শিল্প সাহিত্য

প্রেম ও অমৃতলোক!

-শাহীন আকতার হামিদ

 

ক্যান্সার রিসার্চ কেন্দ্রের বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলাম। আজ একটানা শুনতে হয়েছে অগ্নাসয় ক্যান্সারের খুটিনাটি।

বিভাস এসে বলল, বসব, হাসতে  হাসতে বললাম না বরের  অনুমতি লাগবে। আচ্ছা তোমার বরকে ফোন করে সন্মতি নিচ্ছি বলে আমার পাশে বসল।  বিভাস বলল,  আজ তোমায় আমি একটা অভিজ্ঞতার কথা শুনাব। বললাম, তোমার প্রিয় কুকুরটির কথা, বলল হা কিছুটা তাই বাকিগুলো অন্যকিছু।

বিভাসের ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে কোলকাতায়। কোন এককালে ওদের পুর্বপুরুষরা পুর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলো। ৬৫ বছরের বিভাস এবারই তার জন লুইসের কাজ থেকে অবসর নিয়েছে। কয়েকদিন হোল সে ক্যান্সার রিসার্চের সেমিনারে আসে। কেনো আসে তা জানিনা, আমি কেনো আসি তা বলেছি। ভদ্র মানুষ, বাংলা ব্রিটিশ মিলিয়ে বেশ চমৎকার সমন্বয় ।

বিভাস প্রতিদিন বিকালে অফিস থেকে ফিরে মেয়ের নামে রাখা নাম কুকুর মিনিকে নিয়ে হাটতে যায় বুশি পার্কে। ঘন্টাদুই হাটার পরে ফিরে যায় ঘরে, রাতের খাবার নিয়ে বসে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী সুধার ছবির সামনে, মারা যাওয়ার আগে এটা ছিলো সুধার শেষ অনুরোধ। যেখানেই থাক, যার সাথেই থাক, রাতের খাবারটা আমার সামনে বসে খাবে, গত পয়ত্রিশ বছর বিভাস তাই করে। বন্ধু বান্ধবীরা কত টিটকারী দিত, এতো ভালবাস বউকে। হ্যা ভালো সে বাসে সুধাকে, তাতে কোন ভুল নেই, তাই বলে কোন কিছুই তার আটকে থাকেনি, সবই সে পুরন করেছে  নিত্য দিনের চাহিদা অনুযায়ী, তাতে সুধা একবিন্দুও নড়েনি তার অবস্থান থেকে।

গত সপ্তাহে বিভাস হাটতে হাটতে পৌছে গেলো হেমটন কোর্টের কাছাকাছি, মিনিকে ছেড়ে দিয়ে সে বসলো একটি ঝোপের আড়ালে। গরমের এ সময়টা ব্রিটেনে খুব সুন্দর, রঙ্গে রঙ্গে মিলমিশ। নানা জাতীয় ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ঝোপ ঝাড়ে একাকার। ঝোপের পাশে সে দেখল অতি পুরণ  একটা মানিব্যাগ। ধুলবালির আস্তরণ দেখে মনে হোল বেশ কিছুদিন ধরে এটা এখানটায় পড়ে আছে। ইতস্তত করে হলেও সে ব্যাগটি খুলল। একটি  ফুস্কেপের কাগজ  যা হয়তো এক সময় সাদা ছিল এখন হলুদ হয়ে গেছে,  চার লাইনের একটি চিঠি, ক্রিসকে লিখা জোডির পত্র।  যার বাংলা অনুবাদ হল,

‘রাগ করনা প্রিয়, বাবা মা আমায় আমেরিকাতেই পড়াবে। তুমি আমার প্রথম ও শেষ প্রেম মনে রেখো। পড়া শেষ হলেই আমরা একসাথ হবো। আমারতো আঠারো বছর হতে চারমাস বাকি তানা হলে বিয়ে করতে পারতাম, তারপর চলে যেতাম পড়তে। ভয় পেওনা, আমি অবশ্যই ফিরব।‘

বিভাস বলছিলো সে কয়েকদিন ধরে কেমন নস্টালজিক হয়ে ছিলো, বার বার মনে পড়ছিলো তার আর সুধার সে স্কুল-কলেজের প্রেমময় সময়গুলোর কথা। কোনপক্ষের মাবাবা মেনে নেয়নি বলে বিয়ে করতে অনেক দেরি হয়ে গেছিল তাদের। বিয়ের পরে নমশূদ্র সুধাকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে ব্রাহ্মণদের। মা বলত এরচেয়ে মুসলমান আনলেই পারতি। সুধাকে অপমান থেকে বাঁচাতেই বিলেত যাত্রা, কিন্তু শেষ রক্ষা হলনা।

ছমাসের বাচ্চাপেটে সুধার ধরা পড়ল ওভারী ক্যান্সার। ডাক্তাররা আশা করতে পারলনা, বাচ্চা আক্রান্ত না হলেও জরায়ু ও ব্লাডারে ছড়িয়ে গেছে। মেয়ে বাচ্চা হবে জেনে ওরা নাম রেখেছিল মিনি। কিছুদিনের মধ্যে সুধা মিনিকে নিয়ে হারিয়ে গেলো। গোছানো চিন্তার ছেলে বিভাস আর কোলকাতায় ফিরেনি, বুশি পার্কের পাশে যে বাসাটায় ওরা ভাড়া থাকত সেটাই কিনে  নিয়েছিল অনেক টাকা ভর্তুকি দিয়ে, আজো সেখানেই থাকে। মাবাবা যতদিন বেঁচেছিল দায়িত্ত্ব পালন করেছে, ভালবেসেছে মাবাবাকে, প্রতিদিন একবার মা বাবার সাথে ফোনে কথা বলেছে, টাকা পাঠিয়েছে নিয়মিত, কিন্তু সুধার কথা কখনও  তাদের সামনে বলেনি, তাদের ও বলতে নিষেধ করেছে।

সারাদিনের জন্য মিনি ও তার জন্য খাবার বেধে নিয়ে বেরিয়ে যেত বিভাস, খুঁজতে শুরু করল ব্যাগের মালিককে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছে হবে  কোন বয়স্ক মানুষের মানিব্যাগ। পুলিশকে দিলনা, দেখি ব্যাগের মালিক কে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইব তার প্রেমপত্রের   কথা।

বুশিপার্কের আশেপাশের সবগুলো বাড়িতে ঘুরে ঘুরে সে ব্যাগটি দেখিয়ে মালিকের সন্ধান করল। না পেলনা। এরপর চলে গেলো হেমটন কোর্ট সংলগ্ন বৃদ্ধাশ্রমে। বিভাসের ধারনা হল এ ব্যাগ যারই হউকনা কেনো সে বুশি পার্কে হাঁটতে এসেছিলো। অথবা কেউ চুরি করে থাকলেও ব্যাগের মালিক আশে পাশে কোথাও বাস করে।ব্যাগে যত্ন করে রাখা এ চিঠিটার রহস্য তাকে জানতেই হবে।

হেমটন কোর্ট সংলগ্ন এ আশ্রমটি ইউকের পয়সাওয়ালা মানুষদের জন্য বানানো। সপ্তাহে নয়শত পাউন্ড থেকে তিনহাজার পাউন্ড  পর্যন্ত ভাড়া গুণতে হয়। তবে সুযোগ সুবিধা সর্বোচ্চ মাত্রার। দিনে দুবেলা ডাক্তার দেখে যায়, সারাক্ষন দেখে রাখার জন্য একজন স্টাফ থাকে। নিজস্ব রুচি অনুযায়ী খাবার দেয়া হয়। সপ্তাহে একদিন বা দুদিন দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখানো হয়। বিভিন্ন চায়ের দোকানে ফ্রি চা পানের ব্যাবস্থা আছে। নিজস্ব পরিচারক বা পরিচারিকাকে নিয়ে যে কোন সময় চা খেতে যেতে পারে, অবশ্যই সেখানে প্রশাসনের অনুমতি লাগবে।

বিভাস বৃদ্ধাশ্রমের গেটে গিয়ে ভিতরে ঢুকতে চাওয়াতে গেটের দারোয়ান জানতে চাইল সে কার কাছে যাবে? বিভাস ভাবল এদের সাথে কথা বলে কোন কিছু জানা যাবেনা, তাই বলল আমি তোমাদের নিয়ম কানুন জানতে চাই,  আমি এখানে  থাকতে চাই। ঠিক আছে তুমি প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ কর, বলে গেট খুলে দিলো।

বিভাসকে দেখে একজন এগিয়ে এসে তার পরিচয় দিয়ে বলল, আমি জোসেফ, কিভাবে সাহায্য  করতে পারি। সামনের সোফায় বসতে বলে নিজে একটাতে বসলো। বিভাস বলল সে এখানে দুট জিনিস সম্পর্কে জানতে এসেছে। প্রথমত এখানে কত বয়স থেকে এডমিশন নিতে হয়, কি কি নিয়ম আছে সব জানার পরে সে আসল কথায় আসলো। জানতে চাইলো ক্রিস্টোফার (ক্রিস)নামের কেউ এখানে আছে কিনা। ফ্যামিলি নাম জানেনা তাই বলতে পারলনা। ভদ্রলোক জানালেন তাদের এখানে তিনজন ক্রিস আছে। এবার বিভাস আসল কথায় আসল, জানাল ব্যগটি কুড়িয়ে পাওয়ার কথা, আরো জানাল সে আসলে ভিতরে কি আছে তা দেখার জন্য খুলে একটা চিঠি পেয়েছে। আমাদের কাছে হয়তো এর কোন মুল্য নেই তবে যে এতো যত্ন করে এটা  রেখেছে তার কাছে হয়তো এর মূল্য অনেক বেশি। অফিসের লোকটি তাকে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল।

বিভাস বসে না থেকে যতটা পারা যায় ঘুরে ঘুরে জায়গাটা দেখছিলো। নিজেকে সে দেখতে পাচ্ছিল এরকম একটা জায়গায় সে থাকবে। বাড়িটা এদের দিয়ে দিলেই যতদিন সে বেঁচে থাকবে এরা তাকে দেখে রাখবে। কয়েকরকমের নিয়ম আছে এখানটায়, প্রতি সপ্তাহে বা মাসে টাকা দিলে হয় অথবা বাড়ি দিলেও হয়। বাড়ির মুল্য অনুযায়ী তার থাকার ব্যবস্থা হবে। তার বাড়িটি তখন এদের সম্পত্তি হয়ে যাবে।

বিভাস দেখল অফিসের লোকটি ধবধবে সাদা চুল ও সাদা ভুরুর একজন মানুষকে সাথে নিয়ে আসল। বয়স বুঝা যাচ্ছেনা, আশিও হতে পারে আবার নব্বই ও হতে পারে। ভদ্রলোক বিভাসে সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল আমি ক্রিস্টফার। জোসেফ আমাকে বলল তোমার কাছে  আমার সম্পত্তিটি আছে, বলেই সে অফিসের লোকটি দেখালো। জোসেফ বলল এবার তোমরা দুজনে কথা বল আমি অফিসের কাজ করি।

বিভাস ক্রিসকে বলল কি আছে তোমার মানিব্যাগে আর তোমার ব্যাগটি ই বা দেখতে কেমন। একটি মায়াময় হাসি দিয়ে বলল এ আমার মহামুল্যবান সম্পত্তি যা আমি গত সাতষট্টি বছরে একবারও হাতছাড়া করিনি। আমার বউ বাচ্চারা এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, এ আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। আমার বয়স চুরাশি বছর আমার সতেরো বছর বয়সে আমার হাইস্কুল সুইট হার্ট জোডি আমাকে ছেড়ে আমেরিকা পড়তে চলে যায়। যাওয়ার সময়ে সে আমাকে একটি মানিব্যাগ উপহার দেয়। কথাগুলো বলে সে একটা মিষ্টি লজ্জামাখা হাসি দিলো। বলল গত সপ্তাহে তার ছেলে ও ছেলের বউ এসেছিলো দেখা করতে, তারা তাকে পেস্তাসিয়ো রেস্টুরেনটে  খাওয়াতে নিয়ে যায়। তারপর তারা বুশি পার্কের ভিতরে নানা জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে।আশ্রমে ফিরে সে ব্যাগটি আর খুঁজে পায়নি।

হাত বাড়িয়ে ক্রিস বিভাসের একটি হাত দুহাতের  মধ্যে নিয়ে বলল আমি জানিনা সে বেঁচে আছে কিনা কিন্তু এ ব্যাগ ও চিঠি আমার কাছে  একদিনের জন্যও ম্লান হয়নি।সব সময় মনে হত জোডি আমার সাথেই আছে। গত আটদিন ধরে আমি প্রতিমুহুর্তে ভেবেছি আমার জোডি মরে গেছে। তুমি আমার জোডিকে ফিরিয়ে দিলে। বিভাস জানতে চাইল সে বিয়ে করেছে কিনা, বলল করেছে ও দুট ছেলে আছে। বউ তিন বছর হোল মারা গেছে, এরপরই সে এখানে চলে আসে। ছেলেদের বিরক্ত করতে চায়নি। ছেলেরা সপ্তাহে একদিন আসে বা ১৫দিনে একদিন আসে। খাবার নিয়ে আসে, বেড়াতে নিয়ে যায়, আমার জন্য এটাই যথেষ্ট। বিভাসের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল আজ থেকে তুমি আমার আর একজন আপনজন হলে, দেখতে এসো। বিভাস বলল আমি বুশি পার্কের উল্টোদিকে পার্করোডে থাকি, প্রতিদিনই এ পার্কে হাটি, আসবো।

ফিরে আসার পরে  ক্যান্সারের সেমিনারগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে আর যাওয়া হয়নি বৃদ্ধাশ্রমে।

এ পর্যন্ত গল্প বলেই বিভাস শেষ করল। আজ আমাদের সেমিনারের শেষ দিন তাই ডিনার আছে, একটু পরে ফারুক আসলো, সে একজন নিমন্ত্রিত অতিথী।

অনেকদিন বিভাসের সাথে দেখা হয়না, আমি প্রায় প্রতিদিনই একবার ক্যান্সার রিসার্চে যাই। কখনো ডাক্তার, কখনও রোগী, কখনো বা রিসার্চারদের সাথে কথা বলি। ক্যান্সার রিসার্চের কাছ থেকে বিভাসের টেলিফোন নাম্বার নিলাম। প্রতিদিনই একবার করে ফোন করি, কোন উত্তর নেই। ফারুক বলল এটা তো চিন্তার বিষয়, ভদ্রলোকের এখানে তেমন কেউ নেই।

আমরা একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম হেমটন কোর্ট বৃদ্ধাশ্রমে যাব। হেমটন কোর্টের বাইরের ফুলের বাগান আমাদের দুজনেরই পছন্দের জায়গা। সারাদিনের জন্য খাবার বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম।না বিভাসের কোন খোঁজ পেলাম না। তারা বললেন একজন ইন্ডিয়ান কিছুদিন আগে বেশ কয়েকবার এখানে এসেছিলেন তারপর আর দেখা যায়নি। ক্রিস্টোফারের সাথে দেখা করলাম, সেও অবাক কেনো আসছেনা। তার বাড়ির ঠিকানা কেউ জানেনা।

আবার পনেরদিন পরে একবার বিভাসের খোঁজ করতে গেলাম হেমটন কোর্ট বৃদ্ধাশ্রমে, শুনলাম সে এসে ঘুরে গেছে ও আমাদের দেয়া টেলিফোন নাম্বারটা নিয়ে গেছে।রাতে বিভাস ফোন করে  জানাল সে আমাদের সাথে দেখা করতে চায়। আগামীকাল রাতের খাবারের নিমন্ত্রন করে ঠিকানা দিলাম।

বিভাস প্রায় প্রতিদিনই যেত ক্রিসের কাছে। কি একটা আকর্ষণ সে অনুভব করত ক্রিসের  জন্য। ক্রিস বলছিলো একদিনের জন্য সে জোডিকে তার মন থেকে সরায়নি। বউ বাচ্চাদের জন্য তার দায়িত্ব পালনে কোন অনিহা ছিলোনা। সে ছিলো ভাল বাবা ও ভালো বর। বউকে সে সব কথা বলেছে, ক্রিস বলেছে আমি তোমায় ঠকাচ্ছি না, তবে জোডি আমার মাথার কোন একটা জায়গায় অবস্থান করছে। বিভাস ক্রিসের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলো। গত  পয়ত্রিসটা বছর সুধা তার মাথায় একটা জায়গা দখল করে আছে।

বিভাস বলল, ক্রিস তাকে বলেছিল, একবার যদি জোডিকে দেখতে পারতাম হয়তো মারা  যাওয়ার আগে আমি ভালো থাকতাম। প্রতিদিন কিভাবে যে আমি তাকে দেখতে চাই তা কাউকে বুঝাতে পারিনা।পড়া শেষ করলাম, বিয়ে করলাম, বাচ্চাদের দেখাশুনা করলাম, কিন্তু এ মেয়েটাকে আমি ভুলতে পারছিনা কেন, এ একটি বিস্ময় আমার জীবনে।

বিভাস জানে শুধাকে সে আর কখন সে দেখবেনা। তাকে সে নিজের হাতে পুড়িয়েছে। কিন্তু  জোডিকে সে একবার খুঁজে দেখতে পারে। নিজের কষ্টটা প্রশমিত হলেও হতে পারে। কর্নওয়েলের মেয়ে জোডি, ওখানকার সমুদ্রের মতই উচ্ছল ও আকর্ষনীয় ছিল। সমুদ্রের পাড়ে জোডির বাড়ি ছিল। আমেরিকা যাওয়ার আগে তারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে যায়। জোডির মা-বাবার ছাড়াছাড়ি  হয়ে যাওয়ার পরে জোডি আর ফিরে আসেনি। বহু বছর পরে একবার এসে জোডি  বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় দক্ষিন ফ্রান্সে। বাড়ি বিক্রির সময় এজেন্টের কাছে ফ্রান্সের যে ঠিকানা সে দিয়েছিল বিভাস তাই খুঁজতে গিয়েছিল।  সেখানে গিয়েও জোডিকে পাওয়া গেলোনা। পাঁচ বছর আগে জোডি অসুস্থ হয়ে পড়াতে ফ্রান্সের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ফিরে আসে ইংল্যান্ডে।  এপর্যন্ত বলে বিভাস থামল। বাকি গল্প তোমাদের আমি দেখাতে চাই। কাল তিনটায় এসো পেস্তাশিয় রেস্টুরেন্টে।

একজন প্রবীন মহিলা হুইল চেয়ারে  বসে আছেন, বয়স্ক এক ভদ্রলোক পেস্তাশিয় রেস্টুরেন্টের চেয়ারে বসা, পাশের আর একটা চেয়ারে বিভাস। আমরা কাছাকাছি যাওয়াতে বিভাস দাঁড়িয়ে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। ফারুক ওদের সাথে হাত মিলিয়ে বসে গেলো একটা চেয়ারে, আমি হাত মিলাতেই ভুলে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না এ কি করে সম্ভব। বিভাসের চেহারায় দেখলাম একটি নিশ্চয়তার ভাব। জোডি হাত বাড়িয়েই ছিল, বলল খুব অবাক হয়েছো মেয়ে, কখনও আশা ছাড়তে নেই।  আমি জানতাম ক্রিসের সাথে দেখা আমার হতেই হবে।

বললাম বিভাস, কি বিষয়। হাসছে বলেছিলাম গল্প দেখাবো, কেমন দেখছ? বাংলায় বলল কাল তোমাদের আমার বাড়িতে নিমন্ত্রন, সুধার সামনে বসে ডাল ভাত খেতে খেতে বাকি গল্পটা শেষ করব।

আমার চাষের জমির ঠিক উল্টোদিকে বিভাসের বাড়ি। বললাম বিভাস তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমি সপ্তাহে একবার রাস্তা পাড় হয়ে ওপারে আমার জমিতে ঢুকি। বিভাস হাসতে হাসতে বলল, ফারুক তোমার বউ ও তার বন্ধুরা মিলে এপ্রিল-মে মাসে জঞ্জাল পোড়ানোর  যত ধুয়া আমাদের খাওয়ায় তা তুমি চিন্তাও করতে পারবেনা। বললাম মামলা কর,  বলল কোন কাজ হবেনা, তোমরা রাজপরিবারের সদস্য, বুশি পার্কের হরিণগুলোর মতো তোমরা ধরা ছোয়ার বাইরে।

সজনে ও পাঁচ ফোঁড়ন দিয়ে ঘন করে রাঁধা মুসুরীর ডাল, মাগুর মাছের ঝোল, নানাজাতীয় সবজি একসাথে ভাজা ও ভাত। খাওয়ার পরে টক দই, পুডিং। এ ছিলো আমাদের আজকের খাবার। একটি চারকোনা টেবিলের চারদিকে চারটা চেয়ার, একদিকে একজন ইন্ডিয়ান চেহারার মেয়ের নানা পোশাকের ছবি একটা দেয়াল জুড়ে আছে। বুঝলাম এই সুধা। ছবি ভর্তি দেয়ালটার উল্টোদিকে চমৎকার একটি বার পাশে থালাবাসন রাখার আলমারি। বাকি দরজা জানলা বাদ দিয়ে বইয়ে ঠাসা  একটি ঘর। বইয়ের আলমারির পাশে একটি একজনের বসার সোফা। বিভাস বলল এঘরের প্রতিটা ইঞ্চিতে সুধা জড়িয়ে আছে, আমি কিছুই পাল্টাইনি।

খাওয়া শেষে বিভাস বলল তোমরা বসার ঘরে যাও, আমি টেবিল গুছিয়েই, চা নিয়ে আসছি। আমি সাহায্য করতে চাওয়াতে বলল এ আমার নিত্য দিনের কাজ। রান্নাটাও সুধার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে প্রতিদিন সে আমায় শিখাত। সব সময় বলত রাতের খাওয়াটা হতে হবে হাল্কা কিন্তু রুচি সম্মত। চলে যাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সে একটা কথাই বলত ফাঁকি আমায় দিবেনা, ঠিকভাবে খাবে, তবেইনা আমি জানব তুমি ভাল আছ।

জোডির স্ট্রক করার পরে নিচের দিকটা একদম অচল হয়ে যায়। হুইল চেয়ার ছাড়া আর  উপায় হলনা। একটু সুস্থ হওয়ার পরে ফ্রান্সে আর থাকতে ইচ্ছা হলোনা। সে দেখতে শুরু করল তার বাল্যকাল, ক্রিস ও অন্যান্য সহপাঠিদের। চোখে ভাসতে থাকল কিংস্টন গ্রামার স্কুল, তাদের কিন্সটনের বাসা, হেমটন কোর্ট, বুশিপার্ক, রিচমন্ডপার্ক। তার দৃষ্টি সিমানা থেকে হারিয়ে গেছে মাঝের অনেকগুলো বছর। ফরাসি বন্ধুর ঘরে তার একটি ছেলে আছে সে মাঝে মাঝে এসে মাকে দেখে যেত। তাদের ছাড়া ছাড়ি হয়ে যাওয়ার পরে ছেলেকে হোস্টেলে দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে সে মায়ের সাথে থাকত, তবে তার ফরাসির ভাগটা শক্তশালী হওয়ার  কারনেই মায়ের সাথে অতো আন্তরিক ছিলনা। কিছুটা হলেও ব্রিটিশদের সে ঘৃণা করত। ছেলের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করল ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে। ছেলে তাকে রিচমন্ডের সবচেয়ে দামি আশ্রমে থাকার ব্যবস্থা করে দিল।

বিভাস তার স্বাভাবিক বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিয়েছে জোডি বেঁচে থাকলে হয় যাবে তার কৈশর  বেলার জায়গা  কর্নোয়েলে বা তার শৈশবের যায়গা কিংস্টন বা রিচমন্ড। বিভাসের হাতে ছিলো জোডির জীবন ইতিহাসঃ কর্নোয়েল, কিন্সটন গ্রামার স্কুল, আমেরিকা, ফ্রান্স ও ফিরে আসা ইংল্যান্ডে। বিভাস কিন্সটন ও রিচমন্ড বারার সবগুল বৃদ্ধাশ্রমের নাম ঠিকানা নিয়ে খুঁজতে শুরু করল। রিচমন্ড্ দ্বিতীয় আশ্রমটি যা কিনা রিচমন্ড পুলের সাথে নদীর দিকে মুখ করে আছে, সেখানেই পেয়ে গেল জোডিকে। মিলে যাচ্ছিল জোডির কথা ক্রিসের সাথে। কদিন পরে বিভাস একটি প্রস্তাব দিলো জোডিকে, বলল তুমি ক্রিসের সাথে দেখা করতে চাও। জোডি ভুলে গেলো তার ব্রিটিশ আবেগহীনতার কথা, ফিরে গেলো তার আমেরিকান ও ফরাসী কালের আবেগঘন জীবনে। কেঁদে ফেলল, বলল কোথায় ক্রিস, সেকি আমায় মনে রেখেছে। বিভাস কিছুই না বলে সেদিন ফিরে আসলো।

বিভাস রাতের খাবারের পরে সুধার ছবির সামনে বসে বলল সুধা তুমি আমায় আর কিছুটা শক্তি যোগাও, আমি যেন একাজটি করতে পারি। একই বারার মধ্যে হওয়াতে তেমন কোন বেগ  পেতে হয়নি, যদিও রিচমন্ড আশ্রম তাদের আয়টা ছাড়তে চাচ্ছিল না। বিভাস মানবিক কারণ দেখিয়ে ব্যবস্থা করেছে।

তিনদিন হল বিভাস জোডিকে রিচমন্ড থেকে হেমটন কোর্ট আশ্রমে এনেছে। এরা নিচতলাতেই জোডির থাকার ঘরের ব্যবস্থা করেছে। দুজন মানুষ জোডিকে দেখে রাখে। যেদিন সে জোডিকে এখানে এনেছে সেদিন বিকালেই সে ক্রিসের সাথে দেখা করল। বলল চল তোমায় একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দি। ক্রিস বিভাসকে দেখে অভিযোগ করল, কোথায় ছিলে, আসনি কেন? বিভাস বলল সব উত্তর একসাথে দিব চল নিচে যাই।

হলঘরে ক্রিস্কে বসিয়ে সে জোডিকে আনতে গেল। জোডিকে নিয়ে আসলো তার একজন কেয়ারার। বিভাস  কেয়ারারকে বললাম তুমি চলে যাও জোডি এখানে থাক। বলল ক্রিস তাকাও এদিকে দেখ কে! ক্রিস দাঁড়িয়ে গেলো,  বয়সের ভারে ঝুলে পড়া বলিরাখা যুক্ত মুখটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল সাতষট্টিটা বছর একটুও পাল্টাওনি, কেমন আছ জোডি! জোডি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল। আমি আর সেখানে থাকিনি।

জোডি আর ক্রিস এখন একই আশ্রমে থাকে। প্রতিবেলায় খাওয়ার সময়, টিভি দেখার সময় তাদের দেখা হয়। ওরা এখন হুইল চেয়ারে করে ছেলেবেলার মতোই হেমটন কোর্টে ঘুরে বেড়ায়। ওরা যখন বেড়াতে যায় তখন কেয়ারার থাকে  কিন্তু তারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে ওদের এক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে। তিনজন কেয়ারার ওদের দেখাশুনা করে। বাকি দায়িত্ব আশ্রমের। ওদের কাছে আমার অবাধ গতি, যা ওদের ছেলেমেয়েদেরও নেই। এবার আমি ভাল আছি, তোমাদের মতো আমার আরো দুজন মানুষ আত্মীয় হল। সুধাকে এ প্রবীন বয়সে কাছে না পাওয়ার কষ্টটা আর নেই। একাজ আমি সুধার জন্যই করলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি তাকে ফিরিয়ে আনতে পারতাম, এইযা!

আমরা প্রায় রাত শেষে বাসায় উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম, কোথাও কোন জনমানব নেই, একটা দুটো শিয়াল এদিক সেদিক ঘুরছে, আমাদের দেখে দৌঁড়ে পালাচ্ছে। আমরা কিংস্টন ব্রিজের নিচে নেমে থেমসের পানিতে পানিতে পা ভিজিয়ে বসলাম।