বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭৫): ডিভাইড অ্যান্ড রুল  

– বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

কিছুদিন আগে জার্মান পার্লামেন্ট গলদামরকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার জেনোসাইড বলে স্বীকার করল। এ বিষয়ে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে গলদামর ব্যাপারটা কী? এই শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ক্ষুধায় মারা বা ভাতে মারা। এটা সত্য নাকি মিথ্যা? ঘটনা সত্য। ১৯৩০ এর দশকে শুধু ইউক্রেন নয় সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে প্রচুর মানুষ না খেয়ে মারা যায়। তাই রাজনীতিতে যাবার আগে জানার চেষ্টা করি আসলে কী ঘটেছিল তখন। ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পরে রাশিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন ভাবে বিপ্লবের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। তাদের মদতে শ্বেত বাহিনী দীর্ঘদিন এই লড়াই চালিয়ে যায়। ১৯২২ সালে গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আজ থেকে ঠিক এক শ বছর আগে ৩০ ডিসেম্বর ১৯২২ সালে জন্ম নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলেও এক সময় এই সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং আমরা বর্তমানে বিশ্বের যে ভূ-রাজনৈতিক চিত্র দেখি সেটা তৈরি হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় অংশগ্রহণেই। গৃহযুদ্ধ শেষে এরা মন দেয় দেশ গড়ায়। কিন্তু রাশিয়া তখন ছিল পিছিয়ে পড়া এক দেশ যার ভিত্তি ছিল কৃষি। শিল্প বলতে তেমন কিছু ছিল না। জারের রাশিয়ায় পুঁজিবাদও ছিল দুর্বল। তাই এ রকম এক দেশে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারে এটা কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই নেয়নি। এ থেকেই বোঝা যায় রাশিয়ার সেই সময়ের আর্থসামাজিক পরিবেশ। গৃহযুদ্ধ আর পশ্চিমা আক্রমণ একটা জিনিস এদের শেখায় – ভারী শিল্প ব্যাতীত এই দেশ টিকে থাকতে পারবে না। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান প্রায়োরিটি হবে ভারী শিল্প গড়ে তোলা, শ্রমিক শ্রেণী গড়ে তোলা। কারণ গৃহযুদ্ধের সময় শ্রমিকই ছিল বিল্পবের পক্ষে মূল শক্তি যেখানে অনেক কৃষক যুদ্ধ করেছে তাদের জোতদার ভূস্বামীদের পক্ষে। কিন্তু চাইলেই তো আর শিল্প গড়ে তোলা যায় না। এ জন্যে দরকার যন্ত্রপাতি, কলকারখানা। সেটা কোথায় পাবে? ইউরোপ আর আমেরিকা থেকে কিনতে হবে। আর সেজন্যে দরকার বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাতে রাজী নয়। বিনিময়ে তারা চায় তেল, গ্যাস, বনসম্পদ আর শস্য। স্তালিন বাধ্য হন সেই চুক্তিতে রাজী হতে। কিন্তু তিরিশের দশকের প্রথমে দেখা দেয় নজিরবিহীন খরা। শস্য হয়না বললেই চলে। আর পুঁজিবাদী বিশ্ব – ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি – এরা এই সুযোগে চুক্তিতে পরিবর্তন আনে, এবার তাদের দরকার শুধুই শস্য। দুটো পথ খোলা – হয় এসব দেশে শস্য রপ্তানি করা, না হয় শিল্পায়ন বন্ধ করা। স্তালিন শিল্পায়ন বেঁছে নেন। সারা দেশে – ইউক্রেন, বেলারুশ, রাশিয়া, কাজাখস্তান – সমস্ত দেশে দেখা দেয় নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষ আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ভোলগা তীরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। তাই এই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির পেছনে ছিল মূলত ইউরোপ আর আমেরিকা। তারা ভেবেছিল এর ফলে দেশে স্তালিনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হবে আর সেই সুযোগে তারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করবে। এ গেল একটা দিক। অন্য আরেকটা দিক হল – এই দুর্ভিক্ষ সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়েই হয়েছিল- এটা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ছিল না আর সবচেয়ে বেশি মারা গিয়েছিল রুশরা। তাই এটাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশদের তৈরি বলা শুধু সত্যের অপলাপ নয়, অপরাধ। বিশেষ করে এটা যদি করে সেই জার্মান জাতি যাদের হাতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন সোভিয়েত নাগরিক মারা গেছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছাকৃত ভাবেই গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর মানুষ মেরেছে তাদের জাতিগত পরিচয় বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তারা বেঁছে বেঁছে মেরেছে রুশ, বেলারুশ, ইউক্রেন, ইহুদীদের। তবে সবচেয়ে বেশি মেরেছে কমিউনিস্টদের। এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক হত্যার শিকার হয়েছে কমিউনিস্টরা। তবে এটা ঠিক রাজনৈতিক কারণে হত্যাকে জেনোসাইড বলে সব সময় স্বীকার করা হয় না। জেনোসাইড নিয়ে আমরা কথা বলব পরে কোন এক সময়। শুধু উল্লেখ করতে চাই যে বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম ভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতির একটা অংশ। এটা আমরা দেখেছি ভারতে, বিশেষ করে বাংলায় চল্লিশের দশকে যখন যথেষ্ট খাবার থাকা সত্ত্বেও সৈন্যদের খাদ্যাভাব হবে এই অজুহাতে চার্চিল বাংলায় কয়েক মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন। স্বাধীনতার পর আমেরিকা প্রাপ্য খাদ্য সরবরাহ না করে বাংলাদেশেও দুর্ভিক্ষের জন্ম দেয়।

কয়েকদিন আগে ইউক্রেনের সেনাপ্রধান জালুঝনি এক সাক্ষাৎকার দিলেন। অনেক কিছুর সঙ্গে তার যে বক্তব্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সেটা হল তার রুশদের হত্যা করার ডাক। অর্থাৎ সেনাপ্রধান এখন যুদ্ধে রুশদের হত্যা করার কথা বলছেন, বলছেন এটা করতে যেন কেউ দ্বিধা না করে। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখবেন ঐতিহাসিক ভাবে যে কোন সেনাপতিই যুদ্ধে জয়ের কথা বলে আর এই জয়ের জন্য তারা যতটা না হত্যার কথা বলে তারচেয়ে বেশি বলে শত্রুর আত্মসমর্পণের কথা। এখানেই একজন সৈনিকের সাথে একজন খুনির পার্থক্য। সৈনিক যুদ্ধে জিততে চায়, হত্যা করে যদি শত্রু আত্মসমর্পণ না করে। আর খুনির মূল উদ্দেশ্য খুন করা। আশ্চর্যের ব্যাপার না সেই সাংবাদিক, না পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ – কেউই এ ধরণের বক্তব্যের নিন্দা করেননি। এমনকি যদি এটাকে বর্তমান পরিস্থিতিতে জালুঝনির মানসিক অবস্থার কথা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়ও – এটা করা হচ্ছে জালুঝনি আসলে রুশদের বিরুদ্ধে বলছেন বলে। এটা পশ্চিমা বিশ্বের রুশ বিদ্বেষের কথা নতুন করে প্রমাণ করে, প্রমাণ করে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধঃপতনের কথা। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এমনকি গতকাল ২১ ডিসেম্বরও ভ্লাদিমির পুতিন বললেন তিনি মনে করেন রুশ ও ইউক্রেন দুটো ভ্রাতৃপ্রতিম জাতি।

ইউক্রেনের ন্যাশনাল পুলিশের প্রধান ইগর ক্লিমেঙ্কো বললেন “দনবাস মুক্ত করতে প্রধান বাধা সেখানকার মানুষ। গত আট বছর তারা রুশ প্রোপ্যাগান্ডার ভেতরে বাস করেছে। সেখানকার ছেলেমেয়েরা যারা ২০১৪ – ২০১৫ সালে জন্ম নিয়েছে, ইতিমধ্যে দ্বিতীয় শ্রেনিতে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু তারা ইউক্রেন ভাষা শেখেনি, শোনেনি। তারা ইউক্রেন সম্পর্কে সত্য কিছু জানে না। তাই সেখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা মানুষ।” কিন্তু সত্যটা হচ্ছে এমনকি যে জাখারচেঙ্কোকে তারা হত্যা করেছে তার আমলেও স্কুলের দ্বিতীয় ভাষা ছিল ইউক্রেন ভাষা। এখনও ক্রিমিয়ায় রুশের পাশাপাশি ইউক্রেন আর তাতার ভাষা সরকারি ভাষা। তাই সমস্যা মানুষে নয়, সমস্যা অমানুষে যারা আজ পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিজেদের ইচ্ছা অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। দুঃখজনক হলেও সত্য এসব মানবতা বিরোধী কথাবার্তা পশ্চিমা বিশ্ব এড়িয়ে যায়, এড়িয়ে যাবে। কারণ সব কিছুর পরেও এরা এখনও সেই আগের মতই রয়ে গেছে – এখনও তারা নিজেদেরই বিশ্বের হর্তাকর্তা মনে করে, নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছা অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা মাল্টিকালচার সহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের মাধ্যমে একদা নিজদের উপনিবেশের মানুষদের নিজ নিজ সমাজে ইন্টিগ্রেট করতে চেয়েছেন, কিন্তু বিগত কয়েক বছরের ইমিগ্র্যান্টদের সমস্যা, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগত শরণার্থীদের প্রতি দুর্ব্যবহার, যা কিছু রুশ সব বাতিল করা – ইত্যাদি এদের আসল রূপ নতুন করে তুলে ধরে। আর এসব থেকেই বোঝা যায় ইউরোপ এখনও তার ঔপনিবেশিক খোলস থেকে পুরাপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি।

ইদানিং কালে রুশ নেতৃবৃন্দ অনেকবারই বলেছেন যে এই যুদ্ধ ছিল অপরিহার্য এবং সেটা আসলে আগেই শুরু করা উচিৎ ছিল। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মেরকেল মিনস্ক চুক্তি সম্পর্কে বলেছেন, এটা আসলে ছিল ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার সময় দেয়া। প্রথম থেকেই তারা এই চুক্তি পালন করতে আগ্রহী ছিলেন না। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন ২০১৪ সাল থেকেই তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সজ্জিত করেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তাই প্রশ্ন কেন রাশিয়া এতদিন বসে ছিল। কেন ইউক্রেন যখন দুর্বল ছিল তখন আক্রমণ করা হয়নি বা ২০১৪ সালে যখন ইউক্রেন সেনারা আটকা করে তখন কেন মিনস্ক চুক্তি করে সেই সুযোগ হাতছাড়া করা হয়? এ সম্পর্কে সরকার কিছুদিন আগে কিছু তথ্য প্রকাশ করে যা থেকে পরিস্কার যে সে সময় যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার পক্ষে বর্তমানে আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করা সম্ভব হত না। ২০১৩ ও ২০২২ সালের যে চিত্র দেওয়া হয়েছে সেটা এরকম – মাংস উৎপাদন ৮,৫২৫ বনাম ১২,১৫২ মিলিয়ন টন, শস্য ৯১,৩ বনাম ১৫৭,৭ মিলিয়ন টন, পনির ৩৪০, ৯ বনাম ৬২০ হাজার টন, শাক সবজি ০,৬২ বনাম ১,৭৪ মিলিয়ন টন, ফলমূল ১,৫৭ বনাম ৪,১ মিলিয়ন টন, মৎস্য ৩,৬৫ বনাম ৫,৪১ মিলিয়ন টন, চাষাবাদের যন্ত্র ৩০,৫ বনাম ২২৯ বিলিয়ন রুবল। এ ছাড়াও সে সময় রাশিয়ার ব্যাঙ্কিং ছিল পুরোপুরি বিদেশ নির্ভর, কোন প্ল্যান বি রেডি ছিল না। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি এদের স্বর্ণ ছিল ১০৩৫,২ টন, ২০২২ এর ১ জানুয়ারি ২৩০০,৩ টন যা বিদেশে নয় ছিল মস্কো আর সাঙ্কত পিতেরবুরগে। ন্যাশনাল ওয়েলফেয়ার ফাণ্ডের পরিমাণ ছিল ২০১৪ সালে  ২৯০০,৬৪ বিলিয়ন রুবল, ২০২২ সালে ১৩৫৬৫,৩৫ বিলিয়ন রুবল। ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সালের মাঝে এ দেশের ১৬০০ নতুন শিল্প কারখানা চালু হয়। ২০১৩ সালে বিমান যাত্রী ছিল ৮৪,৪ মিলিয়ন, ২০১৯ সালে ১২৮,১ মিলিয়ন। ২০১৫ সালের আগে রাশিয়ায় হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন তৈরি হত না, আনা হত ইউক্রেন আর ফ্রান্স থেকে, এখন এরা প্রতি বছর ৩০০ ইঞ্জিন তৈরি করে। বিগত বছরগুলোতে এদেশে অনেক ফার্মাসিটিউক্যাল কোম্পানি তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও গত ৮ বছরে রাশিয়ার হাসপাতালগুলোয় প্রচুর নতুন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে যাতে আগামী কয়েক বছর অনায়াসে কাজ করা যায় আর ২০২৭ সাল থেকে এরা নিজেরাই এসব যন্ত্রপাতি তৈরি করবে। এ থেকে বোঝা যায় পশ্চিমা বিশ্ব যেমন ইউক্রেনকে অস্ত্র সজ্জিত করেছে, এরা নিজেরাও নিজেদের অন্যান্য সব দিক থেকে তৈরি করেছে আর এ কারণেই এত স্যাঙ্কশনের পরেও এরা সেসব খুব ভালো ভাবেই মোকাবিলা করতে পেরেছে। তবে সেই প্রস্তুতি কত দিন এদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করবে সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারবে।

আশির দশকে যখন বন্ধুরা ইউরোপ আমেরিকায় বেড়াতে যেত আর সেসব দেশ সম্পর্কে গল্প করত তখন অনেক সময় মনে হত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই এদের পিছিয়ে পড়ার কারণ। মনে হত গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা – এসবই অর্থনীতির চালিকা শক্তি। কেননা তখন পশ্চিমা বিশ্বের এসব ছিল অঢেল বা অঢেল না হলেও সোভিয়েত সমাজের চেয়ে বেশি। তাই একটা ধারণা ছিল যে এই স্বাধীনতাই মানুষকে কাজ করতে উৎসাহী করে, এ কারণেই সেখানকার জীবনযাত্রা এত উন্নত। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এই মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা ছিল, তবে সব মানুষ এসবে খুশি ছিল না, অনেকেই চাইত আরও বেশি বেশি ভোগ্য পণ্য। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধ আরও একটি নতুন দিক উন্মচন করল। দেখা গেল পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের উন্নত জীবনযাত্রার পেছনে ছিল রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া আর আফ্রিকার কাঁচা মাল আর স্বল্প মূল্যের শ্রমিক শ্রেণি। বিশেষ করে রাশিয়ার স্বল্প মূল্যের তেল গ্যাস। শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকেই ইউরোপের কাঁচা মাল সরবরাহকারী ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেই স্থান দখল করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য। কাঁচা মাল ও এনার্জির পাশাপাশি এসব দেশ ও উন্নয়নশীল বিশ্বের ধনিক শ্রেণী ইউরোপ আমেরিকায় সরবরাহ করে অঢেল সম্পদ, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেআইনি ভাবে উপার্জিত। রাশিয়ার অলিগারখদের প্রিয় জায়গা ছিল লন্ডন, প্যারিস। এমনকি কমবেশি বিত্তশালী মানুষ – তা সে শিল্পী হোক, সাহিত্যিক হোক – সবাই ইউরোপ, আমেরিকায় একটা বাড়ি কেনা অনেকটা দায়িত্ব বলে মনে করত। রাশিয়া বা মধ্য প্রাচ্যের ধনীদের ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব কেনা এই একই সূত্রে গাঁথা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর শুধু রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ নয়, অনেক অলিগারখদের সম্পদও আটকে দিচ্ছে ইউরোপ। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ শুধু একচেঞ্জ কারেন্সি হিসেবে ডলার থেকেই সরে আসছে না, অনেকেই নিজেদের সম্পদ বিভিন্ন আরব দেশে স্থানান্তরিত করছে। একটা সময় ছিল যখন ইউরোপ আমেরিকার বিমান কোম্পানি প্লাস এরোফ্লত সারা বিশ্বে যাত্রী বহন করত, এখন সেই জায়গা দখল করেছে তুরস্ক, কাতার, কুয়েতের কোম্পানিগুলো। রাশিয়ার তেল গ্যাসের উপর সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে ইউরোপ বাজার অর্থনীতিকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে না, রুশ পণ্যবাহী জাহাজ ইন্স্যুরেন্স না করে লজিস্টিক সমস্যা তৈরি করছে। এতদিন পর্যন্ত প্রায় ৯০% ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ছিল লন্ডন ভিত্তিক। আমার বিশ্বাস এখন এই জায়গা দখল করবে আরব, চীন ও অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো। তাই এতদিন ইউরোপের যে বিলাসবহুল জীবনকে  আমরা পুঁজিবাদের ম্যাজিক বলে মনে করতাম সেটা আসলে ছিল পুঁজিবাদের অন্যদের শোষণ করার, অন্যদের ঠকানোর মজ্জাগত অভ্যাসে। মানবতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এসব নয় – শোষণ, একমাত্র শোষণই হচ্ছে পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি আর এই শোষণকে বাঁচিয়ে রাখতে সে যুদ্ধ করে হোক, যুদ্ধ লাগিয়ে হোক – লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করতেও কখনও পিছ পা হয় না। তাই ইউক্রেনের অন্যায়কে চোখ বুজে মেনে নেওয়া – এসব তথাকথিত ডাবল স্ট্যান্ডার্ড – এগুলো আর কিছুই নয়, আধুনিক ডিভাইড অ্যান্ড রুল।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো