হয়।

বাণিজ্যিক এলাকার চিত্র : একে খান মোড়ে ৭৪ ডেসিবল, জিইসি মোড়ে ৭৫ ডেসিবল, বহদ্দারহাট মোড়ে ৭৯ ডেসিবল, আগ্রাবাদ মোড়ে ৭৬ দশমিক ৫০ ডেসিবল, সিইপিজেড মোড়ে ৭৪ দশমিক ৫০ ডেসিবল ও অঙিজেন মোড়ে ৭৬ দশমিক ডেসিবল রেকর্ড করে।

মিশ্র এলাকার চিত্র : পাঁচলাইশ মির্জাপুল একুশে হাসপাতালের সামনে ৭০ ডেসিবল এবং মেহেদীবাগ ম্যাঙ হাসপাতালের সামনে ৭২ ডেসিবল রেকর্ড করা হয়।

যেভাবে উপেক্ষিত বিধিমালা : শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এর বিধি ২ (ঞ) অনুযায়ী, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এবং তার চতুর্দিকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা হচ্ছে নীরব এলাকা। যেখানে গাড়ির হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ শহরের নীরব এলাকায় রাতদিন গাড়ির হর্ন বাজতে থাকে।

এ ছাড়া বিধি ১১ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ইট বা পাথর ভাঙ্গার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। এছাড়া সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্র বা যন্ত্রপাতি চালানো যাবে না। অথচ এ বিধি কেউ মানছে না।

বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. মুজিবুল হক দৈনিক আজাদীকে বলেন, শব্দ দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এছাড়া হার্ট ডিজিজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের অন্যতম কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। শব্দদূষণের কারণে কানে কম শোনা, হৃদ রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, মানসিক সমস্যা, গর্ভস্থ বাচ্চা নষ্ট, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন (বধির) শিশু জন্ম নেয়।

এর আগে গত বছরের (২০২২) নভেম্বর মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের জরিপের ফলাফলে বলা হয়, শব্দদূষণের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৪২ শতাংশ রিকশাচালক ও ৩১ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণজনিসত সমস্যা হয়।

কী বলছে পরিবেশ অধিদপ্তর : পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ও গবেষণাগারের পরিচালক মুফিদুল আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। এর অন্যতম হাইড্রোলিক হর্ন। আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করি। গাড়ি চালকদের জরিমানা করছি। এরপরও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গাড়ির চালক ও মালিকদেরও সচেতন হতে হবে। ট্রাফিক পুলিশও নিয়মিত অভিযান চালিয়ে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। হাইড্রোলিক হর্ন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে পারলে শব্দদূষণ অনেক নিয়ন্ত্রণে আসবে।

তিনি বলেন, নির্মাণ কাজের জন্যও শব্দদূষণ বাড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে কনস্ট্রাকশন হচ্ছে সেখানেও নিয়ম–নীতি মানা হচ্ছে না। এ বিষয়ে মনিটরিং জোরালো করার জন্য আমরা সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ’কে চিঠি দিয়েছি। সামগ্রিকভাবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনা সৃষ্টির পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।