মতামত

জাসদের আত্ম প্রকাশ: যড়যন্ত্রের তত্ব …..২য় পর্ব

– অপু সারোয়ার

অপু সারোয়ার (ফাইল ছবি)

তিন

“আমরা লড়ছি শ্রেণী-সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য” –  জাসদের জন্ম-কালের ঘোষণা। অনন্য সাধারণ  ঘোষণা। একটিমাত্র বাক্যের মধ্য দিয়ে দলের লক্ষ্য সমাজ পরিবর্তনের  বার্তা  সামনে নিয়ে আসার কৃতিত্ব জাসদের। যুদ্ধত্তোর দেশে পরিবর্তনকামী লক্ষ যুবক- যুবতীদের  আকৃষ্ট করেছিলো জাসদের ঘোষণা – রাজনীতি।  ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের দিন। জাসদের জন্ম ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর। সময়ের ব্যবধান দশ মাসের সামান্য বেশী। নতুন দেশে হঠাৎ করে নতুন রাজনৈতিক দলের কেন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল সে সম্পর্কে জাসদ নেতারা কখনোই সবিস্তারে কথা বলেন নাই। জাসদ গঠনের কারণ গুলোর অস্পষ্টতা জন্ম দিয়ে আসছে নানান প্রশ্নের।

যুদ্ধত্তোর দেশে অবিভক্ত ছাত্রলীগের মধ্যে দুই ধারা ছিল। জাতীয়তবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারা ও জাতীয়তাবাদী পুঁজিবাদী ধারা। উভয় ধারা  শেখ মুজিবুর রহমানের আশীর্বাদ পেতে আগ্রহী ছিল। উভয় ধারাই শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা – বিবৃতিকে নিজেদের স্লোগান – চিন্তার ছাঁচে ফেলে কর্মীদের ধরে রাখার চেষ্টা করে আসছিল। উভয় ধারা ‘ মুজিববাদ’ দর্শনের ঝান্ডা উড়িয়েছিল।  ১৯৭২ সালের ২১শে জুলাই এই দোলচালের অবসান ঘটে। জাতীয়বাদী পুঁজিবাদী ধারা শেখ মুজিবুর রহমানকে কাছে টানতে সক্ষম হয়। জাসদের তাত্বিক ও নেপথ্যের নায়ক সিরাজুল আলম খানের দাবী -২০শে জুলাই ১৯৭২, ছাত্রলীগের উভয় গ্ৰুপের পৃথক সম্মেলনের পূর্বের অতিক্রান্ত মধ্য রাত পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক পরিত্যাক্ত হওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পারা যায় নাই। (১0) শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক পরিত্যাক্ত হওয়ায় পর অতি দ্রুত ছাত্রলীগের জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারা শেখ মুজিবুর রহমানের  মারমূখী  বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়ে। গঠিত হয় জাসদ ৩১ অক্টোবর ১৯৭২। জাসদ গঠন ছিল দুঃসাহসিক ও স্পর্ধিত পদক্ষেপ।

১৯৭১ সালের যুদ্ধপূর্ব কালে ছাত্রলীগের জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারা শেখ মুজিবর রহমানের প্রধান রাজনৈতিক বার্তা বাহক ছিল । জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হয়ে উঠে আসে। যুদ্ধত্তোর দেশে শেখ মুজিবর রহমান নিজেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারা থেকে। রাজনৈতিক সংগঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোন বিজয়ী ধারাকে তাৎক্ষণিক ভাবে থামানো যায় না। ইতিহাসের কোন গতিশীল প্রক্রিয়াকে  ইচ্ছে করলেই থামিয়ে দেয়া যায় না। জাসদের গঠন ও বিকাশ ছিল যুদ্ধপূর্ব কালে ছাত্রলীগের জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ধারার স্বাভাবিক গতি। ১৯৭০ এর দশকে বিশ্ব ব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসরমান ছিল। জাসদ এই সময়কে ধরতে পেরেছিল। সময়কে ধরতে পাড়ার কারণেই প্রধানত ছাত্র বুদ্ধিজীবী,  শ্রমিক ও  যুবকদের মধ্যে  বিপ্লবী আকাঙ্খা ও উন্মাদনা তৈরীতে সফল হয়েছিল জাসদ ।  বিপ্লবের আকাঙ্খা ও স্বপ্ন নিয়ে জাসদের রাজনীতি শুরু হলেও স্বপ্ন ও আকাঙ্খার পরিসমাপ্তি ঘটেছে দলের ভাঙ্গন ও সুবিধাবাদী প্রবণনতার স্রোতে। ভ্রূনেই জাসদ রাজনীতি পথ হারা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম -মুক্তিযুদ্ধ  ও জাতীয়তাবাদী ধারার অভিজ্ঞতা ছিল জাসদ  উদ্যোক্তাদের।  সমাজতন্ত্র- বিপ্লবী পার্টি গঠন , রাজনৈতিক অনুশীলনের মত বিষয়ে জাসদ নেতারা নবীন ও অদক্ষ ছিলেন। শুধু মাত্র আন্তরিকতা ও আত্ম ত্যাগ দিয়েই চলতি পথেই রাজনৈতিক লাইন  নির্ধারণ প্রচেষ্টা জাসদকে গতিহীন করে দিয়েছে।

রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার অভাবে মস্কো-চীন ধারার বাম্পন্থাকে কখনো কখনো   অনুকরণ করে আসছে জাসদ । শেখ মুজিবের শাসনামলে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের প্রভাব বলয়ে রাজনীতির হাল ধরতে গিয়ে ধ্বংসের মুখোমুখী দাঁড়িয়ে গিয়েছিল জাসদ । চীনপন্থী বলয়ের তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে দুই স্তর বিশিষ্ট জনগণতান্ত্রিক বা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব । ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকে এই অঞ্চলের চীনপন্থী কমিউনিস্টদের রাজনীতি দারুন ভাবে প্রভাবিত ছিল নকশাল আন্দোলন । সশস্র সংগ্রাম, জনগণের বাহিনী, মুক্তাঞ্চল , শ্রেণী শত্রু জাতীয় রাজনৈতিক স্লোগান ও কর্মপন্থা ছিল চীনা বামপন্থীদের। এই ধারার প্রভাবই ছিল জাসদের গণবাহিনী। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার প্রধানত ছাত্র বুদ্ধিজীবীরা বৈপ্লবিক রোমান্টিকতায় গনবাহিনীতে যুক্ত হয়েছিল। গণ বাহিনী না ছিল গণ , না ছিল বাহিনী। ‘ গণবাহিনীর ইউনিট গুলো কোন কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় ছিল না। ‘ (১১)  দেশের যে সমস্ত এলাকায় চীনপন্থীদের সশস্র অবস্থান ছিল সেই এলাকা গুলিতে গণবাহিনীর তৎপরতা বেশি ছিল।  ভুল শুদ্ধ যাই হোক গণবাহিনীর গঠন ও অস্তিত্ব জাসদের কোন অংশ অস্বীকার করে না  । তবে জাসদের ‘অদলীয় ‘ নেতা সিরাজুল আলম খান নিজেস্ব স্বভাবগত ধারায় গণবাহিনী সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য হাজির করেছেন।“ ‘স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ প্রশাসনের কাছে ‘গণবাহিনী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এটি ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ নামে পরিচিত হতে থাকে, যদিও ‘সিওসি’ অথবা জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি এ নামে কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেনি কিংবা কাউকে তা করার অনুমতি দেননি।  (১২) একই বইয়ের মাত্র কয়কে পাতা পরেই সিরাজুল আলম খান  নিজ বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। ” জাসদের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবেই ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ ও পরবর্তীতে ‘গণবাহিনী’ গড়ে উঠেছিল। ‘সিওসি’ (সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি) ছিলো এসব কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রক  কেন্দ্র।( ১৩)

জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯-১৯৮০ সাল নাগাদ জাসদ সিপিবি আদর্শিক বলয়ে ঢুকে পড়ে। সিপিবির তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব। অধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়ার দুই স্তর বিপ্লব। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্বে সিপিবির আদর্শিক বলয়ের প্রচণ্ড বিরোধিতা করেই জাসদের বিকাশ হয়েছিল। ১৯৮০ সালের আওয়ামীলীগ, সিপিবি সাথে নিয়ে ১০ দলীয় জোটে শামিল হওয়া ছিল দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সিপিবি প্রভাব বলয়ে ভিড়ে যাওয়ার প্রথম পদেক্ষপ। এই ধারায় ১৯৮৩ সালে জেনারেল এরশাদ বিরোধী ১৫ দলীয় জোটে জাসদ-বাসদের সক্রিয় অংশ গ্রহণ। এই ধারাতেই জাসদীয় ( জাসদ – বাসদ ) ধারা ৫ দল , বামফ্রন্ট সিপিবির রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলছে। ১৯৭৯ সালে জাসদের জাতীয় সরকারে যোগ দেওয়ার তত্ব সিপিবি প্রভাব বলয়ের দক্ষিণ পন্থী রূপ।

জাসদের সমাজ বিশ্লেষণ ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত। বাংলাদেশ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে। বর্তমান কালে ধনিক শ্রেণী সমস্ত প্রগতিশীল ভূমিকা পালনে অসমর্থ। অসমাপ্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটি অপরটির এতে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে। বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দিবে সর্বহারা শ্রেণী। জাসদ নিজেস্ব ধারাতে খুব বেশি স্থির থাকতে পারে নাই। জাসদ ঘোষিত লক্ষ্যে স্থির থাকলে গণবাহিনী কিংবা জাতীয় সরকারের অনুশীলন বা তত্ব জন্ম নিত না।

চার

জাসদ নিজেকে সমাজ বিপ্লবের সহযোগী হিসেবে দাবী করে থাকে । মূল শক্তি থেকে বা মূল শক্তিকে ঘিরে সহযোগী সংগঠনের জন্ম নিয়ে থাকে। মূল শক্তির অনুপস্থিতিতে সহযোগী সংগঠন হিসেবে জাসদীয় দাবী অনেকটা বাউল গান ‘ ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম’ এর মত শোনায়। ন্যাপ গঠনের পিছনে কমিউনিষ্ট পার্টির উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ থেকে অগ্রবর্তী কর্মীদের দলে টানতে সক্রিয় ছিল। বামপন্থার বিকাশ ঘটাতে ন্যাপ কর্মী সংগ্রহ ও গণসংগঠনে কাজ করতে কমিউনিস্ট পার্টিকে সহায়তা করেছিল। ন্যাপের পিছনে মূল শক্তি ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। জাসদ গঠন ছিল অনেকটা উল্টো ন্যাপ গঠনের মতো। জাসদ উল্টোভাবে অগ্রবর্তী কর্মীদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগী হয়েছিল। সাধারণ ভাবে একটি রাজনৈতিক দল দেশের সমস্যা ও চালচিত্র বিশ্লেষণ ও সমাধানের জন্য কর্মসূচী জনগণের সামনে তুলে ধরে। দেশ ও সমাজের সমস্যা খালি চোখে দেখা যায় বা অনুভব করা যায়। তবে সমস্যা গুলির সমাধানের পথের দিশা তৈরী সহজ নয়। প্রয়োজন অধ্যায়ন ও অনুশীলন। ডান-বাম সকল দলের রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষণ থাকা আবশ্যক। জাসদ সমাজ পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিল কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে কি করতে চায় সে সম্পর্কে স্পষ্ট অবস্থান ছিল না। ১৯৮০ সালে জাসদের দ্বিতীয় কাউন্সিলের কার্য্যকরী সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে রাজনৈতিক দিশা ও কাঠামো গড়ার অক্ষমতার বিষয়টি সামনে আসে। ” ১৭ মার্চের  [ ১৯৭৪] পূর্বে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ , বিপ্লবের স্তর সম্পর্কে আমাদের কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। স্বভাবতই শত্রু মিত্র নির্ধারণ ও আন্দোলনের রূপরেখা সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক ধারণা ছিল অনুপস্থিত। (১৪)

পাঁচ

শুরুতেই জাসদ রাজনৈতিক দিশা ও কাঠামো গড়তে অসমর্থতার পরিচয় দেয়। এই ব্যর্থতা জাসদ নেতাদের আচরণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। জাসদ নেতারা নীতিবহির্ভুত ভাবে দশ দিগন্তে ছোটাছুটি করে আসছিল। নেতাদের দশ দিগন্তে ছোটাছুটি সম্পর্কে অধিকাংশ নেতা ও সাধারণ কর্মীরা অন্ধকারে ছিল। জাসদের নিবেদিত-প্রাণ অসংখ্য নেতা-কর্মী, দলের শুভানুধ্যায়ীদের সমতা ভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা শুরু জাসদের জন্মলগ্ন থেকেই। নতুন স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক প্রত্যাশা বাস্তবায়নের স্লোগান তুলে দেশীয় শাসক গোষ্ঠী ও বিদেশী বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক শক্তি বা রাষ্ট্র সাথে গোপন যোগাযোগ প্রতারণা ।

শেখ মুজিবর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ‘ভারতীয়’দের সাথে জাসদ নেতাদের কোন কোন অংশের যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগ গুলির সংগঠিনিক  সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হওয়ার সম্ভবনা কম। কারণ এই যোগাযোগ গুলি ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ে। যোগাযোগ গুলি ছিল গোপনীয়।  জাসদের উপর পর্যায়ের নেতাদের কারো শেখ মুজিবর রহমান কিংবা পরবর্তী শাসক গোষ্ঠীর সাথে গোপন যোগাযোগ নিয়ে এক সময় জল্পনা কল্পনা ছিল। সকল  জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়েছে সিরাজুল আলম খানের আত্ম জীবনী।  সিরাজুল আলম খান আত্ম জীবনী মূলক বই ” আমি সিরাজুল আলম খান ও প্রতিনায়ক এই দুইটি বইয়ে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে গোপন যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছেন। (১৫) জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শরীফ নুরুল আম্বিয়া অধুনা লুপ্ত দৈনিক গণকণ্ঠ -জাসদের মুখপত্র অফিসে ‘ ইন্ডিয়ানরা ‘ নিয়মিত , যখনই  ফিল করত গণকণ্ঠ অফিসে বসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। (১৬)

জাসদের ভরা যৌবনে ১৯৭৪ সাল। জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের গণহত্যা ও যুদ্ধকালীন নানা বিষয় অমীমাংসিত ছিল। দল হিসেবে জাসদ ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক চিন্তা আকাশ পাতাল ফারাক। ২৭ জুন ১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। তৎকালীন জাসদ সভাপতি মেজর জলিল দলের অগোচরে পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছিলেন। (১৭) জাসদ ও গণকণ্ঠ প্রকাশের জন্য লিবিয়ার মুয়ামা গাদ্দাফী কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের কথা নিজেই স্বীকার করেছেন মেজর জলিল । এই অর্থ জাসদের শীর্ষ নেতাদের সিরাজুল আলম খান, আসম রব , শাহজাহান সিরাজ প্রমুখদের হাত দেওয়ার কথা মেজর জলিল লিখিত ভাবে দাবী করেছেন। (১৮) কোন অনুদান বা সাহায্য শর্তহীন নয়। লিবীয় সাহায্যের বিনিময়ে জাসদ ‘ ধারাবাহিক ভাবে দলীয় ভাবে পরিচালিত গণকণ্ঠ পত্রিকায় গাদ্দাফির গ্রীন বুক’ প্রকাশ করেছিল । (১৯) জাসদের ঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচীর সাথে গাদ্দাফির গ্রীন বুকের কোন মিল নেই বা ছিল না । জাসদ যখন লিবীয় অর্থ সহয়তায় চলছিল। তখন শেখ মুজিবর রহমানের খুনী কর্নেল ফারুক- রশীদদের নিরাপদ আশ্রয় দাতা ছিল লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকার। জাসদের কাছে বিষয়টি অজানা ছিল না। মেজর জলিল স্পষ্ট ভাবেই জানিয়েছেন জাসদ নেতারা ফারুক- রশীদদের লিবিয়ার যোগাযোগের বিষয়টি জানতেন। (২০)  গাদাফির গ্রীন বুকের অনুবাদক ছিলেন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। তিনি জাসদ নেতৃবৃন্দকে পাশ কাটিয়ে লিবীয় দূতাবাসের কাছ থেকে আর্থিক সহয়তায় অনুবাদের কাজ করেছিলেন। (২১)  ঘাট ডিঙিয়ে ঘোড়ায় চড়ার স্বাদ নিয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা !

ছয়

শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সিরাজুল আলম খানের যোগাযোগের বিষয়টি কয়েক দশক আগে অনেকটা অনুমান নির্ভর ছিল। সিরাজুল আলম খান এই অনুমান নির্ভরতার অবসান ঘটিয়েছেন। রাজনৈতিক দ্বিচারিতা-বিশ্বাস ঘাতকতাকে মহিমানিত্ব করার চেষ্টায় সিরাজুল আলম খান কিছু নির্বাচিত তথ্য প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। এই প্রচেষ্টা শেখ মুজিবর রহমানের ১৩৬৫ রজনীর শাসনকে রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা। অপর দিকে শেখ মুজিবের আলোকে যতটুকু সম্ভব নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা মাত্র। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও শেখ মুজিবর রহমানের আঁতাত – যোগাযোগ হয়েছিল এই জাতীয় কিছু দুর্বল মত প্রচলিত আছে। এই সাফাইকারীরা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুলতে অভ্যস্থ ১৯৭২-১৯৭৫ সালে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না। ২১ জুলাই ১৯৭২ সালের ছাত্রলীগ ( বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ) এর যাত্রা শুরুর দিন থেকেই এই ধারার উপরে তৎকালীন সরকারী দল আওয়ামীলীগের আক্রমণ শুরু হয়েছিল। অক্টোবর ১৯৭২ সালে জাসদ গঠন হলে এই হামলার মাত্রা তীব্রতর থেকে তীব্রতর হয়েছিল।

সিরাজুল আলম খানই একমাত্র বামপন্থী নেতা নন , আরো বেশ কিছু বামপন্থী নেতা যাদের দলের নেতা কর্মীরা প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণের শিকার ছিল তাঁদের কেউ কেউ গোপনে শেখ মুজিবর রহমানের আতিথেয়তা ও আঁতাতে ধন্য হয়েছেন। তৎকালীন পূর্ববাংলার   সাম্যবাদী দল (এম -এল ) নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা গোপন আঁতাতকারীদের একজন। মোহাম্মদ তোয়াহা  যখন শেখ মুজিবর রহমানের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলেন ঘটনাক্রমে   সেখানে সিরাজুল আলম খান ছিলেন। দুই জন কুশলাদি বিনিময় করেছিলেন।   এই সাক্ষাতের আগে মোহাম্মদ তোয়াহা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে শেখ মুজিবের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। (২২)   মোহাম্মদ তোয়াহার আত্ম জীবনীতে শেখ মুজিবের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপি সংযুক্তি হিসেবে জায়গা পায়  নাই। শেখ মুজিবর রহমানের সাথে বৈঠক নিয়ে মোহামদ তোয়াহা স্মৃতি কথায় লিখছেন ” শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাতের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার ব্যবস্থাদি গড়ে তুলব ঠিক করলাম ” (২৩)

গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে রাজনৈতিক আলোচনা রাতের অন্ধকারে গোপনে সংগঠিত হওয়ার কথা নয়। মুজিব – সিরাজুল আলম খান বা মোহাম্মদ তোয়াহার   আলোচনার বিষয়বস্তু একান্ত ব্যাক্তিগত হিসেবে থেকে গেছে।  সিরাজুল আলম খান নিজের রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য ছিটেফোঁটা ঝোলা থেকে বের করে কিছুটা আগ্রহের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন জাসদ ঘরনার মানুষদের মধ্যে। রাজনীতিতে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মত পথের ভিন্নতা , ভিন্ন দল গঠন ইত্যাকার বিষয় নিশ্চিত ভাবে ব্যাক্তিগত সম্পর্ককের ইতি টানে।  জাসদ ও জাসদের নেতা কর্মীদের জীবন  বিপন্ন ছিল শেখ মুজিবের শাসনামলে। আওয়ামী লীগ এবং দলের নেতা শেখ মুজিব কখোনোই কেন সিরাজুল আলম খানকে  প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে না করাই বড় রহস্য জনক।

সাত

সিরাজুল আলম খানই ইতিহাসের একমাত্র ব্যাক্তি নন এই জাতীয় গোপন আঁতাতের   নজির ইতিহাসে রয়েছে। ১৯১৭ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের সময় রাশিয়ার সংসদে বলশেভিক পার্টির সংসদীয় নেতা রোমান মালিনোভস্কি  (Roman Malinovsky ) ছিলেন এই জাতীয় একজন।(২৪)    শেখ মুজিবর রহমান সহ অন্য শাসকদের সাথে গোপন আঁতাতের বিষয়টির পাথুরে প্রমান হচ্ছে  সিরাজুল আলম খান ও মোহাম্মদ তোয়াহার আত্ম জীবনীতে বিষয় গুলির উল্লেখ থাকা। রোমান মালিনোভস্কি শুধু সংসদে  বলশেভিক পার্টির নেতৃস্থানীয় ছিলেন না।  ১৯১৭ সালের কেন্দ্রিয় লেনিনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কমিটির রাশিয়ান ব্যুরোর প্রধান এবং বিপ্লবী পদে পুলিশের অনুপ্রবেশের উপর পার্টির নজরদারিকারী ছিলেন।  রোমান মালিনোভস্কি বলশেভিক পার্টির নির্দেশের রাশিয়ার সংসদ পদত্যাগ করেছিলেন। রোমান মালিনোভস্কি এর বিরুদ্ধে প্রথম জারের চর হিসাবে কাজ করার অভিযোগ এনেছিল মেনশেভিক নেতারা ১৯১০ সালে । লেনিন মেনশেভিক নেতাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক লেখা প্রকাশ করে  মালিনোভস্কিকে সমর্থন করছিলেন । এর পর বুখারিন সহ বেশ কিছু নেতা তাদের গ্রেফতারের জন্য  মালিনোভস্কিকে দায়ী করলেও লেনিন বিষয়টি গুরুত্ব দেন নাই। বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে জারের পুলিশের চরদের অনুসন্ধান করতে যেয়ে রোমান মালিনোভস্কি এর বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ঘটনাটি লেনিনের জন্য চরম বিব্রতকর ছিল। পরে বলশেভিক পার্টির বিচারে রোমান মালিনোভস্কিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান ও কার্যকর করেছিল ১৯১৮ সালে। রোমান মালিনোভস্কিদের খুঁজে বের করতে রাশিয়ায় বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছিল।

বাংলাদেশে বিপ্লবের সম্ভবনা নেই। বিপ্লবী আন্দোলনের চর বা অতাতকারীদের চিহ্নিত করণের কোন সম্ভবনা জন্ম নিবে না। তবে অতাতকারীদের কেউ কেউ নিজেদের অপকর্মকে মহিমান্তিব করার চেষ্টাতেই  শাসক শ্রেনীর নানা অংশের সাথে দহরম মহরমকে প্রকাশ করে চলছে।

তথ্য সূত্র

(১০) পৃষ্ঠা ২৬৬। প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। ফেব্রুয়ারী ২০২১ ।

(১১) পৃষ্ঠা ১৫৮। জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ।

(১২) পৃষ্ঠা ১৭১।আমি সিরাজুল আলম খান – একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য। শামসুদ্দিন পেয়ারা।

(১৩) পৃষ্ঠা ২১৯। পূর্বোক্ত।

(১৪) জাসদের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ উপস্থাপিত রিপোর্ট -২৯ মার্চ ১৯৮০। পৃষ্ঠা ১৪। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন শাহজাহান সিরাজ। ১৯৮৬ সালের জেনারেল এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে সহায়তা করেন। পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন।

(১৫) পৃষ্ঠা ৩৩৬, ৩৩৭, ৩৩৮।। প্রতিনায়ক -সিরাজুল আলম খান। লেখক: মহিউদ্দিন আহমদ।

(১৬) পৃষ্ঠা ৩১২। প্রতিনায়ক – সিরাজুল আলম খান। লেখক – মহিউদ্দিন আহমদ. প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন। শরীফ নুরুল আম্বিয়া জাসদের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের বিভক্তির পর ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী) অংশের সভাপতি ছিলেন। শুরু থেকেই জাসদের নীতি নির্ধারণীদের অন্যতম ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ জাসদ এর সভাপতি।

(১৭) পৃষ্ঠা ১১৭। জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ।

(১৮) পৃষ্ঠা ১৩।  ‘ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের জাতীয় কমিটির সদস্যদের প্রতি ‘ – লেখক মেজর (অব:) এম এ জলিল।  ১৯৮৩ সালে জাসদ জাতীয় কমিটির সদস্যদের কাছে দেওয়া বক্তব্য পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে লেখক মেজর (অব:) এম এ জলিল এর জাসদ রাজনীতির সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮৩ সালে মেজর জলিল জাসদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। ১৯৮৩ সালে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। জাসদের অতি অল্প সংখ্যক মেজর জলিলের পথ অনুসরণ করেছিল। পরে হাফেজী হুজুরের নেতৃত্বে ১১ টি ইসলামী দলের জোটের সাথে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। মেজর জলিলের অকাল মৃত্যুর পরে এই জোট ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের কোন সক্রিয়তা চোখে পড়ে না।

(১৯) পূর্বোক্ত

মোয়াম্মার আল গাদ্দাফী রাজনৈতিক চিন্তার গ্রন্থিত রূপ  কিতাবিল আখদার বা দ্যা গ্রীন বুক বা সবুজ গ্রন্থ। ১৯৭৫ সালে  তিন খণ্ডে প্রকাশিত এই গ্রন্থে সমাজ এবং রাষ্ট্র সংক্রান্ত গাদ্দাফির  দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত হয়েছে।

(২১) পৃষ্ঠা ২৫৬। জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ। ফেব্রুয়ারী ২০১৫ ।

(২২) পৃষ্ঠা ২৬৯। স্মৃতি কথা : মোহাম্মদ তোয়াহা।

(২৩) পৃষ্ঠা ২৭০।  পূর্বোক্ত

(২৪)  Roman Malinovsky, a Life Without a Cause by Klaas Aposto