বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৭৪):দেশপ্রেম

-বিজন সাহা

বিজন সাহা (ফাইল ছবি)

আজকাল একটা জিনিস খুব চোখে পড়ে। তুমি নিঃস্বার্থ ভাবে কিছু করতে পারবে না, কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। এমন কি বন্ধুত্বের মত নিষ্পাপ ধারণা সেটাও কোন না কোন স্বার্থের খাঁদ দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে।

আমি নিয়মিত লেখালেখি করি। বিশেষ করে বর্তমান রাশিয়া ইউক্রেন সমস্যা নিয়ে। আমি জানি সেখানে রাশিয়ার পক্ষে কিছুটা পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে, তবে সেটা এ কারণে নয় যে আমি রাশিয়ায় থাকি – কারণ বিভিন্ন ঘটনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে মনে করি যুদ্ধটা রাশিয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়া। তাছাড়া বন্ধুদের সাথে কথা বলে আমার ধারণা তাদের কাছে এই যুদ্ধের খবরটা যায় পশ্চিমা বিশ্ব থেকে একপেশেভাবে। তাই আমার প্রচেষ্টা থাকে অন্য দিকের ভার্সন তাদের কাছে পৌঁছে দেবার। চেষ্টা করি যতটা সম্ভব নিরপেক্ষাভাবে সেটা করার, তবে কোন জিনিসের সঠিক বিশ্লেষণ নির্ভর করে তথ্যের উপর। মনে পড়ে ছোটবেলার সেই ধাঁধার কথা? প্রথমে ধাঁধার উত্তর চাইত, সাথে সাথে না পারলে বিভিন্ন হিন্টস দিত। এই হিন্টস হল সেই তথ্য যা সঠিক উত্তর পেতে সাহায্য করে, পথ দেখায়। তাই উত্তর নির্ভর করে হিন্টসের উপর আর সেটাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার উপর। সেদিক থেকে প্রশ্ন আসতেই পারে আমি যে তথ্য পাই সেটা কতটুকু সত্য। আসলে যদি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তথ্য আসে, ছবি আসে তাহলে সেখানকার একটা ছবি পাওয়া যায়। ছবি মিথ্যা নয়, তবে সেটার ইন্টারপ্রিটেশন বিভিন্ন হতে পারে। কারণ একই ছবি বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। নিজের যেটুকু ক্ষমতা আছে সেটা দিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে সেটাই লেখার চেষ্টা করি আর সেটা করি জীবনকে ভালবাসি বলে।

রাশিয়ার সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ সেই ছোটবেলা থেকেই, সমাজতন্ত্র বা এসব বোঝার আগে থেকেই। এ দেশের সাহিত্য পড়ে নিজের কল্পনায় একটা ভিন্ন পৃথিবী গড়ে তুলেছিলাম মনে মনে। পরে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের আইডলজির সাথে। সেই প্রেম এখনও বজায় আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে বলেই আশা করি। কিন্তু সমস্যা হয় যখন অনেকেই, এমনকি যারা আমাকে কমবেশি কাছ থেকে জানেন রাশিয়ার প্রতি আমার এই ভালবাসা পুতিনের প্রতি ভালবাসা বলে দোষারোপ করে। অবাক সব মানুষ। শিক্ষিত, অথচ এটুকু বুঝতে অক্ষম যে দেশ যখন চরম বিপদে তখন তার পাশে থাকাই সত্যিকার ভালবাসা। একথা  লিখতে গিয়ে ইটালি ও জুভেন্টাসের বিখ্যাত খেলোয়াড় ডেল পিয়েরোর কথা মনে হচ্ছে। আমার প্রিয় খেলোয়াড়দের একজন। তাকে যখন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্লাবে খেলার অফার দেওয়া হয় তিনি জুভেন্টাস ছাড়তে অস্বীকার করেন। এরপর জুভেন্টাস যখন সেরিয়া এ থেকে রেলিগেশন করে তখন তাকে নতুন করে প্রস্তাব দেওয়া হয়। উত্তরে তিনি বলেন জুভেন্টাসের এই দুর্যোগে তিনি কীভাবে দল ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন। হ্যাঁ, একজন ফুটবল খেলোয়াড় যা করতে পারেন আমরা বড় বড় ডিগ্রিধারী মানুষেরা অনেক সময় সেটা করতে পারি না। কারণ আমাদের ভালোবাসা প্রায়ই লোকদেখানো। সেটা আমাদের নিজেদের ভালোমন্দের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

এর আগে কোন এক লেখায় আমি বলেছি যে পশ্চিমা বিশ্ব প্রথম থেকেই পুতিন আর রাশিয়াকে আলাদা করার চেষ্টা করছে আর তাতে তারা অনেক ক্ষেত্রেই সফল। কারণ যুদ্ধ যদি পুতিনের বলে চালিয়ে দেওয়া যায় তবে এই যুদ্ধের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কমে। কিন্তু এই ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই বোঝে না যে এটা সেই চির পরিচিত ডিভাইড অ্যান্ড রুল। আগে রাশিয়া থেকে পুতিনকে আলাদা করে তাঁকে পরাজিত করা আর তারপর রাশিয়াকে বশ্যতা মানতে বাধ্য করা। রাশিয়ার বশ্যতা মানে সমস্ত রুশদের পরাজয়। এই যে খেলা আমরা আজ দেখছি তা এক সময়ে বাংলাদেশের সব আন্দোলনকেই শেখ মুজিবের যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁকে হত্যাও করা হয়েছে। এর ফল আমরা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। একই কথা বলা চলে সালভাদর আলিয়েন্দের ক্ষেত্রে। জিয়া হোক আর পিনোচেট হোক – সবার জন্ম একই টেস্ট টিউবে। আসলে কোন দেশের স্বাধীনচেতা নেতাদের আলাদা করে দেখানো – সেটা পশ্চিমা বিশ্বের রণকৌশল। এতে করে নেতাদের জনবিচ্ছিন্ন করা যায়। কারণ দেশের বিরুদ্ধ বললে দেশের মানুষ প্রতিবাদ করে বা করতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি মানুষের অনেক শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে তাই যদি ব্যক্তি মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে সামনে এগুনো যায় তবে তাকে যেমন ধ্বংস করা যায় তেমনি দেশটাকেও ধ্বংস করা যায়। এই তো সেদিনের কথা। ইরাক খারাপ? না। সাদ্দাম খারাপ। লিবিয়া খারাপ? না। গাদ্দাফী খারাপ। কিন্তু শুধু সাদ্দাম বা গাদ্দাফীকে হত্যা করেই এরা শান্ত হয়নি – ইরাক, লিবিয়া – দুটি দেশকে তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে। সে আগুনে দেশ দুটো এখনও জ্বলছে, জ্বলছে দেশের মানুষ। ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা এখনও পর্যন্ত অনস্বীকার্য। তাই সব সময় বেছে বেছে ব্যক্তিকে বের করা হয় আর সুকৌশলে তাঁর উপর আঘাত হেনে পারতপক্ষে আন্দোলন বা প্রতিবাদের কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখার জন্য। এ দিক থেকে দেখলে আমেরিকার রাজনীতিতে ট্রাম্পকে আলাদা করা এই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কেনন না তাঁকে আলাদা করা মানে রিপাবলিকান পার্টিকে দ্বিধা বিভক্ত করা। তাই ব্যাপার পুতিনে বা অন্য কিছুতে নয়, এটা এক ধরণের সুক্ষ কৌশল যা দিয়ে বিরুদ্ধ শিবিরে ভাঙ্গন ধরানো যায়, মানুষকে ভাওতা দেওয়া যায়। যারা ভাবেন বর্তমান পরিস্থিতিতে পুতিন বিরোধিতার নামে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাশিয়ার পক্ষে থাকা যায় তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। আবার পুতিনের বিরোধিতা না করা মানে পুতিনকে সমর্থন করাও নয়। বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সহায়ক সেটা করাই এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের কর্তব্য। এই যুদ্ধ আসলে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ নয়, এটা রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর যুদ্ধ ইউক্রেনের মাটিতে আর সঠিক ভাবে বললে এটা পশ্চিমা বিশ্বের নিও লিবারেল দর্শনের সাথে প্রথাগত দর্শনের যুদ্ধ যেখানে রাশিয়া ফ্রন্ট লাইনে। এখানে পরাজিত হলে শুধু মস্কো নয় ঢাকাতেও দেখবেন সমলিঙ্গের বিয়ে, আত্মহত্যার আইনি অধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব ভালো না মন্দ সে বিতর্কে না গিয়ে শুধু প্রশ্ন করুন আপনি নিজে এটা চান কি না, আপনার সন্তান সমলিঙ্গের কাউকে বিয়ে করুক, সে চাইলেই লিঙ্গ পরিবর্তন করুক বা আত্মহত্যার অধিকার পাক সেটা আপনি চান কি না? বর্তমানে রাশিয়ায় পুতিনের বিরোধিতা করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা অনেকটা একাত্তরে শেখ মুজিবের বিরোধিতা করে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার মত। তার মানে এই নয় যে একাত্তরে সবাই শেখ মুজিবের সমর্থক ছিল, সবাই শেখ মুজিবের জন্যে যুদ্ধ করেছে। তখন হয়তো এমন মানুষও ছিল যাদের শেখ মুজিবকে পছন্দ না করার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। তবে সে সময় সে সেটা করলে আমরা তাকে আর যাই হোক স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ বলে মেনে নিতাম না। তাই যারাই দেশের স্বাধীনতা চেয়েছে তারা এমনকি শেখ মুজিবের সাথে একমত না হলেও সাময়িক ভাবে সেটা দূরে সরিয়ে রেখেছে। ইতিহাস তার নিজের পথে চলে। সময়ই ঠিক করে ইতিহাসের কোন পর্যায়ে কে সেনাপতি হবে। যদি যুদ্ধে জিততে হয়, তবে শত দ্বিমত থাকা সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে বিদ্রোহ করা মানে শত্রুর হাত শক্তিশালী করা। আর যেহেতু জয় পরাজয়ের উপর নির্ভর করছে দেশের, দেশের মানুষের ভাগ্য তাই এখানে দোদুল্যমানতার অবকাশ নেই। তাই যারা কোন ব্যক্তির উপর দোষ চাপিয়ে দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় – তারা আসলে দেশপ্রেমিক নয়, তারা নিজের এই দেশকে ভালো না বাসার জন্য অজুহাত খোঁজে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে কী ব্রিটেন, কী ফ্রান্স, কী আমেরিকা, কী স্পেন – এরা শান্তির বাণী নিয়ে কোন দেশে ঢুকলেও শেষ পর্যন্ত অশান্তিই রপ্তানি করেছে। ডেসমন্ড টুটু লিখেছেন – “মিশনারীরা যখন এলো ওদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের জমি। ওরা বলল চল প্রার্থনা করি। … যখন চখন খুললাম আমাদের হাতে ছিল বাইবেল আর আমাদের জমিজমা, দেশ সব ওদের দখলে।” কথাটা একটু অন্যভাবে বলা হলেও সারমর্ম এটাই। আর মিশনারীরা ছিল এসব সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রতিনিধি। হ্যাঁ, আগে আসত এরা বাইবেল হাতে, ধর্মের বাণী নিয়ে, এখন আসে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি গালভরা বুলি নিয়ে। কিন্তু কখনই সেসব বাস্তবায়িত হয়নি, হলে শেখ মুজিব, আলিয়েন্দে – এদের অকালে প্রাণ হারাতে হত না। তাই শান্তির বাণী মুখে যতই বলুক অশান্তি নিয়েই এরা আসে। এমনকি যদি কেউ মুজিব বা আলিয়েন্দের রাজনীতির সাথে একমত নাও হন, কোন দেশের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা, হত্যা করা সেসব দেশের রাজনীতিতে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে বাধ্য। তাই যারা আমেরিকার মিসাইলে করে গণতন্ত্র নিয়ে আসার পক্ষে তাদের নতুন করে ভাবা দরকার আসলে এতে গণতন্ত্র কি আসলেই আসে, নাকি সেটা গণতন্ত্রের পথে কাঁটা হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া এখন ইউরোপ আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেরাই স্বীকার করছে যে তারা এতদিন ধরে রাশিয়াকে ধ্বংস করার কথা ভেবেছে। মিনস্ক চুক্তি আসলে দনবাসের সমস্যা সমাধানের জন্য ছিল না, ছিল ইউক্রেনকে সময় দেবার যাতে সে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে একথা আঙ্গেলা মেরকেল নিজেই বললেন। এর আগে শুধু মেডলিন অলব্রাইট বলতেন, এখন পশ্চিমা বিশ্বের ছোট বড় সব নেতাই বলেন রাশিয়াকে ভেঙে অনেকগুলো অনুগত দেশ সৃষ্টির কথা। কিন্তু লোকসংখ্যার তুলনায় অনেক বড় দেশ এই যুক্তিতে তো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, এমনকি আমেরিকা পর্যন্ত কতগুলো দেশে পরিণত হতে পারে। ইউক্রেন নিজেও বেশ বড় দেশ, যেমন কাজাখস্তান। তাই এসব কথার কথা, আসল কথা রাশিয়াকে ভাঙতে হবে কেননা এতদিন পর্যন্ত একমাত্র রাশিয়াই পশ্চিমা বিশ্বের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। আমেরিকা তার লক্ষ্য ঠিক করেছে রাশিয়াকে ধ্বংস করার। এটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের হাতে শুধু বর্তমানের আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সাবেক যুগোস্লাভিয়াই ধ্বংস হয়নি, বিভিন্ন সময়ে ধ্বংস হয়েছে অটোমান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, স্পেন সাম্রাজ্য ও জাপান সাম্রাজ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় আমেরিকার হাতে ধ্বংস হয়েছে জার্মান, ফ্রেঞ্চ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। এমনকি আজও জাপান আর জার্মানিতে রয়েছে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনেও আমেরিকা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তাই যদি কেউ ভাবে পুতিনের বিরোধিতা করে রাশিয়ার পক্ষে থাকা যাবে বা রাশিয়াকে আমেরিকার থাবা থেকে রক্ষা করা যাবে তারা ভুল করছে।

পোল্যান্ড বা অন্যান্য যে সমস্ত দেশ আজ আগ বাড়িয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়, আমেরিকার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে নিজেরা শক্তিশালী হতে চায়, তারা ভুলে যায় যে তাদের আদর ঠিক ততদিন যতদিন শক্তিশালী রাশিয়া আছে। আমেরিকার শক্তিশালী পোল্যান্ড বা অন্য কোন দেশের দরকার নেই। তার দরকার অনুগত ভৃত্য যে প্রশ্ন করবে না, শুধু কর্তার স্বার্থে কাজ করে যাবে। ঠিক যে মূহুর্তে রাশিয়া শক্তি হারাবে এসব দেশ হারাবে সব ধরণের সুযোগ। তাই ইউরোপের নিজের স্বার্থেই শক্তিশালী রাশিয়া দরকার। কারণ এটা কিছুটা হলেও আমেরিকার ক্ষমতার মনোপলি খর্ব করে। প্রভু তার ভৃত্য বা অনুগামীদের কখনোই পূর্ণ স্বাধীনতা দেন না, দিতে পারেন না এমনকি তিনি যদি পরম করুণাময় ঈশ্বরও হন। ইতিহাস সেটা বলে, বাইবেলের গল্প সেটাই বলে। আর এ জন্যের সবচেয়ে কাছের ও সর্বপ্রধান ফেরেশতা হওয়া সত্ত্বেও শয়তানকে স্বর্গচ্যুত হতে হয়েছিল। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র নীতি দুটো বাক্যেই পরিস্কার হয়ে ওঠে। চার্চিলের ভাষায় “বৃটেনের কোন বন্ধু নেই, আছে জাতীয় স্বার্থ।” আর ১৯৪১ সালে ট্রুম্যান বলেছিলেন “যদি জার্মানি সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে শুরু করে তবে আমেরিকার উচিৎ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সাহায্য করা, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন জিতলে জার্মানিকে সাহায্য করা।” ভাবার কারণ নেই যে আমেরিকা দুর্বলের পাশে দাঁড়ায়। সে সবলের বিরুদ্ধে। কেউ সবল হোক সেটা সে চায় না। ক্ষমতার বাজারে নিজের মনোপলি বজায় রাখাই তার একমাত্র লক্ষ্য। তাই কোন ব্যক্তি বা কোন দেশ যদি ভাবে অন্যের সাহায্যে শত্রুকে শায়েস্তা করবে তাহলে সে নিজের স্বাধীনতার কিছুটা সেই তৃতীয় পক্ষকে বর্গা দেবে। কোন গ্যারান্টি নেই যে সেটা একদিন শূল হয়ে বেরুবে না। তাই যারা বর্তমান শাসক তা সে পুতিন, মোদী, হাসিনা বা অন্য যে কেউই হোক, ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্বের দ্বারস্থ হয় তারা আসলে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিদেশীদের হাতে তুলে দিয়ে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করে।

অনেকেই দনবাসের ঘটনাকে ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চালিয়ে দিতে চায়। তারা কি ভুলে গেছে যে একাত্তরে পাক বাহিনীর গণহত্যা আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জাতিসংঘে পাশ করাতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল আর ছিল স্বাধীন ইউরোপ।

আমরা অনেক সময়ই সরকার ও অন্যায়কে গুলিয়ে ফেলি। অনেকের ধারণা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা বিশেষ করে সেটা যদি অন্য দেশের বা শত্রু দেশের সরকার হয়। হ্যাঁ, সরকার দেশের প্রতিনিধি। সে ভালো না মন্দ সেটা নির্ভর করে কে বিচারক। তবে এটা বলতে পারি যে সরকার নিজের দেশের মানুষের বা দেশের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির পক্ষে কথা বলে সে বাই ডিফল্ট আমেরিকার চোখে অগণতান্ত্রিক ঠিক যেমন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একজন বিধর্মীকে রক্ষা করলে ধার্মিকদের চোখে সে ধর্মের শত্রু।

 

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো