ক্ষমতার ভারসাম্য আর রেইনবো নেশনের কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে বিএনপি?
আগামীতে ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত করবে বলে বিএনপির আনুষ্ঠানিক রূপরেখা ঘোষণার পর এনিয়ে চলছে আলোচনা। ২৭ দফার রূপোরেখায় সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনাসহ এই দুই পদে পরপর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেনা এমন ঘোষণাও রয়েছে। একইসঙ্গে রয়েছে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে রেইনবো নেশন প্রতিষ্ঠার কথা।
রাজপথে সভা সমাবেশ কর্মসূচীর পাশাপাশি সম্প্রতি দলের ভিশন হিসেবে রাষ্ট্র কাঠামো তাদের ভাষায় ‘মেরামতের’ ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। তাদের যে রূপরেখা সেটি বাস্তবায়ন হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের অনেক বিধি ব্যবস্থা পুরোটা পাল্টে যাবে।
সংবিধান সংশোধন
বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা শুরু হয়েছে সংবিধান সংশোধনের ঘোষণা দিয়ে। রূপরেখায় স্পষ্ট করা হয়েছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও গণভোটের বিধান পুনর্বহাল হবে। বিএনপির ভাষায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সকল অযৌক্তিক ও বিতর্কিত সংশোধনী রহিত করা হবে।
সংবিধানে বেশ কিছু ইস্যুতে দুই দলের স্পষ্ট ভিন্নমত রয়েছে।
এসব নিয়ে সংবিধান সংশোধন হলে বিএনপি ঘোষিত জাতীয় ঐক্যের বিপরীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চিরস্থায়ী সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। যদিও সেটি মানতে নারাজ বিএনপি।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করা বিএনপির রুমিন ফারহানা বলছেন তারা বিষয়টি দেখেন ভিন্নদৃষ্টিতে।
“আমরা আসলে সংঘাতের সমাধানের জন্যই এ পরিবর্তনের কথা বলছি। আমার মনে হয় না এ পরিবর্তন নতুন করে কোনো সংঘাত নিয়ে আসবে। বরং যে সংঘাত এখন আছে বিদ্যমান সেটা নিরসনে এই পরিবর্তনগুলো কাজ করবে।”
বিএনপির নীতি নির্ধারকরা এও বলছেন সংবিধানে কিছু মৌলিক সংশোধন না হলে তাদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্য পূরণ অসম্ভব। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন আমরা কিন্তু সবগুলো বাতিল করার কথা বলি নাই ,যেগুলো বিতর্কিত এবং গণবিরোধী সেগুলো সংশোধন করা হবে।
“সংবিধানের একটা বড় অংশ তারা (আওয়ামী লীগ) বলে দিছে যে এটা সংশোধনের অযোগ্য। মানে এগুলো কেউ আর সংশোধন করতে পারবে না। দুই-তৃতিয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাও যদি আমরা পাই বা অন্যকেউ পায় তাহলেও তারা কোনো পরিবর্তন করতে পারবে না। সংবিধান কি কোনো ধর্মগ্রন্থ?”।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য
বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সব ক্ষমতা। বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ভারসাম্য সৃষ্টি করতে গিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কিংবা নতুন সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। তবে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করলে একক ব্যক্তি নয় বরং প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হবে বলে মনে করে বিএনপি। নজরুল ইসলাম খান বলেন,
‘একই ব্যক্তি তিনি দলের প্রধান , তিনি সংসদের নেতা, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাহী প্রধান এবং আবার একটা করা হচ্ছে যে বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদে আসবে। মানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনি থাকবেন বিচার বিভাগও তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এটা আমরা যুক্তিসংগত মনে করি নাই। আমরা কোনো ব্যক্তিকে অধিকতর শক্তিশালী করার কোনো আগ্রহ আমাদের নাই। বরঞ্চ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করা, কার্যকর করা এবং দায়বদ্ধ করায় আমাদের আগ্রহ।”
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য প্রসঙ্গে বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন,
“এই যে অ্যাবসোলুট পাওয়ার একক ব্যক্তির হাতে দিয়ে দেওয়া এটা রাষ্ট্রকে কখনোই গণতান্ত্রিক হতে দেয় না। সেকারণেই আমরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদের ক্ষমতার একটা ভারসাম্য চেক অ্যন্ড ব্যালান্সের কথা বলছি।”
রেইনবো নেশন
বিএনপির রূপরেখায় ২য় দফায় প্রতিহিংসা প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভূক্তিমূলক বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রেইনবো ন্যাশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে।
এই রেইনবো নেশন বলতে আসলে কী বোঝায় বিএনপি এ প্রশ্নে রুমিন ফারহানা বলেন, “পেছনে ফেলে আগাবো না। আমরা সকলকে নিয়ে একটা ইনক্লুসিভ ন্যাশন করার কথা বলছি। এবং গত এক দশকে যেভাবে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে বিভিন্ন ধোয়া তুলে। কখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি, কখনো বলা হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষ বিপক্ষ, কখনো জঙ্গীবাদ, কখনো ধর্ম-মানে একেকবার একেকটা কার্ড সামনে আনা হয়েছে জাতিকে বিভাজিত করতে। সেই জায়গাটাতে আমরা মনে করি জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে আনবার জন্য এই রেইনবো নেশনের পরিকল্পনা।”
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে প্রশ্ন ছিল রেইনবো নেশন নামে ভবিষ্যৎমুখী নতুন ধারার সামাজিক চুক্তির যে চিন্তা সেখানে আধুনিক যুগের রেইনবো মুভমেন্ট বিবেচনায় আছে কিনা। কারণ বর্তমান বিশ্বে ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামী অধিকার আন্দোলনে রেইনবো শব্দটি জনপ্রিয়।
এ ব্যাপারের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “ আপনি সবই কিন্তু একবারে করতে পারবেন এমন কোনো কথা নাই। সেটা করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করারও একটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের যে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অবস্থান মানুষের চিন্তা-চেতনা সেটাকে মাথায় রাখতে হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি গণতন্ত্র যখন বলেন তখনতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের গুরুত্ব দেয়াটাই হচ্ছে গণতন্ত্র। তা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমকামীদের অধিকার যেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে সেটা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত কী”?
রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ এবং প্রশাসন মিডিয়াসহ সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামোয় সংস্কারের প্রয়োজন দেখছে বিএনপি। দলটি বলছে ক্ষমতায় আসতে পারলে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়া সবদলকে সাথে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। তাদেরকে নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে সংস্কার করতে চায় বিএনপি। যদিও এটি বাস্তবে কতটা সম্ভব তা নিয়ে সন্দেহ করছে অনেকেই।
# আবুল কালাম আজাদ, বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা#