বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা(৬৯): অক্টোবর বিপ্লব

– বিজন সাহা

মহান অক্টোবর বিপ্লবের ১০৫ তম বার্ষিকী অনেকটা অগোচরেই চলে গেল। আমাদের ছাত্র জীবনে রেড স্কয়ারে মিলিটারি প্যারেড হত না, তবে বিশাল জনসমাবেশ হত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল করে মানুষ চলে যেত রেড স্কয়ারের বুকে হেঁটে হেঁটে। আমি নিজেও বেশ কয়েক বার গেছি এসব ডেমনস্ট্রেশনে ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে। জুবভস্কি বুলভারে শুরু হত, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রেড স্কয়ার পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি চেরনেঙ্কো বা গরবাচেভ হাত নাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাতেন। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন পলিটব্যুরোর সমস্ত সদস্যবৃন্দ। মনে হত মানুষ নয় আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আকাশচারী দেবতারা যাদের উপর নির্ভর করছে বিশ্বের শোষিত নিপীড়িত মানুষের তো বটেই, সারা পৃথিবীর ভাগ্য। তখন কি জানতাম এরা বিশ্ব তো দূরের কথা নিজেদের ভাগ্যও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে অবশ্য অক্টোবর বিপ্লব তার মর্যাদা হারিয়েছে, অন্তত এ দেশে এই অর্থে যে সরকারি ভাবে আর এ দিনটি পালন করা হয় না। তবে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সহ অনেক বামপন্থী দল এখনও এ দিনটি পালন করে। শপথ গ্রহণ করে। নতুন কর্মীদের গ্রহণ করে। কিন্তু সোভিয়েত আমলের সেই জাঁকজমক আর নেই। অবশ্য এ দিনটি এখন অন্যভাবে পালন করা হয়। ১৯৪১ সালের ৭ নভেম্বরের এই রেড স্কয়ারে প্যারেডের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল  হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মির জয়যাত্রা। “পিছু হটার  জায়গা নেই, পেছনে মস্কো” এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রেড আর্মি বেরিয়ে পড়েছিল বিজয় মার্চে যার শেষ ১৯৪৫ সালের মে মাসে বার্লিনে। এখন ১৯৪৫ সালের ৭ নভেম্বরের আর্মি প্যারেডকে স্মরণ করে এখন প্যারেডের প্যারেডের আয়োজন করা হয়। তবে সেটা অনেক ছোট আকারে। বর্তমানে অবশ্য ৭ নভেম্বরের পরিবর্তে পালন করা হয় ৪ নভেম্বর – জনতার সংহতি দিবস নামে। গুরুত্বের দিক দিয়ে রুশ ইতিহাসে এর স্থান কোন ক্রমেই অক্টোবর বিপ্লব দিবসের নীচে নয়। ১৬১২ সালে এমন দিনেই পোলিশ বাহিনীকে পরাজিত করে নতুন করে শুরু হয় রুশ রাজত্বের সুচনা। কিয়েভ রুশের রিউরিখ ডাইনাস্টির পরিবর্তে দেশের ভার নেয় নতুন ডাইনাস্টি – রমানভ বংশ। আর এই বিজয়ের মূল স্থপতি ছিল সাধারণ মানুষ যারা রাজা পঝারস্কি ও বনিক কুজমা মিনিনের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে নামে ও পরে রমানভ বংশের মিখাইল ফিওদরভিচকে ক্ষমতায় বসায়। যদিও অনেকের মতে সেটা ঘটেছিল ৭ নভেম্বর তবে বিভিন্ন কারণে এই উৎসব ৪ নভেম্বর পালন করা হয়। একদিকে সমাজে যেমন নভেম্বরে একটা উৎসব পালনের চাহিদা ছিল, অন্যদিকে সেটা যাতে কোন মতেই অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে মনে করিয়ে না দেয় সে জন্য ৭ তারিখে না করে ৪ তারখে এটা করা হয়। আমার ধারণা এই অনুষ্ঠান পালন যদি ২০০৫ সালে শুরু না হয়ে ২০২২ সালে হত তাহলে এটা ৭ নভেম্বর হতেই পারত। ২০০৫ সালে পুতিন ছিলেন পশ্চিমপন্থী, চেষ্টা করেছেন ইউরোপ আর আমেরিকার বন্ধু হয়ে দেশকে গড়ে তুলতে। কিন্তু পদে পদে বাধা পেয়ে বুঝতে পেরেছেন যে তারা রাশিয়াকে বড়জোর জমিদার বাড়ির অনুগত খাজনাদার হিসেবে দেখতে চায় আর বড় খাজনাদার হিসেবে মাঝেমধ্যে বাইরের ঘরে বসতে দেয়, কিন্তু অন্দরমহলে প্রবেশ নৈবচ নৈবচ।

যদিও আশির দশকের পণ্যের সার্বিক ডেফিসিট বা অভাব (হয়তোবা আগেও ছিল, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ফারাক এত বেশি ছিল না। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীতে পুঁজিবাদী বিশ্ব কয়েক কদম এগিয়ে ছিল) সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা হারাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সে সময় থেকেই ভোগবাদি সমাজ বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সেই হাওয়া বইতে থাকে। আর এ কারণেই মানুষ ধারণা করতে শুরু করে আমেরিকা তাদের উদ্ধার করবে। তাদের সামনে ছিল জাপান আর পশ্চিম জার্মানির উদাহরণ। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের অরাজকতা অনেককেই আমেরিকা বিমুখ করে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি, বিভিন্ন দেশে রুশ সেনাদের সমাধি ও সেই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্থাপিত বিভিন্ন মনুমেন্টের অমর্যাদা – এ সবই রুশ জনগণকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। মনে রাখতে হবে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুদ্ধে ২৬ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ হারায়। এ দেশে এমন কোন পরিবার পাওয়া কষ্ট যারা এই যুদ্ধে কোন না কোন আত্মীয়কে হারায়নি। আর এসবই এখন এদের অনেককেই সোভিয়েত ব্যবস্থাকে ভিন্ন চোখে দেখতে বাধ্য করছে। সেদিক থেকে এদেশে যে নিজেদের ইতিহাস নতুন করে পর্যালোচনা করা শুরু হয়েছে তা বলা যায়। মনে রাখতে হবে যে বর্তমান যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের কারণেই যে এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সেটা বুঝতে কেউ ভুল করছে না। যখন ইউক্রেনের ফ্যাসিবাদী শাসকদের হাত থেকে লুগানস্ক, দনিয়েৎস্ক, হেরসন, জাপারঝিয়ার জনপদগুলো মুক্ত করা হয় তখন সেসব জায়গার লোকজন সোভিয়েত পতাকা হাতেই রুশ সেনাদের স্বাগত জানায়। এসব মানুষের আধুনিক রাশিয়ার স্মৃতি নেই, আছে সোভিয়েত স্মৃতি। তাই যুদ্ধ শেষে এ দেশে যে সোভিয়েত ব্যবস্থার বা সমাজতন্ত্র না হলেও সমাজমুখী, সামাজিক দায়বদ্ধতাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার চাহিদা বাড়বে সেটা বলাই যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে যুদ্ধ শুরুর পরে পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাসী অনেক ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক দেশত্যাগ করেছেন। যদিও তাদের ধারণা ছিল এর ফলে রাশিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হবে – সেটা হয়নি। বরং হয়েছে শুদ্ধি। নব্বুইয়ের দশকে এ দেশে ছিল অলিগারখদের রাজ্যত্ব। পুতিনের শাসনামলে সেটা কমে, অলিগাররা জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ক্ষমতা হারায় যদিও অর্থনীতিতে শক্তিশালী অবস্থানেই থাকে। কিন্তু এখন অনেক অলিগারখ পশ্চিমা বিশ্বের চাপে করেছে। যারা আছে তাদের অবস্থা আরও দুর্বল হবে। এর ফলে সার্বিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদী থাকলেও সোভিয়েত আমলের অনেক কিছুই ফিরে আসবে এদের শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি নানা ব্যবস্থায়। তাই অন্তত রাশিয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান ক্রাইসিস শাপে বর হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নতুন মাত্রা পেতে পারে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্থবিরতা এসেছে। এই পতনকে সমাজতন্ত্রের পরাজয় বলে ধারণা করা হয়। নিঃসন্দেহে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক ভুল ত্রুটি ছিল, তবে সেটা কি তত্ত্বের নাকি প্রয়োগের সেই বিতর্ক এখনও রয়ে গেছে, থাকবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকলেও সে যে প্রভাব রেখে গেছে বিশ্ব ইতিহাসে সেটা কোন দিনই ম্লান হবে না। তার সক্রিয় সমর্থনে শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোই স্বাধীনতা লাভ করেনি, পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি মনোভাব বদলাতে বাধ্য হয়েছে। আজ পশ্চিমা বিশ্বে যে ওয়েলফেয়ার স্টেটের জন্ম সেটাও সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত করার এক পুঁজিবাদী উদ্যোগ বা কৌশল।

যেকোনো বড় কাজ অনেক মানুষকে একত্রিত করে, অক্টোবর বিপ্লবও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আর প্রায় প্রতিটি যুগান্তকারী ঘটনার পরই এর নেতাদের মধ্যে দেখা দেয় বিভিন্ন প্রশ্নে মতবিরোধ। এ জন্যেই মনে হয় প্রায় সবাই সব সময় শত্রু খুঁজে বেড়ায়, তাতে একদিকে যেমন নিজেদের ঐক্য ধরে রাখা যায়, অন্যদিকে জুজুর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সমর্থনও লাভ করা যায়। সেদিক থেকে দেখলে শত্রুর উপস্থিতি এক ধরণের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেটা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি, এখনও দেখছি।

জানি ইতিহাস যদি, কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করে না, তবুও মাঝে মাঝে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে কি হত, যদি অক্টোবর বিপ্লবের কুশীলবরা নিজেদের মধ্যে মরণ যুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন উন্নত করার কাজে নিজেদের সঁপে দিতেন। যদি না লেনিন দার্শনিক জাহাজে করে রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের ইউরোপে পাঠিয়ে দিতেন, যদি না তিরিশের দশকে স্ট্যালিন পার্টির ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালাতেন? সব রকমের শুদ্ধি অভিযানের পেছনে কাজ করে সন্দেহ আর সন্দেহের বশে চারিদিক কচুকাটা করতে করতে এক সময় নিজের মৃত্যু শয্যায় জল দেওয়ার মত মানুষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আসলে শত্রুকে পরাজিত করার পর বন্ধুদের মধ্যে এই যে কলহ তার মাশুল মানুষ দেশে দেশে দিয়েছে, দিচ্ছে। বাংলাদেশেও এটা ঘটেছে। একাত্তরের বিজয়ী সেনানীরা অল্প দিনের মধ্যে চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছে, যার মাশুল জাতি আজও দিচ্ছে। অ্যামেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতারা বিভিন্ন প্রশ্নে নিজেদের প্রচণ্ড মতবিরোধ থাকার পরও সেটাকে কন্ট্রোলে রাখতে পেরেছিলেন। যেখানেই নিজেদের মতভেদ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সেখানেই ঘটেছে বিপর্যয়। আর এই মতভেদ সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এসবের উপরে নির্ভর করে না। তাই সমাজতন্ত্রের পতনে শুধুমাত্র তত্ত্বগত ভুল খুঁজলে হবে না, দেখতে হবে তার প্রয়োগ আর যারা সেটা প্রয়োগ করেছেন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের একাত্মতা। আমার বিশ্বাস তত্ত্ব হিসেবে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ তার আবেদন হারায়নি, ভবিষ্যতে সে আবার সমাজকে নাড়া দেবে, সমাজ বদলের মন্ত্র হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। মহান অক্টোবর বিপ্লব মেহনতী মানুষকে যুগ যুগ ধরে উদ্বুদ্ধ করবে তার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে।

বর্তমানে পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের যে অবস্থা তাতে নতুন করে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। আমেরিকা নিজ দেশে হয়তো গণতন্ত্রের নিয়ম মেনেই চলে তবে অন্য যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে সে ইতিহাসের জঘন্যতম একনায়কের চেয়েও খারাপ। ইরাক, আফগানিস্তান, ইউক্রেন তো বটেই এমনকি সে যেভাবে ইউরোপ সহ তার মিত্র দেশগুলোর উপর ছড়ি ঘোরায় তাতে পুঁজিবাদী বিশ্বের কাছ থেকে মানবতা, ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম না হলেও ন্যায্য বণ্টন আশা করা যায় না। পৃথিবীতে সম্পদের পরিমাণ যতই কমছে পুঁজিবাদ ততই হিংস্র হয়ে উঠছে। এবং এর শেষ আছে বলে মনে হয় না। আর সেজন্যেই দরকার নতুন ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনে থাকবে পুঁজিবাদের উপাদান আর বণ্টনে সমাজতন্ত্রের। কারণ মানুষের কষ্টের মূলে রয়েছে সম্পদের অভাব নয়, বন্টনের ত্রুটি। সেই ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদে থাকবে রাষ্ট্রীয় মালিকানা আর কলকারখানা (হয়তো সামরিক বা অন্যান্য স্ট্রাটেজিক খাঁতে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মালিকানা না থাকলেও ৫০% রাষ্ট্রের অধীনে থাকা উচিৎ) অর্থাৎ যা মানুষের মেধা দিয়ে তৈরি সেখানে থাকবে ব্যক্তি মালিকানা। অর্থাৎ অর্থনীতি হবে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন। আর অবশ্যই রাজনীতি হবে গণতান্ত্রিক। মানুষ নিজেই ঠিক করবে নিজের ভাগ্য। আর এই পথে এগুলে সত্যিকার অর্থেই সমাজে বৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব আর যেখানেই বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিতে রাজনীতি পরিচালিত হয় সেখানে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোন কিছুই ত্রুটিহীন বা পারফেক্ট নয়, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ সেদিকে এগিয়ে যাওয়া, স্বপ্ন দেখা।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো