বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ
বাংলাদেশে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়।

বছরের প্রথম দিন বাংলাদেশের পাঠ্যবই বিতরণ কার্যক্রমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে  বই দেয়ার সংখ্যা এবং বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শিক্ষার্থীরা এবার তাদের পাঠ্যক্রম অনুযায়ী সব বই হাতে পায়নি। আপাতত তাদেরকে পুরো সেটের মাত্র একটি বা দুইটি বই দেওয়া হয়েছে।

আবার বইয়ের সরবরাহ না থাকায় কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই উৎসবই হয়নি।

এজন্য ছাপাখানা ও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে। তবে দুটি পক্ষই বলছে কাগজের সংকটের কারণে সময় মতো বই ছাপিয়ে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে চার কোটি নয় লাখ ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে৷

তাদের জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৩৪ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করার কথা। কিন্তু এখনও সব বই ছাপানো সম্ভব হয়নি।

বইয়ের ঘাটতির কারণ

এনসিটিবির সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিকের ৮৩% এবং মাধ্যমিকের ৭৮% বই বিতরণ করা হয়েছে।

যদিও মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি, ঘাটতির পরিমাণ এনসিটিবির হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির মুখপাত্র তোফায়েল খান বলেছেন, প্রাক-প্রাথমিকের শতভাগ বই ছাপানো সম্ভব হলেও এখন পর্যন্ত প্রাথমিকের ৫০ থেকে ৬০% এবং মাধ্যমিকের ২০ থেকে ৩০% বই ছাপানোই হয়নি।

বাকি বই ছাপিয়ে সরবরাহ করার জন্য টেন্ডার অনুযায়ী ছাপাখানাগুলোর হাতে সময় আছে ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত।

কিন্তু কাগজের সরবরাহ সংকটের কারণে এই সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মি. খান।

তবে বই উৎসবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই সবাইকে শতভাগ বই দেয়া হবে।

তিনি জানান, “আমরা এক তারিখে এই বই উৎসব করতে পারবো কিনা, সেটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, বই ছাপাতে দেরি হয়েছে, একটা সময় বিদ্যুতের সমস্যা ছিল, কাগজের সংকট হল। তবে সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সম্ভব হয়েছে।”

বইয়ের কাগজের মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।
বইয়ের কাগজের মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

সংকটের আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই

এবারের শিক্ষাবর্ষের সব বই বছরের শুরুতেই দেয়া সম্ভব হবে কিনা সেটা নিয়ে আশঙ্কা ছিল শুরু থেকেই।

কারণ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বই দেয়ার দরপত্রের অনুমোদনের বিষয়টি দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিল তার ওপর আবার চারটি শ্রেণীর নতুন কারিকুলাম যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আলাদা চাপ সৃষ্টি করে।

এরমধ্যে কাগজ সংকট, পাল্প সংকট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, পাঠ্যবই ছাপা বাদ দিয়ে নোট-গাইড ছাপানো – ইত্যাদি নানা কারণে বই ছাপতে বিলম্ব হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির দাবি, ওয়ার্ক অর্ডার দেরিতে পাওয়া আর কাগজের সংকটের কারণে বই দেরিতে হাতে পেয়েছে শিক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশে একটি বই উৎসব শেষ হওয়ার পরপরই পরের বছরের বই উৎসবের প্রস্তুতি নেয়া হয়ে থাকে।

এজন্য সাধারণত মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে দরপত্র জমা দেয়া হয়। এর ১২০ দিনের মাথায় অর্থাৎ জুলাই মাসের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার বা কার্যাদেশ দেয়া হয়ে থাকে। তাহলে অগাস্টের মধ্যে ছাপার কাজ শুরু করা যায়।

আবার ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার আগে বইগুলোর সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন করে চূড়ান্ত কপি দিতে হয়।

কিন্তু চলতি বছর নভেম্বরের মধ্যেও কাজ শুরু করা যায়নি, কারণ চারটি শ্রেণীর  (প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম) পাঠ্যবইয়ের কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেটার চূড়ান্ত কপি তাদের হাতে এসেছে নভেম্বর মাসে।

শেষ সময়ে প্রায় দেড়শ ছাপাখানা দিন-রাত এক করে কাজ করলেও সময়ের অভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি বলে জানান মুদ্রণ শিল্প সমিতির মুখপাত্র তোফায়েল খান।

এরমধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ছাপাখানা তাদের সক্ষমতার চাইতে বেশি অর্ডার নেয়ায় এখনও কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি।

মুদ্রণ শিল্পের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রমা ব্রাইট এবং বারোতোপা নামে  দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেড় কোটির বেশি বই আটকে ছিল।

অন্যদিকে অগ্রণী, আনন্দ, দশদিশা, জাহানারা, সরকার গ্রুপ, প্রিন্ট মাস্টার এবং বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রেসের কাছেও প্রচুর বই আটকে আছে বলে জানা যায়।

অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকা এবং পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্যই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ছাপাখানা।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীর অসৎ কার্যকলাপের কারণে, খারাপ মানের বই ঢুকে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মান খারাপের কারণ এনসিটিবির গাফিলতি?

যেকয়টি বই শিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছেন সেগুলোর মান নিয়েও বড় ধরণের প্রশ্ন রয়েছে।

এবারে বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক নিম্নমানের মলিন নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা হয়েছে এবং ছাপার মানও খারাপ বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

বইয়ের মানে হেরফের হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে এনসিটিবি।

তারা জানিয়েছে, বইয়ের নিম্নমান নিয়ে প্রমাণ পেলে তারা সেগুলো ছাপাখানায় ফিরিয়ে দিয়ে অসাধু ঠিকাদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

সাধারণত বইয়ের মান পরীক্ষার জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষক থাকে। তারা যদি মানের ঘাটতি পায় তাহলে তারা বিষয়টি এনসিটিবিকে জানায় এবং এনসিটিবি বইগুলো ছাপাখানায় ফিরিয়ে দেয়।

বই ছাপার ছয় মাস পর্যন্ত বই পুনরায় ছাপানো বা ডিফেক্ট লায়েবিলিটি পিরিয়ড থাকে।

সাধারণত চার ধাপে পাঠ্যবই ছাপানোর তদারকি করা হয়।

প্রথমে কাগজের মান পরীক্ষা, ছাপা তদারকি, বাইন্ডিং দেখা এবং সব ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা দেখে ছাড়পত্র দিয়ে বই বুঝে নেয়া।

এনসিটিবি এই দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় করেছে বলে অভিযোগ করেছে মুদ্রণ শিল্প সমিতির মুখপাত্র তোফায়েল খান।

তিনি বলেন, “আমরা এনসিটিবি-কে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছি। শিক্ষামন্ত্রীর বোর্ড মিটিংয়ে পর্যন্ত বলেছি, বইয়ের মান রক্ষা হচ্ছে না। পরে মন্ত্রী তদারকির নির্দেশ দিলেও আসলে কিছুই হয়নি। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এমনটা হয়েছে।”

এবারে শিক্ষার্থীরা পুরো সেট বই পায়নি।
এবারে শিক্ষার্থীরা পুরো সেট বই পায়নি।

অসৎ ব্যবসায়ীদের দিকে অভিযোগ এনসিটিবির

অন্যদিকে এনসিটিবির অভিযোগ, কয়েকজন মুদ্রণ ব্যবসায়ীর অসৎ কার্যকলাপের কারণে খারাপ মানের বই ঢুকে পড়েছে।

দ্রুত সময়ে বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবি নিজেরাই কাগজের উজ্জ্বলতা কিছুটা কমিয়ে ছাড়পত্র দিলেও ব্যবসায়ীরা তার চাইতেও অনেক নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করেন এনসিটিবির সচিব নাজমা আক্তার।

তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের একটা প্রভাব যেন শিশুদের ওপর না পরে সেজন্য সরকার অন্য বাজেট থেকে কাট করে বই উৎপাদনে ব্যয় করেছে। কাগজের খরচ কমাতে এবং দ্রুত উৎপাদনে আমরা উজ্জ্বলতা কিছুটা কমিয়েছি। কিন্তু কাগজের মান ঠিক ছিল। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রবণতা হল যতো কম খরচে কাজ চালিয়ে মুনাফা করা যায়, বইয়ের মান পড়লে পড়ুক। এখানে সেটাই হয়েছে।”

এদিকে কাগজের দাম বেশি অজুহাতে ব্যবসায়ীরা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানোর কথা জানিয়েছে।

ব্যবসায়ীদের এই অভিযোগের প্রসঙ্গে নাজমা আক্তার বলেন, “আমাদের টিম ভোর ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন প্রেসে ঘুরে ঘুরে কাজ তদারকি করেছে। কিন্তু ছুটির দিনে বা ভোররাতে তো কেউ ছিল না। ওই সুযোগেই তারা নিয়ম লঙ্ঘন করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়েছে।”

অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়মের মধ্যে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জন্য।

যদিও দরপত্রের নিয়মানুযায়ী ঠিকাদাররা নিয়ম লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান রয়েছে।

কেউ যদি নিম্নমানের বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে তাহলে এনসিটিবি তাদের হয়ে  ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি জানান।

এরিমধ্যে দেড় লাখের মতো নিম্ন মানের বই বাতিল করা হয়েছে।

এবারের বিশৃঙ্খলা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে দরপত্রের ধরণে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে এনসিটিবি। যেন অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়ার্ক অর্ডার না পায়।

পাঠ্যপুস্তক
নতুন কারিকুলামে যেসব পাঠ্যপুস্তক এসেছে সেখানে ভুল ত্রুটি পরিমার্জনেও বড় ধরণের সময় প্রয়োজন।

কাগজের সংকটের মূল কারণ

এই পাঠ্য বইগুলোর মান সম্মত কাগজ বলতে উজ্জ্বল সাদা কাগজে ছাপানোর কথা বলা হয়।

উজ্জ্বল কাগজের জন্য অব্যবহৃত ভার্জিন পাল্প নামে একটি উপকরণের প্রয়োজন হয় যা থেকে ৮৫% উজ্জ্বল কাগজ পাওয়া যায়।

এই পাল্প কানাডা, বেলজিয়াম, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়ে থাকে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজ ও পাল্প আমদানি বন্ধ থাকায় সঠিক সময়ে পূর্ণাঙ্গ বই ছাপাখানাগুলো দিতে পারেনি এবং মানেও ঘাটতি হয়েছে বলে জানান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন।

আমদানি সংকটের পেছনে মূল কারণ হিসেবে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা ওয়ার্ক অর্ডার দেরিতে পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী ওই সময়ের মধ্যেই ডলার সংকট দেখা দেয়।

সে সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের আমদানিতে ঋণপত্র সীমিত করা হয়। ফলে ভালো মানের পাল্প আমদানি করা যায়নি।

আমদানি বন্ধ থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা রিসাইকল বা পুরনো কাগজ প্রক্রিয়া করে পাল্প তৈরি করে এবং নিম্নমানের নিউজপ্রিন্ট কাগজে বই ছাপায় বলে অভিযোগ উঠেছে।

আবার এই সুযোগে পুরনো কাগজ সরবরাহকারী এবং কাগজ উৎপাদনকারীদের অনেকে সিন্ডিকেট করে নিম্নমানের কাগজের ব্যবসা করেছে৷ আর প্রকাশকরা সুযোগ নিয়ে অধিক মুনাফা করেছে বলেও অভিযোগ করে এনসিটিবির।

এতে মূল ছাপার কাজ শুরু হতে আরও দেরি হয়। সব মিলিয়ে বছরের শুরুতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বই পৌঁছানো এবং মানসম্মত বই সরবরাহ সম্ভব হয়নি বলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

বই বিতরণ
বই বিতরণ

সংকট কি কাটবে?

এদিকে নতুন কারিকুলামে যেসব পাঠ্যপুস্তক এসেছে সেখানে ভুলত্রুটি পরিমার্জনেও বড় ধরণের সময় প্রয়োজন। তাই সংকটের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান ফরহাদুল ইসলামও বলেছেন, “প্রথম বছর এই পাঠ্যপুস্তক দেয়া হয়েছে। এখানে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। কিছু সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে।”

বাংলাদেশে করোনার মহামারির কারণে টানা দুই বছর বই বিতরণ অব্যাহত থাকলেও কোন উৎসব হয়নি।

এবার বছরের প্রথম দিন দেশজুড়ে সাড়ম্বরে উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেয়া হলেও বইয়ের সংখ্যা ও মানের কারণে আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই ইভেন্টটি প্রতিবছর বই উৎসব হিসেবে পালন হয়ে আসছে।

গত ১৩ বছরে বই উৎসবের মাধ্যমে প্রায় ৪৩৫ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

সানজানা চৌধুরী, বিবিসি বাংলা