চলমান সংবাদ

একের পর এক দেহ উদ্ধার, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্কের স্বজনহারা শরণার্থীরা

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে সিরিয়া সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের প্রাচীন শহর আন্টাকায় ঠাঁই নেন আইডিন সিসম্যানের আত্মীয়রা৷ গত সোমবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় তারা সবাই ছিলেন সিসম্যানের ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত শাশুড়ির বাড়িতে৷ সিসম্যানের আত্মীয়দের মতো লাখো শরণার্থী তুরস্কে একটি অস্থায়ী আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন৷ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেকে নিজেদের বাঁচাতে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা৷ এই ভূমিকম্প লাখো শরণার্থীদের জীবন আরো বিপন্ন করে তুলেছে৷

সিসম্যান বলেন, ‘‘যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয় অতিথিরা সেই বাড়িতে ছিলেন৷ তারাও ভিতরে শুয়ে ছিলেন৷ কিন্তু আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই।”

১০ বছরের পুরনো ওই ভবনের ধ্বংসস্তুপের তলায় আটকা পড়েছিলেন সিসম্যানের শ্বশুরও৷ ধ্বংসস্তুপ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, উদ্ধারকারীরা যখন কাজ করছিলেন, তখনও সিসম্যানের মনে কোনো আশা ছিল না৷

শ্বশুর এবং ইউক্রেনীয় আত্মীয়দের খুঁজে পেতে স্ত্রীর সঙ্গে কাতার থেকে তুরস্কে আসেন সিসম্যান৷

তিনি বলেন, ‘‘এই মুহূর্তে, আমার শাশুড়ি এবং শ্বশুর ভিতরে আছে৷ তারা ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়েছেন৷ কোনো উদ্ধারকারী দল ছিল না সেখানে। আমি নিজেই গিয়েছিলাম৷ দেহগুলি দেখতে পেয়ে ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে বের করে আনলাম। কয়েকটি শরীরে মাথাও ছিল না৷’’

২০১১ সালের সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে অন্তত ৩৬ লাখ সিরীয় নাগরিক নিজেদের বাঁচাতে নিজ দেশ ছেড়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ বোমা হামলা, রাসায়নিক হামলা এবং খিদের জ্বালা থেকে মুক্তি পেতেই তারা পালিয়ে আসেন৷ সেইসব শরণার্থীদের জন্য এই ভূমিকম্প আরো একটা মারাত্মক বিপর্যয়৷

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ইয়াহিয়া সাইয়েদ আলি এখন ২৫ বছরের তরুণ৷ সিরিয়া যুদ্ধ থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে আসেন তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘এটি আমাদের দেখা সবচেয়ে বড় বিপর্যয়৷ আমরা অনেক কিছু দেখেছি৷’’

তার মা, দুই চাচাতো ভাই এবং অন্য এক আত্মীয় সবাই ভূমিকম্পে মারা গিয়েছেন৷ দোতলা যে ভবনে থাকতেন তারা, শনিবার সেটির সামনে এসে অপেক্ষা করছিলেন৷ উদ্ধারকর্মীরা তার মায়ের দেহটি যদি অন্তত খুঁজে দিতে পারেন, সেই আশায় অপেক্ষা করছিলেন৷

আন্টাকিয়াতে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য একটি আশ্রয়কেন্দ্র চালাতেন আহমেদ আবু শার৷ সেই আশ্রয়কেন্দ্রটি এখন একটি ধ্বংসস্তূপ৷ তিনি বলেন, ‘‘এই ভূমিকম্পে এমন একটি সিরীয় পরিবার পাওয়া যাবে না, যিনি তার আত্মীয় কিংবা প্রিয়জনকে হারাননি৷’’

আবু শার বলেন, ‘‘মানুষ প্রিয়জনকে খুঁজছে৷ তারা বিদ্যুৎহীন, পানিহীন, বসবাস অনুপযোগী আন্টাকিয়া ছেড়ে যেতে তবুও রাজি নয়৷ কারণ, তারা প্রিয়জনদের খুঁজছেন৷ অনেকে রাস্তায় বা ভাঙা ভবনের নীচেও ঘুমাচ্ছেন৷’’

তিনি জানান, কেউ এমন অবস্থার কথা কেউ একবারও ভাবেননি৷

আন্টাকিয়ায় কংক্রিটের নিচে আটকে পড়া শিশুদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য মরিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আব্দুল কাদের বারাকাত৷

তিনি বলেন, ‘‘সেখানে চারজন ছিলেন৷ আমরা দুজনকে বের করে এনেছি৷ দুজন এখনও ভিতরে৷ আমরা তাদের গলার স্বর শুনতে পেয়েছি৷ উদ্ধারকর্মীদের প্রয়োজন৷’’

সিরিয়ার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বসেছিলেন মোহাম্মদ আলোলো৷ তিনি কিছুটা ভাগ্যবান৷ কারণ ভূমিকম্পের সময় দ্রুত বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন৷

তুর্কি-সিরিয়া সীমান্তে একটি শরণার্থী শিবির থেকে গত মে মাসে আন্টাকিয়ায় আসেন তিনি। সিরিয়ার সেন্ট্রাল হামা প্রদেশে গোলাবর্ষণে বেঁচে পালিয়ে আসা ব্যক্তি জানান, ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া তার কাছে একটি অলৌকিক ঘটনা৷

তিনি বলেন, ‘‘আমার অন্য আত্মীয়রা এত ভাগ্যবান না। আমার দুই ভাতিজি এবং তাদের পরিবার ধ্বংসস্তূপের তলায় রয়ে গিয়েছে৷ এ ঘটনাকে বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার নেই৷’’

হতাশা এবং শোকের আবহ ছড়িয়ে পুরো এলাকা জুড়ে৷ অথচ এই মানুষগুলো কিছুদিন আগে যুদ্ধ এবং সংঘাত ছেড়ে একটু বাঁচার আশায় এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷

আন্টাকিয়া থেকে উত্তরে প্রায় ২০০ মাইল দূরের শহর এলবিস্টান৷ সেখানে একটি কবরস্থানে বসে কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করছিলেন একটি সিরীয় পরিবার৷ কারণ তাদেরই এক প্রিয়জনকে এখানে দাফন করা হয়েছে৷

চার সন্তানের মা নাজিহা আল-আহমাদের দেহটি তাদের নতুন বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ গুরুতর আহত হন তার দুই মেয়ে, যাদের একজন পায়ের আঙুল হারিয়েছে।

তার স্বামী আহমাদ আল-আহমাদ বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী খুব ভালো মানুষ ছিল। স্নেহশীল, দয়ালু, একজন ভাল স্ত্রী৷ আল্লাহ তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের প্রতিবেশীরাও মারা গিয়েছেন৷’’

তুর্কি ও সিরিয়া সীমান্তে দেখা গিয়েছে, অনেকে প্রিয়জনদের মরদেহ জন্মভূমি সিরিয়াতে নিয়ে যেতে চান৷ দেহগুলো একটি ট্রাকে তুলছিলেন তারা৷

খালেদ কাজকুজ নামে এক ব্যক্তির ৫ বছর বয়সি ভাতিজি তাসনিম কাজকুজের মরদেহও ছিল সেখানে৷ ভূমিকম্পের সময় সীমান্তবর্তী শহর কিরিখানে থাকা তাসনিম এবং তার বাবা দুজনেই মারা গিয়েছেন৷ তিনদিনের চেষ্টার পর তাসনিমের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা ওকে ধ্বংসস্তুপের তলায়, পাথরের নীচ থেকে বের করে এনেছি। পুরো বিল্ডিং ধসে পড়েছে৷ আমরা ওকে বের করার জন্য তিন দিন ধরে চেষ্টা করেছিলাম৷’’

ভাইয়ের মেয়ের মরদেহ সিরিয়াগামী ট্রাকে তুলে দেয়ার আগে সেই দেহ বহনকারী ব্যাগে সই করতে হয়েছিল খালেদকে৷ গাড়িটি ছেড়ে দিলে প্রার্থনা করছিলেন খালেদ৷ তখনও তার গলা কাঁপছিল কান্নায়৷

আর্তনাদ করে তিনি বলেন, “ধ্বংস এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের এখন কিছুই নেই৷ জীবন আরো অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে।’’

টিএম/আরকেসি (এপি)