মতামত

বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণি সুবর্ণ জয়ন্তীতে কেমন দিন কাটাচ্ছেন?

-অধ্যাপক এম এম আকাশ

অধ্যাপক এম এম আকাশ (ফাইল ছবি)

-২য় পর্ব-

প্রথম পর্র

আমাদের প্রথম পর্বটি হচ্ছে ১৯৭২-৭৫ তিন বছরের একটি ছোটো পর্ব। এই সময় আর্থসামাজিক  সংকটের স্বরপটি কি? এই  সময় বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে  আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয়েছে। তাঁর দুই পাশে ছিলেন দুই ভিন্ন প্রবণতা সম্পন্ন রাজনৈতিক সহযোগী ব্যক্তিত্ব। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এবং শ্রমিক-কৃষকের সার্থ রক্ষার জন্য এক ধরনের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল অবস্থানে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের সময় তাঁর এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় এবং তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের জন্য প্রবলভাবে ইন্দো-সোভিয়েত সমর্থনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ছায়ায় অগ্রসর হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের অধিকাংশ শিল্প-কারখানা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা হয়।  যদিও কৃষি খাতে জমির মালিকানার সিলিং নিয়ে দোদুল্যনানতা ছিল। বঙ্গবন্ধু অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাকশাল কর্মসূচীর অধীনে জমির যৌথ সমবায়ী ব্যবস্থাপনার কথাও ভেবেছিলেন এবং মৃত্যুর আগে আগে তিনি একটি তেভাগা প্রস্তাবও দিয়েছিলেন । তার প্রস্তাবটি ছিল চীনে বর্তমানে প্রচলিত “ভূমির পারিবারিক দায়িত্বে পরিচালনার” পদ্ধতির অনুরূপ। যেখানে জমির মালিক প্রধানত জমি পারিবারিকভাবে চাষ করবেন এবং ফসল তিন ভাগে বিভক্ত হবে। একটি ভাগ পাবেন স্থানীয় নির্বাচিত কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রের নিম্নতম প্রশাসনিক ইউনিট যার ভূমিকা হবে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা( সার, বীজ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) দ্বিতীয় একটি ভাগ চলে যাবে শ্রমদাতার কাছে অর্থাৎ পারিবারিক শ্রমিক ও বাইরের নিয়োজিত শ্রমিকদের (যদি থাকে) কাছে এবং তৃতীয় ভাগটি থেকে যাবে জমির মালিকের হাতে। এই অভিনব অংশীদারিত্বমূলক পদ্ধতিটি চীনে অতীত কমিউন পদ্ধতি ভেঙ্গে ১৯৭৯ সাল থেকে যে “House hold responsibility system”  পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল তার অনুরূপ। এর জন্য অবশ্য পারতিষ্ঠানিক পুর্ব শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ভূমি মালিকানা বা “রাষ্ট্রীয় ভূমি ব্যবহার আইন” প্রণয়ন, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসন  সৃষ্টি এবং একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন। একটি নির্বাচিত বিকেন্দ্রীভূত স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব ছাড়া এ ধরণের ব্যবস্থা কার্যকরী করা সম্ভব নয়। বংগবন্ধু যখন এই প্রস্তাব পেশ করেন তখন অবশ্য তাঁর দলের মধ্যে এ নিয়ে ঐক্যমত্য ছিল না। সুবিধাভোগী আমলাতন্ত্র ও বড় জোতদাররা এর প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। এর পরেও প্রাথমিক্সূচনা হিসেবে তিনি কেন্দ্রীয় আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা খর্ব করে “নির্বাচিত জেলা গভর্ণর” প্রথার প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন। যদিও প্রথমে নির্বাচনের বদলে তা তিনি শুরু করেন জেলা গভর্ণর পদে পছন্দসই ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়ে। এতে দলের ভিতরে বাইরে নানা মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়।

একই সঙ্গে শিল্পখাতে শ্রমিকদের ও ব্যবস্থাপকদের একটি কার্যকর অংশগ্রহণ মূলক পরিচালনা ব্যবস্থার প্রস্তাব নিয়ে তখন চিন্তা হয়েছিল। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিকেন্দ্রীভূত Performance Contract নিয়েও চিন্তা ছিল। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে জাতীয়করণ করে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র  কর্তৃক সেসব সার্বজনীন সেবা সরবরাহ করার নীতিগত প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। ছুটির সময়ে ছাত্রদের উৎপাদনমূলক কাজে অংশগ্রহণের কথাও ভাবা হয়েছিল। কর্নেল তাহেরসহ কেউ কেউ সে সময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে Cantonment এর ভেতরে উৎপাদন মূলক কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ব্যাংক, বিমা ও বৃহৎ সম্পদ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রনে /মালিকানায় আনার ব্যবস্থা হয়েছিল। ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়েছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের রেশন চালু হয়েছিল এবং নিত্য কৌশলগত পণ্যের জন্য মুক্ত বাজারের বদলে  নিয়ন্ত্রিত বাজারের আদর্শ গৃহীত হয়েছিল।এককথায় বাংলাদেশের নিজস্ব বাস্তবতা  অনুসারে বিকেন্দ্রীকরন গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণমূলক সমাজতন্ত্রের কথাই বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্ন দ্বারা সমগ্র আওয়ামী লীগ তখন  উদ্বুদ্ধ হয়নি। আওয়ামী লীগের “র‍্যাডিকেল অংশ” তখন তাকে পরিত্যাগ করে শ্রেণি সংগ্রাম ত্বরান্বিতকরণ এবং সামাজিক বিপ্লব সাধন করার ইউটোপীয় স্বপ্ন নিয়ে সরকারের বিপরীতে চরম বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছিল –তারই এককালীন প্রিয় শিষ্য সিরাজুল আলম খান ছিলেন এদের নেতা।

চলবে  . . .

(প্রবন্ধটি বিগত ১৮ নভেমবর ‘২২ তারিখে টিইউসি চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক আয়োজিত জননেতা চৌধুরী হারুনর রশীদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে পঠিত হয়েছে)

লেখকঃ রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি বিভাগ