বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭৮):  শিক্ষার শিখা জ্বলে উঠুক

-বিজন সাহা

১৯৭১ সালে যখন গ্রাম থেকে দূরে পালিয়ে দিন কাটাচ্ছি মিলিটারির ভয়ে, বাবা কাকাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম “রাখে হরি মারে কে?” বা “ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।” সেই সময়ে ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল বিধায় এসব সত্যি মনে হত। পরে বিশ্বাসে ঘুন ধরেছে, তবে এসব কথা ভিন্ন ভাবে নিজের জীবনে স্থান পেয়েছে। কি সেটা? সব কিছুর মধ্যে পজিটিভ কিছু খোঁজা। আমার শিক্ষক শিকিন বলতেন
– বিজন, পদার্থবিদ্যায় নেগেটিভ রেজাল্ট বলে কিছু নেই, মানে নেগেটিভ রেজাল্টও একটা রেজাল্ট। কেননা তাহলে তুমি অন্তত জানতে পার ভবিষ্যতে কোন পথটা এড়িয়ে চলতে হবে।
কথাটা ঠিক যদি আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই। তবে যেহেতু ব্ল্যাক হোলও আলো বা শক্তি বিকিরণ করে (হকিং রেডিয়েশন) তাই এটুকু বলা যায় ভালো আর মন্দ পাশাপাশিই বাস করে, ভালোর মধ্যেও খারাপ যেমন থাকে তেমনি খারাপের মধ্যেও ভালো। সেটা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর আর কোন পরিবেশে বা কোন পরিসরে আমরা কোন কিছু দেখছি তার উপর। এটা অনেকটা গ্লাস অর্ধেক ভরা নাকি অর্ধেক খালি সেটা যেমন নির্ভর করে যে দেখছে তার উপর।

গত কয়েকটি পর্বে আমরা ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেছি। কেন সেই যুদ্ধ, এই যুদ্ধের সাথে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মিল কোথায় সেটা বলেছি। এই যুদ্ধের লাভ ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে  আমরা দেখেছি কিভাবে ক্যাপিটাল ইউরোপ থেকে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এসব দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আগামী ৭ – ৮ পর্বে আমরা যুদ্ধের আরেকটি দিক নিয়ে কথা বলব। তবে সেই যুদ্ধ বহু পুরাতন আর তাতে সারা বিশ্ব জড়িত। আমরা বলব ফাইনানশিয়াল ক্যাপিটালের পরিবর্তে হিউম্যান ক্যাপিটালের কথা – কিভাবে সারা বিশ্ব থেকে আজ এসব দেশে মেধা পাচার হচ্ছে আর এ প্রসঙ্গে বার বার আসবে ইউক্রেনের যুদ্ধ।

যুদ্ধ নিঃসন্দেহে একটা খারাপ জিনিস, সবকিছু রসাতলে নিয়ে যায়। কিন্তু রসকষহীন যুদ্ধ চাইলেই কি সব কিছু রসের অতলে ডোবাতে পারে? নাকি একে ঘিরেও জন্ম নেয় নতুন বাস্তবতা? এক অর্থে এটাও কি এক ধরণের ফেজ ট্র্যাঞ্জিশন নয়? এই যেমন ধরুন বরফ গলে জলে বা জল জমে বরফে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা গুনগত পরিবর্তন লক্ষ্য করি? জলকে শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করলেই বরফ মিলবে না, তাকে আরও বেশ পরিমাণ তাপ হারাতে হবে, তবেই না জল জমে বরফ হবে। এই তাপকে বলে সুপ্ত তাপ। একই ঘটনা ঘটবে বরফ গলে জল হবার ক্ষেত্রেও। যদি প্রথম ক্ষেত্রে এই ফেজ ট্র্যাঞ্জিশনে আমরা তাপ পাই, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাপ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু যে কথাটা সত্য তা হল যেকোনো ফেজ ট্র্যাঞ্জিশনেই অতিরিক্ত শক্তি উৎপন্ন বা ধ্বংস হয়। প্রায় একই ভাবে বলা চলে যে যখনই একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এই অতিরিক্ত শক্তির উদ্ভব বা ক্ষয় হয় তখন এ ধরণের ফেজ ট্র্যাঞ্জিশনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। জলের ক্ষেত্রে এটা শূন্য বা একশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর যেহেতু যুদ্ধ মানেই শক্তির খেলা – যেকোনো যুদ্ধই সমাজে বিভিন্ন পরিবর্তন নিয়ে আসে আর উপযুক্ত পরিবেশে আনে গুণগত পরিবর্তন।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে যখন পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সব ধরণের যোগাযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায় তখন রুশ সরকার ঘোষণা করল যে তারা বোলন সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসবে। এই সিস্টেম চালু হয় নতুন রাশিয়ায় আমার চোখের সামনেই। এর বিরুদ্ধে তখনই অনেকেই কথা বলেন। তবে নিয়তির কি পরিহাস যে যারাই এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বা সোভিয়েতপন্থী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হ্যাঁ, দেশ যতই গণতান্ত্রিক হয় দেশের ক্ষমতাসীন দল তত বেশি জোরালো ভাবে নিজেদের চিন্তা ও কাজের সঠিকতা প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লাগে। স্ট্যালিন আমলে ছিল গণশত্রু, এখন ভিন্ন নামে। তখন সব হত গোপনে, এখন প্রকাশ্যে, রেডিও টিভিতে – প্রাইম টাইমে, যাতে সারা দেশ শুধু নয় সারা বিশ্ব দেখতে পায় প্রতিবাদকারীরা কি ভয়ংকর। সেটা রাশিয়ায় শিক্ষানীতি নিয়েই হোক আর আমেরিকায় ক্যাপিটলি আক্রমণ নিয়েই হোক। যাই হোক, নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রাশিয়ায় কখনই বিতর্ক শেষ হয়নি, এমনকি মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি সহ বেশ কিছু নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগের মতই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা চালিয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু পরিবর্তন শুরু হয়েছে স্কুল থেকে তাই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব পড়েছে।

আসুন আগে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু জেনে নিই। সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার পাশাপাশি নতুন মানুষ গড়ার পাঠশালা হিসেবে কাজ করবে – এটাই ছিল মূল ধারণা। সে শিক্ষা ছিল ব্যক্তি চরিত্র গঠন ও  লালন-পালনের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। সোভিয়েত স্কুলের কাজ শুধু শিক্ষাগত সমস্যা সমাধান, প্রকৃতি, সমাজ ও মনন, শ্রম দক্ষতা ও ক্ষমতার বিকাশের নিয়মই শিক্ষা দেবে না, এসব জ্ঞানের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস গঠনে সাহায্য করবে, তাদের উচ্চ নৈতিকতা, সোভিয়েত দেশপ্রেম ও সর্বহারার আন্তর্জাতিকতার চেতনায় শিক্ষিত করে তুলবে। এটাই ছিল সোভিয়েত শিক্ষার ইশতেহার। উল্লেখ করা যেতে পারে যেকোনো শিক্ষা ব্যবস্থা যখন কোন আদর্শকে সামনে আনতে চায় তারা এভাবেই অগ্রসর হয়। আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাও এভাবেই তাদের ছাত্রদের তৈরি করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষার মূলনীতিগুলো ১৯০৩ সালে রুশ স্যোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক দলের কংগ্রেসেই গৃহীত হয়েছিল। এর মূল কথা ছিল ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়ে সবার জন্য  বিনামূল্যে সর্বজনীন শিক্ষা, শ্রেণি বৈষম্যের ভিত্তিতে পরিচালিত স্কুল এবং জাতিগত কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বাধানিষেধ ছিল তা নির্মূল করা, গির্জা থেকে স্কুল আলাদা করা ও মাতৃভাষায় শিক্ষা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নে শুধু বিভিন্ন রিপাবলিকেই নয়, এমনকি বিভিন্ন এলাকায়ও এটা প্রচলিত ছিল। গ্রাম এলাকায় মূলত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় ভাষায়, তবে শহরে রুশ স্কুল বা কোন স্কুলে রুশ গ্রুপ ছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি রুশ ভাষার গ্রুপ ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ইউক্রেন, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান ইত্যাদি রিপাবলিকে যেমন স্থানীয় ভাষায় পড়াশুনা করার সুযোগ ছিল, তেমনি তাতারস্তান, বাশকিরিয়া, চেচনিয়া এসব রুশ প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন প্রদেশে তারা নিজ নিজ ভাষায় পড়াশুনা করতে পারত। আমার অনেক কলিগ যারা বিভিন্ন রিপাবলিক বা প্রদেশ থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করেছে তারা কেউ কেউ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে নিজের ভাষায় আবার কেউ কেউ স্কুলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ ভাষায় পড়াশুনা করেছে। আমার কলিগ মানে গণিতবিদ বা পদার্থবিদ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নেও মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ ছিল। আধুনিক রাশিয়ায় এটা আজ চালু আছে। এটা বললাম এজন্যে যে চাইলে আমাদের দেশেও বাংলা ভাষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা সম্ভব।

সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিপ্লবের পরপরই প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষা কমিশন যার প্রধান কাজ ছিল  জনশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেওয়া। যাতে শ্রমজীবী মানুষ সত্যিকার অর্থেই জ্ঞানার্জন করতে পারে সেটা মাথায় রেখে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের জন্য  বিনামূল্যে ব্যাপক ও সম্পূর্ণ শিক্ষা দানের নীতি গ্রহণ করে। যেহেতু এই লেখার বিষয় সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা নয় তাই এ নিয়ে বেশি আলোচনা করব না। তবে একটা কথা বলতে পারি যে লুনাচারস্কির নেতৃত্বে সোভিয়েত শিক্ষা কমিশন যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন তার মাধ্যমেই সোভিয়েত ইউনিয়ন জার আমলের প্রায় সার্বজনীন নিরক্ষরতাকে দূর করতে সক্ষম হয়েছিল। জারের আমলে শিক্ষা, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও সাহিত্য ছিল মূলত জমিদার ও ধনিক শ্রেণির জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন লাখ লাখ সাধারণ কৃষক শ্রমিকের সন্তানদের সুযোগ দিয়েছে সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে। আর সবচেয়ে বড় কথা সে সময় তারা বিশেষজ্ঞ তৈরি করেছে নিজ দেশে বা আরও সঠিক ভাবে বললে নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে যাতে এই সব শিক্ষিত মানুষ ভূমিকা রাখতে পারে সেটা মাথায় রেখে। আর এ কারণেই রুশ ভাষা সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবার পরেও রুশ ভাষায় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেনি। আগেই উল্লেখ করেছি যে সমস্ত প্রজাতন্ত্র তো বটেই এমনকি সমস্ত জাতীয় প্রদেশে সবাই নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশুনা করতে পারত এবং সেটা এখনও ঘটছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষই নিজেদের সোভিয়েত মানুষ বা সোভিয়েতস্কি চেলাভেক বলে মনে করলেও পাসপোর্টে জাতীয়তা হিসেবে কেউ লিখত রুশ, কেউ ইউক্রেন, কেউ বেলারুশ, কাজাখ, কিরঘিজ, জর্জিয়ান, আর্মেনিয়ান, তাতার, বাসকির, চেচেন, ইঙ্গুশ, কালমিক, ইয়াকুত ইত্যাদি। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলত, তারপরেও এভাবে জাতীয়তা ধরে রাখার ব্যাপারটা একটু অবাক করার মত। এর ফলে অনেক জাতিকে, বিশেষ করে ছোট ছোট জাতিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা গেছে বা যাচ্ছে আবার এই নিয়মই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর বিভিন্ন দেশে জাতি ভিত্তিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে বাঙালি, তামিল, তেলেগু, অহমীয়া, ওড়িয়া, মারাঠি, পাঞ্জাবি সবাই ভারতীয় লিখলেও বা ইউরোপিয়ান, আফ্রিকান, এশিয়ান, ল্যাটিনো সবাই আমেরিকান লিখলেও এসব দেশেও জাতিগত সমস্যা নির্মূল করা যায়নি। সেদিক থেকে দেখলে পারফেক্ট সিস্টেম বলে কিছু নেই, তবে যেমন ব্যক্তির বিকাশকে দাবিয়ে রেখে সমষ্টির বিকাশ অসম্ভব একই ভাবে সমষ্টিকে অন্ধকারে রেখে ব্যক্তিকে আলোকিত করাও অসম্ভব। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্র এই দুইয়ের মাঝে কম্প্রোমাইজ না খুঁজে হয় ব্যক্তি না হয় সমষ্টির বিকাশের পথে গিয়ে বার বার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। সঠিক পথ তাই মনে হয় এদের সমানুপাতিক ও সঠিক প্রয়োগের মধ্যে নিহিত। এ নিয়ে আমরা বলব পরের পর্বগুলোয়।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো