মতামত

কমরেড তাজুল শ্রমিক আন্দোলনের পথ প্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণা

-ফজলুল কবির মিন্টু

১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক এরশাদের গুণ্ডাবাহিনীর ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রদূত কমরেড তাজুল ইসলাম।তিনি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।  পরবর্তীতে  প্রতি বছর ১ মার্চ ‘তাজুল দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কমরেড তাজুল বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের অন্যতম নেতা ছিলেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন। এরশাদের এই ঘোষণা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নেয়নি। প্রতিবাদ শুরু হয় এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রথম দিন থেকেই। প্রতিবাদে রাজপথে নামে দেশের ছাত্র-জনতা। তারই ধারাববাহিকতায় ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গড়ে উঠে ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনে শহীদ হন দীপালি সাহা, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, আইয়ুবসহ অসংখ্য সূর্য সারথি। পিচঢালাীকালো রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয় সামরিক জান্তার বুলেট ও বেয়নেটে।

এরশাদ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে উপজেলা পরিষদের কাঠামো তৈরি করে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এরশাদকে প্রতিহত করতে গড়ে উঠে ১৫ দল, ৭ দল, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ও অন্যান্য পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মোর্চা। উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক জোট সমূহের নেতৃত্বে হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। হরতাল সফল করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি গ্রহণ করে। স্কপ শিল্প-কলকারখানায় ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট আহ্বান করে।
স্কপের ধর্মঘট স্ফল করার লক্ষে দেশের কলকারখানা, শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিল। দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল ‘আদমজী’তে ধর্মঘট স্ফল করার প্রস্তুতি মিছিলে হামলা চালিয়ে খুনি এরশাদের মদদপুষ্ট ছায়াদুল্লাহ সাদুর গুণ্ডাবাহিনী ছুরিঘাত করে শ্রমিক নেতা বীর কমরেড তাজুল ইসলামকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ১ মার্চ কমরেড তাজুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাজুল ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধ শেষে নয় মাস পর দেশে ফিরে আসেন এবং দেশের বাম প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন। তিনি দেশের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করার পর তার সামনে সুযোগ ছিল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া কিংবা বড় ব্যাংকার অথবা সরকারী কোন বড় চাকুরী করার। কিন্তু সেগুলোর কোনটিই তাজুলকে আকৃষ্ট করতে পারেনি তিনি বেছে নিয়েছিলেন শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার লক্ষে দেশের সর্ব বৃহৎ পাটকল আদমজীতে বদলি শ্রমিকের চাকরি। শুধু তাই নয় আদমজীতে চাকরি নিয়ে শ্রমিকদের সাথে শ্রমিকদের  কলোনীতেই থাকতেন এবং তিনি সাধারণ শ্রমিকদের মতন অত্যন্ত  সাদাসিধে জীবন যাপন করতে শুরু করলেন। ফলে কমরেড তাজুল খুব দ্রুত সাধারণ শ্রমিকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। তার জনপ্রিয়তায় স্বৈরশাসক ও তার দোসরদের ভীত কেঁপে উঠেছিল তাই তারা তাকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করেছিল। তাজুলের মৃত্যু নিছক কোন দুর্ঘটনা ছিলনা এটা ছিল একটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

কমরেড তাজুল নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করে বাংলাদেশের শোষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মানুষকে মুক্তির মোহনায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। তিনি আমাদের মাঝে ত্যাগের এক অনন্য ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন  করে গেছেন।

বাংলাদেশে শ্রম শোষণ এখন চরম আকার ধারন করেছে। বৈষম্য এখন আকাশচুম্বী। এই শোষণ এবং বৈষম্য থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন অসংখ্য তাজুল।  কমরেড তাজুল আগামী দিনের শ্রমিক আন্দোলনের পথ প্রদর্শক এবং অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকুক অনন্তকাল। কমরেড তাজুল লাল সালাম।

লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি