মহিলা ভোটার
পছন্দসই প্রার্থিদের ভোট দিতে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকে।

প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন পদ্ধতি। কার অধীনে নির্বাচন হবে – ক্ষমতাসীন সরকার, নাকি নির্দলীয় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার?

সেই বিতর্কের অবসান হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন ক্ষমতাসীন বিএনপি প্রবল বিক্ষোভের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে।

কিন্তু ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে এই নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করে দেয়। এখন এই বিতর্ক নতুন করে মাথা-চাড়া দিয়ে উঠেছে।

নব্বই-এর দশকে আওয়ামী লীগ ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীদার। কিন্তু ২০২৩ সালে বিএনপি বলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না।

কিন্তু ১৯৯৬ এর পরবর্তী ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০১-০৬ সালের বিএনপি সরকারের একটি সিদ্ধান্ত এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়, যেটা সম্ভবত গোটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বিতর্কের মুখে ফেলে দিয়েছে।

তত্ত্বাবধায়কের অধীনে পালা-বদল

উনিশ’শ নব্বই সালে সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের পতনের পর চারটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।

এসব নির্বাচনের মাধ্যমে একবার বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বারবার ক্ষমতায় পালাবদল হয়েছে।

উনিশ’শ একানব্বই সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোন একটি দল পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। পরাজিত দল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এসব নির্বাচনের ফলাফল দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।

উনিশ’শ একানব্বই সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও সে ধরণের সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অংশ ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সে নির্বাচন হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৯৪ সাল থেকে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলে ধরে এক যোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে।

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করে, যেটা সকল বিরোধী দল শুধু বর্জন নয়, ব্যাপক বিক্ষোভের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে।

বিতর্কিত এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ২৬শে মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়।

এরপর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

নির্বাচনে পরাজিত দল বিএনপি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরির’ অভিযোগ আনলেও, তাদের সেই দাবি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাছে। সে নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী জোট ব্যাপকভাবে জয়লাভ করে।

কিন্তু নির্বাচন নিয়ে পক্ষপাতিত্ব এবং কারচুপির অভিযোগ আনে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেটি হালে পানি পায়নি ২০০১ সালের সে নির্বাচনও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।

শেখ হাসিনা
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিবাচনের জন্য ১৯৯৪ সালে থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ।

বিতর্কের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার

দু’হাজার এক সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরেই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সংবিধানে সংশোধনের কয়েকটি দিক ছিল।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা হয়েছিল।

এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেবার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা হয়েছিল।

সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শনের বিধানও করা হয়েছিল এর মাধ্যমে।

দু’হাজার চার সালের ১৬ই মে সংসদে এই সংশোধনীর জন্য বিল উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওলুদ আহমদ।

যার মধ্যে সবচয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানো। সংবিধানের এই সংশোধনী একেবারেই সাদামাটা কোন বিষয় ছিল না।

এর পেছনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করার ইচ্ছে লুকায়িত ছিল বলে অনেকে মনে করেন।

কারণ, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান।

তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে যে, বিএনপি তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার জন্য নানা আয়োজন করেছে।

দু’হাজার তিন সালের জুন মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান কে এম হাসান। তখন অভিযোগ উঠেছিল যে, বিএনপি সরকারের পছন্দের কারণেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে মি. হাসানকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিল ।

আইন বিষয়ক প্রয়াত লেখক এবং সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ২০১৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে এক নিবন্ধে লিখেছেন, “হাসানকে যখন ১৩ তম প্রধান বিচারপতি করা হয় তখন ওই দুজনকে ডিঙিয়ে তা করা হয়। সেই অর্থে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পথ বিএনপিই দেখিয়েছে।’

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স-সীমা বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসরের পরপরই যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন।

সংঘাত
নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময় সংঘাতময় হয়ে উঠে।

আওয়ামী লীগের আন্দোলন

বিচারপতি কেএম হাসান যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন সেজন্য ২০০৪ সাল থেকেই তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করতে থাকে।

তারা শুরু থেকেই বলতে থাকে যে, কেএম হাসান ‘বিএনপির লোক’ এবং এক সময় তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচনও করতে চেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি বিএনপির কমিটিতেও ছিলেন বলে অভিযোগ আনা হয়।

আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই বলে আসছিল যে, তারা কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মানবে না। অন্যদিকে বিএনপিও তাদের পরিকল্পনা মতোই এগিয়ে যাচ্ছিল। কারণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ছিল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে।

তারা বুঝতে পারছিলেন যে, ২০০৭ সালের নির্বাচনে তাদের পক্ষে জয়লাভ করা সহজ হবেনা। তাছাড়া, ১৯৯১ সাল থেকে দেখা গেছে যে, কোন সরকার পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সব মিলিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় রাখার কৌশল বের করে বিএনপি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ এটা ঠিক যে বিএনপি নির্বাচন ম্যানিপুলেট করতে চেয়েছিল, বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে তাদের পছন্দের লোককে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য। ” আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে বিচারপতি কেএম হাসান ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মি. হাসান তখন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন যে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ ভেঙে যাওয়ায় তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সেনাবাহিনী
সেনাবাহিনী ২০০৭ সালে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল ।

রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নতুন সংকট:

সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। এভাবে চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে।

কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে সর্বশেষ উপায় হিসেবে রাষ্ট্রপতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেব দায়িত্ব নেবার কথা।

কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের সবগুলো বিকল্প না দেখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

রাষ্ট্রপতি বিএনপির মনোনীত হলেও তিনি যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেন তখন আওয়ামী লীগ সরাসরি আপত্তি করেনি।

দলটি বলেছিল, রাষ্ট্রপতি কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন সেটি তারা পর্যবেক্ষণ করবেন।

কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে।

আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে তিনি বিএনপির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছেন।

এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে চারজন সদস্য পদত্যাগ করেন। শুরু হয় আরেক সংকট।

আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ সালের ২২ শে জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

রাজনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করলে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে দেয়।

সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত হয় নতুন আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, বিচারপতি কেএম হাসানকে নিয়ে সৃষ্ট সংকট শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ পর্যন্ত গড়িয়েছে।

“তারা তো (বিএনপি) তো আরো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য আটঘাট বেধে নেমেছিল। এক-এগারো হওয়াতে তাদের ভরাডুবি হয়ে যায়,” বলেন মি. আহমেদ।

বিএনপি আন্দোলন
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখন আন্দোলন করছে বিরোধী দল বিএনপি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার আলোচনায়

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল এবং তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এখন আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের জন্য আন্দোলন করছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি এখন বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে বিতর্কিত করার জন্যই সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল দুই বছরের জন্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি সরকার যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বয়স না বাড়াতো তাহলে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিতর্কের মুখে পড়তো?

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বলা মুশকিল, হয়তো পড়তো না।”

বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ মনে করেন, বিতর্কের অজুহাত তোলা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার জন্য।

“বিতর্কিত অর্থ এই নয় যে মাথা ব্যথা থাকলে মাথা কেটে ফেলতে হবে। যেসব বিষয় নিয়ে সমস্যা ছিল সেগুলো মডিফাই করা যেত।”

মি. মাহমুদ বলেন, তারা এখন অতীতের দিকে তাকাতে চান না। ভবিষ্যতে কী হবে সেটিই গুরুত্বপূর্ণ।

# আকবর হোসেন, বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা #