আ’লীগের তাৎপর্য বুঝতে হলে, বুঝতে হবে সেক্যুলারিজমের তাৎপর্য -কাজী তানভীর হোসেন
আওয়ামী লীগ বিপদগ্রস্ত সময় পার করছে। জনগণ বিক্ষুব্ধ। ডজন-ডজন বিরোধী পার্টি জনগণের বিক্ষোভে সাধ্যমতো উষ্কানি দিচ্ছে। বিরোধী পার্টিগুলোর জোটের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আওয়ামী লীগের হারানো ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বড় সম্ভাবনা রয়েছে বিএনপির। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই বিপদগ্রস্ত পরিস্থিতিকে আমরা কি বলব? পরিস্থিতিটি কি জনজীবনের সংকটকে লাঘব করতে সহায়ক হবে নাকি সংকটকে বাড়িয়ে তুলবে? আমার এই রচনাটি প্রস্তাব করে যে, এটা সত্যিই জনগণের সংকটকে বৃদ্ধি করে ফেলার মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি।প্রতিটি আন্দোলন হল বৃহত্তর পরিসরে আহাজারি। আহাজারি করার পূর্বশর্ত হল আকাঙ্খার মৃত্যু। আকাঙ্খার মৃত্যু হলেই মানুষ বিক্ষুব্ধ হয় এবং বিক্ষোভ প্রকাশের পথ খোঁজার চেষ্টা করে। আজ বৃহত্তর আন্দোলনগুলো দেখে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জীবনকে উপলব্ধি করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি জনজীবন আজ কতটা বিপর্যস্ত! আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমাদের প্রধান কয়েকটি বিপর্যয় হল- মজুরি হ্রাস, শিশুশ্রম, যুদ্ধ, শ্রমিক ছাঁটাই, বেকারত্ব, একাকীত্ব, পারিবারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে ভাঙণ, ধর্ষণ ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ ইত্যাদি ইত্যাদি।
জীবনের সংকট-সমূহকে আমরা যারা জ্ঞানতাত্ত্বিক দিক থেকে জানার চেষ্টা করি, তারা বর্তমান অর্থনৈতিক সিস্টেমের গর্ভে সমাজের প্রধান সমস্যাগুলোর ভ্রুণ খুঁজে পাই। কারখানায় উৎপাদন ঘটে, উৎপাদিত পণ্য বাজার দখল করে। এটাই আজকের সারাবিশ্বের অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু কী ঘটে যখন শত শত সাবানের কোম্পানি চায় নিজেদের সাবানটি বাজার দখল করুক! এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে প্রতিটি কোম্পানি প্রথমেই যা করে তা হল কম দামে পণ্য বিক্রির জন্য পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে হয়। তাই হ্রাস করতে হয় শ্রমিকের মজুরি। অথবা কম দামের মজুর বা শিশুশ্রমিক নিয়োগ করা হয়। অতএব, মজুরি হ্রাস ও শিশুশ্রম স্থানীয় রাজনীতির নয়, বরঞ্চ বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট।
তারপর কী ঘটে? সমস্ত বাজার সাবানে ভর্তি। মজুরি হ্রাস হওয়ার কারণে শ্রমিকরা আগের মতো সাবান কিনতে পারেনা। তাই বিক্রিও কমে গেছে। বাজারে জমে গেছে সাবান। সাবানের ভেতর জমে গেছে শ্রম। অতএব, শ্রমের চাহিদাও কমে গেছে। তাই এবার হচ্ছে শ্রমিক ছাঁটাই। অতএব এখানে বেকারত্ব তৈরী হচ্ছে। অতএব, বেকারত্বও স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যার্থতা নয় বরঞ্চ, বৈশ্বিক অর্থনীতির ব্যার্থতা।
বিশ্ব বাজারে যখন পণ্য জমে যায়, তখন কারখানার মালিক তার উৎপাদন খরচও পায় না। তাই যেকোনোভাবে সে চায় বাজারে পণ্যের চাহিদা তৈরী করতে। চাহিদা তৈরী করার জন্য প্রয়োজন সংকট সৃষ্টি করা। সংকট সৃষ্টি করার উপায় হল উৎপাদিত পণ্যগুলো ধ্বংস করা। তাই পণ্যের মালিকদের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। নির্দিষ্ট ভূখন্ডের পুঁজিপতিদের জোট হল রাষ্ট্র। এক-রাষ্ট্রের পুঁজির মালিকেরা অপর রাষ্ট্রের পুঁজির মালিকের পণ্য ধ্বংস করে দিতে চায়, যাতে বিশ্ববাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তাই ঘটে যুদ্ধ। অতএব যুদ্ধ স্থানীয় রাজনৈতিক সংকট নয় বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট।
এবার আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরতে চাই। তার আগে আমরা জানতে চাই সমাধানের কোনো পথ আছে কিনা। প্রত্যেক প্রাণী টিকে থাকতে চায়, তাই উপযোগী জিনিসকে সে রক্ষা করতে চায়। মানুষ ভালোবাসতে চায়। কিন্তু এই দোকানদারিমূলক সমাজে ভালোবাসাও টিকে না। লাভ-লোকসানের হিসেব চলতে থাকে প্রেমাষ্পদের মধ্যে। তাই তারা হয়ে ওঠে আলাদা আলাদা ব্যাবসায়ী। সঙ্গ দেওয়ার বিনিময়ে পণ্যের মালিক হওয়ার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। আজ দোকানদারিমূলক সমাজে প্রত্যেকে যখন একে-অপরের শত্রু, তখন টিকে থাকার জন্য কেউ কারো উপযোগী নয়। তাই কাউকে রক্ষা করার দ্বায়বোধ কেউ করে না৷ ব্যাক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ করে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ফলে সমাজের মধ্যকার ব্যাক্তিগত মালিকানা দ্বারা তৈরী হওয়া আলাদা আলাদা স্বার্থের অর্থনীতির স্থলে তৈরী হবে একক স্বার্থ, তাই নিশ্চিতভাবেই বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটবে। এখানে প্রতিযোগিতার স্থলে থাকবে সহযোগিতা। এই সমাজকে আমরা বলি সমাজতন্ত্র। সমাজের সমৃদ্ধির জন্য পণ্যের অতি উৎপাদন প্রয়োজনীয় শর্ত। অথচ ব্যাক্তিগত মালিকানার ফলে অতি উৎপাদনই হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারত্ব, চাকুরিচ্যুতি, যুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতা, শিশুশ্রম ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্যার কারণ। অতএব ব্যাক্তিগত মালিকানার অবসানের সাথে জড়িয়ে আছে মানব জাতির মুক্তির প্রশ্ন।সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদ্ধতিটি কী? আজকের ব্যাক্তিগত মালিকানার সমাজ টিকে থাকার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল উৎপাদন। আর এই উৎপাদন সংঘটিত করে শ্রমিকেরা, যারা বর্তমান সমাজে সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত, উপেক্ষিত, ক্ষতিগ্রস্ত এবং এরাই আকাঙ্ক্ষাগুলোকে সবচেয়ে বেশি দমন করে। তাই এরা বিক্ষুব্ধ। আন্দোলন সংগ্রামে অধিকাংশই থাকে শ্রমিক। তাহলে সমাজতন্ত্রের জন্য এই শ্রমিকেরা কোন পথে বিক্ষোভ প্রকাশ করবে? বিক্ষোভ প্রকাশের পথ আছে অনেকগুলো। ভাঙচুর, হাত কাটা, মাদক-সেবন, আন্দোলন-সংগ্রাম ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন পথে বিক্ষোভ প্রকাশ করলে হবে বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ? কোন পথে হবে সমাজতন্ত্র? কোন বিক্ষোভ সমাজে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার? ব্যাক্তি সম্পত্তির স্থলে সামাজিক সম্পত্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য দরকার উৎপাদিত পণ্যের মালিকানা থেকে পরজীবীদেরকে বর্জন করা। অতঃপর সবাই মিলে একটি সমিতি নির্মাণ করবে, যেখানে সামর্থ্য অনুযায়ী উৎপাদন করবে প্রতিটি ব্যাক্তি এবং প্রত্যেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাবহার করবে। আর এই কাজটি খুবই সহজ যখন উৎপাদনকারী মজুরেরা একতাবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কারো সাথে কারো ব্যাক্তিগত বিরোধের জন্য থাকবেনা ব্যাক্তিগত মালিকানা বরঞ্চ মানবপ্রজাতির অভিপ্রায় আছে অপরের থেকে সহানুভূতির। অতএব অপরকে টিকিয়ে রাখাও নিজে টিকে থাকার শর্ত, বিচ্ছিন্নতা অবসানের শর্ত। অতএব সম্পত্তির সামাজিক মালিকানার সমাজ সহযোগিতা-পূর্ণ বলে সমাজের প্রত্যেকে উদ্বেগমুক্ত ও সুখী, যদি কেউ উৎপাদন করতে অক্ষম হয়, তার জন্যই একই সুবিধা প্রযোজ্য।
তাহলে আজ সমাজতন্ত্রের আন্দোলন কিভাবে করতে হবে? পহেলা মার্চ ১৯৪৭ সালে আইএমএফের কার্যক্রম শুরু হওয়ার মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারের সুস্পষ্ট ভিত্তি স্থাপন হয়। অতএব জাতীয় বাজারের নীতিনির্ধারকেরা স্বাধীন নয়৷ অতএব, প্রথমত সমস্যাগুলো বৈশ্বিক বলেই স্থানীয় ভাবে সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো সুযোগ নেই৷ এটা করতে হবে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকেরা একতাবদ্ধ হয়ে। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকেরা একতাবদ্ধ হওয়ার জন্য দরকার একটি বিশ্বব্যাপী পার্টি। এরকম কোনো পার্টি সারাবিশ্বে কোথাও আছে কিনা আমি জানিনা। থাকলেও সেই পার্টি আজকের সংকট মোচন করতে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদেরকে সমাজতন্ত্রের জন্য একতাবদ্ধ করার সামর্থ্য আছে কিনা সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন৷ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়তো সেই দায়িত্ব কোনোদিন নিতে চাইবেনা। তাহলে আমাদের এই মূহুর্তে কি করা উচিত?
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য এই মূহুর্তে আমাদের নেই। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, কারোরই সেই সামর্থ্য ও ইচ্ছা নেই। কিন্তু যারা এদেশে থাকবেন কিংবা আগামীদিনে এই অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইবেন, তারা এই দুই দলের থেকে এমন একটি দলকে বেছে নিতেই হবে, যে দলের সাথে সমাজতান্ত্রিক স্লোগান তুলনামূলক অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। তাই প্রশ্ন দেখা দেয়, আজ আওয়ামী লীগ বিরোধী সংগ্রামের বৈধতা নিয়ে। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মানে হল বিএনপি ক্ষমতায় আসীন হওয়া। জনগণ বলছে বিএনপি-শাসনামলে দূর্নীতি কম হবে। বিএনপি কোত্থেকে সততার সার্টিফিকেট নিয়েছে তা আমি জানিনা। অধিকাংশ মানুষ এখনও নিজের গ্রহের, নিজের গ্যালাক্সির ও নিজ জীবনের ইতিহাস জানেনা। অতএব জনগণের মতামত খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কি ঘটবে? মৌলবাদী ভাবাদর্শের জাতক বিএনপি-জামাত জোটের সমস্ত আক্রমণ নেমে আসবে সংখ্যালঘুদের উপর। দিনের আলোয় দূর্ঘটনা তো ঘটাবেই, সেই দূর্ঘটনাকে “দূর্ঘটনা” বলে স্বীকারও করবেনা। গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে বলবে “উচিত শিক্ষা হয়েছে”। হাতের কব্জি কেটে দিলে বলবে “এটাই দরকার ছিল”। যখন মাশা আমিনিকে হত্যার খবর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছিল, তখন প্রকাশ করা এদেশের জনগণের উগ্রবাদী ভাবনার স্বাক্ষী আছে সেই নিউজের কমেন্ট বক্স। অতএব, জনগনের কথামতো শিক্ষাব্যবস্থাকে, বিচার ব্যাবস্থাকে, সবকিছুকে মৌলবাদীদের হাতে তুলে দেওয়া শেষ বিচারে জনগণের জন্যই ক্ষতিকর। শুরু থেকে আহাজারি কম হয়নি। জ্বালাও-পোড়াও, যুদ্ধ-বিদ্রোহ অনেক হল। কিন্তু আগুন কমার বদলে বেড়েছে। এর দ্বায় কে নেবে?
আওয়ামী লীগের এই দূর্দিনে আওয়ামী লীগের তাৎপর্য বুঝতে হবে আওয়ামী লীগের গাঠনিক ইতিহাস দিয়ে। জাতীয় পুঁজির মালিকদের সাথে উপনিবেশিক শাসকদের বিরোধী সংগ্রামে সংস্কারমূলক দাবি-দাওয়ার ফলে স্থানীয় শ্রমিকেরা জাতীয় পুঁজিপতিদের মুক্তির সংগ্রামে জড়িয়ে যায়। জাতীয় পুঁজপতিদের মুক্তির পর কি ঘটে? যেখানে শ্রমিকেরা প্রতিদিন কাজ করে পাঁচ-কেজি চাউল কিনতে পারতো, জাতীয় পুঁজিপতিদের মুক্তির যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির দোহাই দিয়ে মজুরি হ্রাস করার ফলে তিন-কেজি চাউল কেনাটাও কঠিন হয়ে গেলো। অতএব প্রতিটি মুক্তি প্রতিদিন প্রতি-শ্রমিক থেকে দুইকেজি করে চাউল খেতে শুরু করলো। এই সংগ্রাম সোভিয়েত ইউনিয়নে দেখতে পেলাম, পরপর কিউবা, ভিয়েতনাম, চীন, ভেনেজুয়েলা, মায়ানমার, বাংলাদেশেও একই রাজনীতির চর্চা হয়েছিল। সেই চর্চার ধারাবাহিকতায় ৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুঁজির মালিকেরা স্বাধীনতা লাভ করলো। শেখ সাহেবের আকাঙ্খার প্রতিফলন পাওয়া যায় ৭২ সালের সংবিধানে। চারটি মূলনীতির উপর ৭২ সালের গঠিত হয় : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বৈশ্বিক অর্থনীতির যুগে বিশ্বব্যাপী সম্পত্তির সামাজিক মালিকানার তথা সমাজতন্ত্রের সাথে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক খুঁজে পেতে হলে আমরা সোভিয়েত অভিজ্ঞতার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হয়। ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে একটা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয় পুঁজি গঠন করে। এর আগে ১৮৯৬ সালে লেনিনের লেখা “আসন্ন বিপর্যয় ও কিভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে” নামক পুস্তকে লেনিন সাহেব ঘোষণা করেন, “সমাজতন্ত্র আর কিছুই নয়, একচেটিয়া রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ ছাড়া”। সেই চর্চাটিই শুরু হয়েছে সোভিয়েত থেকে। পরবর্তীতে স্ট্যালিনের শাসনামলে “একদেশে সমাজতন্ত্র” শব্দটি আরও বেশি করে চর্চিত হয়। এ শিক্ষাটা নিয়েছেন চীনে মাও সেতুং, উত্তর কোরিয়ায় কিম, ভিয়েতনামে আংকেল হো-চি-মিন৷ কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো, মায়ানমারে অং সান, আর বাংলায় শেখ সাহেব। লেনিন সাহেব সোভিয়েতে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার দোহাই দিয়ে একটি কেন্দ্র হতে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন। শুরু হয়েছিল বলশেভিক পার্টির একনায়কতন্ত্র। একই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশেও। শেখ সাহেব তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরিয়ে নিজে হন প্রধানমন্ত্রী। গড়ে তোলেন বাকশাল। শুরু হয় পার্টির একনায়কতন্ত্র। আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতায় বাংলাদেশের লেনিনবাদীরা আওয়ামী লীগ বিমুখ, কিন্তু সোভিয়েত পন্থী। কারণ, সোভিয়েতকে তারা সামনে থেকে দেখেনি, শুধুমাত্র গাল-গল্প শুনেছেন। আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার ইতিহাস হল লেনিনবাদী আকাঙ্ক্ষার ইতিহাস। শেখ সাহেব ছিলেন বাংলার লেনিন। যে রবীন্দ্রনাথ শুরুতে সোভিয়েতের প্রশংসায় কলম ধরেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথই সোভিয়েতকে সামনে থেকে দেখে ৩১ জুলাই ১৯৩১ সালে একটি চিঠিতে লিখেছেন, “ নীতু, …জার্মানিতে ব্যাভেরিয়ার ভাবগতিক ভালো লাগছে না। যেখানে দারিদ্রে মানুষ দূর্বল সেখানেই যেমন মারি মোড়ক জোর পায় তেমনি আজকালকার ইউরোপে দুর্ভিক্ষ যতই ছড়িয়ে পড়েছে, ততই ফ্যাসিজম এবং বলশেভিজম জোর পেয়ে উঠছে। দুটোই অস্বাস্থ্যের লক্ষ্মণ। মানুষের স্বাধীন বুদ্ধিকে জোর করে মেরে তার উপকার করা যায় -এসব কথা সুস্থচিত্ত লোকে মনে ভাবতেই পারেনা৷ পেটের জ্বালা বাড়লে তখনই যত দুর্বুদ্ধি মানুষকে পেয়ে বসে। বলশেভিজম ভারতে ছড়াবে বলে আশঙ্কা হয়—কেননা অন্নকষ্ট অত্যন্ত বেড়ে উঠেছে— মরণদশা যখন ঘনিয়ে আসে তখন এরা যমের দূত হয়ে দেখা দেয়। মানুষের পক্ষে মানুষ যে খুব ভয়ংকর তা দেখলে শরীর শিউরে ওঠে— মারের প্রতিযোগিতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে সেই চেষ্টায় আজ সমস্ত পৃথিবী কোমর বেঁধেছে…। …আর যাই করিস, খবরদার এই মানুষখেকো দলের সঙ্গে মিশিস নে। ইউরোপ আজ নিজের মহত্বকে সব দিকেই প্রতিবাদ করতে বসেছে৷ আমাদের দেশের লোক—বিশেষ বাঙালী— আর কিছু না পারুক, নকল করতে পারে— তাদের অনেকে আজ ইউরোপের ব্যামোর নকল করতে লেগেছে। এই নকল মড়কের ছোঁয়াচ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলিস। নিশ্চয় তোদের ওখানে এই সমস্ত দানোয়-পাওয়া ভারতবাসী অনেক আছে, তাদের কাছে ভিড়িস নে, আনমনে কাজ করে যাস। ইতি দাদামশায়।” হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামকে নকল করতে চেয়েছিল। জাতীয় পুঁজির মালিকদের মুক্তির সংগ্রামের নাম যদি হয় সমাজতন্ত্র, তাহলে শেখ সাহেব ছিলেন সফল সমাজতন্ত্রী। বিশ্বব্যাপী এই ধরনের জাতীয় সমাজতন্ত্রের জন্য যুদ্ধের সংস্কারের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সারাদুনিয়ায় বিশ্ব-সমাজতন্ত্রের পক্ষে থাকা লোকেরা এবং সাধারণ মানুষ ব্যাক্তিমালিকানা বিরোধী সংগ্রাম থেকে সরে গিয়ে জড়িয়ে পড়েন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধে। তারপর এক অঞ্চলের শ্রমিক কর্তৃক অপর অঞ্চলের শ্রমিক হত্যা, নতুন জাতি-রাষ্ট্র গঠন ইত্যাদি ইত্যাদি করে জাতীয় পুঁজির মালিকেরা স্বার্থ উদ্ধার করেছে আর জনদূর্ভোগ কেবল বেড়েই চলেছে। যারা তৎকালে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে তাদেরকে প্রতিবিপ্লবী ও বিপ্লববিরোধী আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাদের লেখাপত্র পুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই হল শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির আন্দোলন ধ্বংসের ইতিহাস। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ হল মানবজাতির মুক্তির আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর আদর্শিক স্রোত। এই স্রোতে ধামাচাপা পড়েছে সংগ্রামের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি। অতএব, গণমুক্তির আন্দোলন পুনর্গঠন আবশ্যক অন্তত লেনিনবাদী পদ্ধতির বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ায়।