চলমান সংবাদ

প্রবাসে বাংলাদেশি হত্যা ও পরিবারের সংগ্রাম

প্রবাসে কোনো বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবিতে বিক্ষোভ- এমন খবর প্রায়ই আসে৷ সেরকম এক বিক্ষোভ সমাবেশ দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে৷ সৈয়দ ফয়সল নামের এক তরুণের হত্যার বিচার দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্টে৷

প্রবাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার কয়েকজন বাংলাদেশির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আইনি সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয় না। নিহতের পরিবারের সদস্যরাও বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করেন না।

যেদেশে নিহত হন, সেই দেশের আইনেই মামলা হয়। বিচার হলে তা-ও সেই দেশের আইনেই হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই নিহতদের স্বজনরা সেই দেশে থাকলে তারাও তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে চান না। তবে বিদেশি নাগরিকত্ব না থাকলে যোগাযোগ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কেম্ব্রিজ শহরে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর প্রতিবাদে সেখানে প্রবাসীরা বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ জানালেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

নিহত ফয়সলের বাড়ি চট্টগ্রামে। সেখানকার সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় খুবই ব্যথিত। তারা এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার চান। তাদের  ন্যায় বিচার পেতে বাংলাদেশ সরকারও উদ্যোগ নিতে।

ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়ন বাজারে তাদের বাড়ি। তারা বাবা-মা-ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। ফয়সল তাদের একমাত্র সন্তান । আট বছর আগে তারা সপরিাবারে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।  বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়-স্বজন আছেন। ফটিকছড়ি থেকে ফয়সলের মামাতো ভাই মিজান সাঈদ বলেন, “ফয়সল ও তার পরিবারের সদসরা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডধারী। সে অত্যন্ত শান্তশিষ্ট একটি ছেলে। বাংলাদেশে সে সিলেট রেসিডেন্সিয়াল সডেল কলেজে পড়তো। তবলা বাজানোও শিখেছিল। দুই বছর আগে সে একবার গ্রামের বাড়িতে এসেছিল একা। তাকে হত্যার ২০-২৫ দিন আগে আমার সঙ্গে তার ভিডিও কলে কথা হয়।”

বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া: মিজান সাঈদ

তিনি বলেন, “আমরা যারা এখানে তার আত্মীয়-স্বজন আছি, তাদের সঙ্গে এখানকার প্রশাসনের লোকজন কোনো যোগাযোগ করেনি, আমরাও করিনি। আর মার্কিন দূতাবাসও কোনো যোগাযোগ করেনি।”

তিনি মনে করেন, “বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া, তার (ফয়সল) পরিবারকে বিচার পেতে সহায়তা করা। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।”

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায় বন্দুকধারীদের গুলিতে আবু সালেহ মোহাম্মদ মাহফুজ আহমদ নামে আরেক বাংলাদেশি  নিহত হন। তিনিও সেখানকার গ্রিনকার্ডধারী। তিনি নোয়াখালী শহরের হরিনারায়ণপুর এলাকার আবু তাহেরের ছেলে। স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবাকে নিয়ে আটলান্টা শহরে বসবাস করতেন। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ব্যবসায়ী মাহফুজ আহমদ।

প্রায় ১০ বছর আগে অ্যামেরিকায় যান আবু সালেহ মোহাম্মদ মাহফুজ আহমদ। পরবর্তীতে আটলান্টা শহরে নিজে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ১৬ জুন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বন্দুকধারীরা তাকে তার দোকানর সামনে হত্যা করে।

নোয়াখালীতে বসবাসরত তার বড় ভাই মাসুদ আহমেদ জানান, “ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমার আরো এক ভাই সেখানে থাকেন। কয়েকদিন আগে বাবা দেশে এসেছেন। আমরা আসলে বিষয়টি নিয়ে তেমন চাপ দিতে চাই না। আমরা ছোট ভাই, নিহত ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান এবং আমার বাবা সেখানে থাকেন। তারা যাতে কেনো সমস্যায় না পড়েন সেটাই আমাদের এখন মূল উদ্বেগের বিষয়।”

তিনি জানান, “হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখানে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাবাসহ পরিবারের যারা থাকেন তাদের সঙ্গেও ওখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে কেউ যোগাযোগ করেননি। যা হচ্ছে, তা ওই দেশের প্রচলিত আইনেই হচ্ছে।”

তার কথা, “সরকারে পক্ষ থেকে যদি আইনি সহায়তা বা উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে আমরা জোর গলায় বিচার চাইতে পারতাম।”

২০২২ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ ওয়েস্ট প্রদেশের ক্লার্কড্রপস শহরে মুজাহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া নামে এক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়। তিনি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকতেন। ক্লার্কড্রপস শহরে পাইকারি ফুলের ব্যবসা করতেন তিনি। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে এর বাইরেও ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যেও বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা মারা যান। তাদের বড় একটি অংশ হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে অভিযোগ আছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে প্রতিদিন ১১ জন শ্রমিকের লাশ দেশে আসছে। ২০০৮ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ১৪ বছরে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৪৫ হাজার ৩০১ জন প্রবাসীর মরদেহ এসেছে। এর মধ্যে ২৭ হাজার ২৩১ জনের (৬৩ শতাংশ) মরদেহ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকেই এসেছে ১২ হাজার ৯৩০ জন প্রবাসীর মরদেহ। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে পাঁচ হাজার ১২৩ জন, ওমান থেকে তিন হাজার ৭৭৬ জন, কুয়েত থেকে দুই হাজার ৭২৪ জন, বাহরাইন থেকে এক হাজার ১১ জন এবং কাতার থেকে এক হাজার ৫৬২ জনের মরদেহ এসেছে। তাদের বড় একটি অংশ স্ট্রোক, হৃদরোগ, দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যার শিকার।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, “বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে তাদের লাশ দেশে ফেরত আনা, ন্যায় বিচার পেতে কাউন্সেলর সুবিধাসহ আরো অনেক সহায়তা দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিন্তু বাংলাদেশি নাগরিক নন সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই।”

আর যে দেশে ঘটনা ঘটে, বিচার সেই দেশের আইনেই হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকে। কিন্তু যে দেশের পাসপোর্ট তিনি ব্যবহার করেন, সেই দেশের নাগরিক হিসবেই তাকে বিবেচনা করা হয়।”

তবে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, “বাংলাদেশের নাগরিক  যে দেশেই হত্যা বা অপরাধের শিকার হোক না কেন তার ব্যাপারে সব ধরনের সহায়তা দেয়া সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখতে পাই অ্যামেরিকা বা ইউরোপের মতো দেশে হলে বাংলাদেশ কোনো কথা বলে না। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকদের ব্যাপারেও বাংলাদেশের অবস্থান ধরি মাছ না ছুই পানির মতো।”

তার কথা, “একজন অ্যামেরিকান যদি অ্যামেরিকায় খুন হয়, তাহলে তাদের পুলিশ, বিচার বিভাগ যতটা তৎপর হয় একজন বাংলাদেশি অ্যামেরিকান হত্যার শিকার হলে তাদের তেমন তৎপরতা থাকে না।”

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “২০২০ সালে পাঠাও সহ-উদ্যোক্তা বাংলাদেশি অ্যামেরিকান তরুণ ফাহিম সালেহ যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই ঘটনায় কিন্তু সেখানকার পুলিশকে ততটা তৎপর হতে দেখা যায়নি।”

“বাংলাদেশি কোনো নাগরিক যদি অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন, তারপরও বাংলাদেশের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাদের পাশে দাঁড়ানো সাংবিধানিক দায়িত্ব,” বলেন শরিফুল হাসান।

#হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা, ডয়চে ভেলে #