মতামত

শ্রম আইনে তদন্তকালীন এবং শাস্তিমূলক বরখাস্ত প্রসঙ্গে

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিটু (ফাইল ছবি)

কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন শ্রমিকের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের ধারা ২৩ উপধারা ৪ এর দফা ‘ক’ থকে ‘ঞ’ তে উল্লেখিত যেকোন এক বা একাধিক অসদাচরণের অভিযোগ পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষ উক্ত শ্রমিকের বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গ জনিত কারণে শাস্তি প্রদানের লক্ষে প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। কোন প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে এটা প্রতিষ্ঠানের মালিকের অধিকার।

তবে এক্ষেত্রে অভিযুক্ত শ্রমিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়বস্তু উল্লেখ করে কারন দর্শানো নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন মনে করলে কারন দর্শাও নোটিশ প্রদানের সময় হতে তদন্তকালীন সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দিতে পারেন। শ্রম আইনের ধারা ২৪ উপধারা ২ অনুসারে সাময়িক বরখাস্তকালীন অভিযুক্ত শ্রমিককে খোরাকী ভাতা হিসাবে মূল মজুরীর অর্ধেক এবং অন্যান্য ভাতা প্রদান করতে হবে। উদাহরন স্বরূপ বলা যায়, একজন শ্রমিকের মূল মজুরি ৪১০০ টাকা ঘরভাড়া সহ অন্যান্য ভাতা ৩৯০০ টাকা হলে কোন শ্রমিক যদি ৩০ দিন সাময়িক বরখাস্ত থাকেন তাহলে উক্ত শ্রমিক ৩০ দিনের জন্য মজুরি পাবেন (২০৫০ + ৩৯০০) = ৫৯৫০ টাকা।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি কারখানার মানব সম্পদ বিভাগের একজন ব্যবস্থাপক আমাকে ফোন করে জানান, তার কারখানায় কর্মরত একজন শ্রমিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর তারা উক্ত শ্রমিককে কারন দর্শানো নোটিশসহ সময়িক বরখাস্তের আদেশ দিয়েছিলেন এবং তদন্তকালীন অভিযুক্ত শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন। তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় লঘু শাস্তি হিসাবে শ্রম আইনের ধারা ২৩ এর উপধারা ২ এর দফা ‘চ’ অনুসারে ৭ দিন বিনা মজুরিতে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। এখানে ৭ দিনের বিনা মজুরিতে অর্থ হচ্ছে উক্ত অভিযুক্ত শ্রমিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত জানার পর পরবর্তী ৭ দিন বরখাস্তকালীন কাজ করবেনা এবং এ জন্য তার ৭ দিনের মূল মজুরি কর্তন করা হবে।

এখন ঐ কারখানা ব্যবস্থাপক জানতে চান, ৭ দিন বরখাস্তের আদেশটা তদন্তকালীন বরখাস্তের দিন গুলোর সাথে সমন্বয় করা যাবে কিনা?  তাহলে শ্রমিককে নতুন করে কাজে অনুপস্থিত থাকতে হবেনা। আমি প্রথমে একটু অবাক হলাম। দীর্ঘ সময় মানব সম্পদ বিভাগে কাজ করেছি এবং সম্প্রতি শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করছি কিন্তু আমার মনে কখনো এমন প্রশ্নের উদয় হয়নি। অবশ্য প্রশ্নটার মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব থাকায় আমি সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে প্রথমে ভাবার চেষ্টা করলাম এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিকের লাভ বা ক্ষতি কী হতে পারে? এ সিদ্ধান্তের কারনে শ্রমিক মজুরি বেশি পাবে নাকি কম পাবে? এটা বুঝার জন্য আমি দুই ধরণের ব্যবস্থার জন্য শ্রমিক কত মজুরি পেতে পারে তার একটা আনুমানিক হিসাব করলাম।

ধরে নেয়া যাক, শ্রমিক ৩০ দিন তদন্তকালীন সাময়িক বরখাস্ত থাকা অবস্থায় সে মোট ৫৯৫০ টাকা পেল (হিসাব উপরে উল্লেখ আছে) এখন পরবর্তী মাসে ৭ দিন শাস্তিমূলক বরখাস্ত থাকায় সে মোট মজুরি ৮০০০ টাকা থেকে ৭ দিনের মূল মজুরি তথা (৪১০০ ÷ ৩০) × ৭ = ৯৫৬ টাকা কম পাবে অর্থাৎ পরবর্তী মাসে সে মজুরি পাবে (৮০০০- ৯৫৬) টাকা = ৭০৪৪ টাকা। তাহলে ২ মাসে মিলে শ্রমিক পাবে (৫৯৫০ + ৭০৪৪) টাকা = ১২৯৯৪ টাকা।

এখন যদি ঐ কারখানা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী তদন্তকালীন ৩০ দিনের সাথে শাস্তিমূলক বরখাস্ত ৭ দিন সমন্বয় করা হয় তাহলে সে ৭ দিনের মূল মজুরি পাবেনা। সেক্ষেত্রে তদন্তকালীন ২৩ দিনের মুল মজুরির অর্ধেক পাবে আর ৩০ দিনের অন্যান্য ভাতা পাবে অর্থাৎ বিগত ৩০ দিনে সে মোট পাবে (৪১০০ ÷৩০ ÷ ২) × ২৩ + ৩৯০০ টাকা = ৫৪৭২ টাকা আর পরবর্তী মাসে সে মজুরি ৮০০০ টাকা পুরোপুরি পেয়ে যাবে। তাহলে ২ মাসে মোট মজুরি পাবে (৫৪৭২ + ৮০০০) টাকা = ১৩৪৭২ টাকা।

এখন দেখা যাচ্ছে, যদি শাস্তিমূলক বরখাস্ত তদন্তকালীন বরখাস্তের সাথে যুক্ত করা হয় তাহলে শ্রমিক (১৩৪৭২-১২৯৯৪) টাকা = ৪৭৮ টাকা বেশি পাবে কিন্তু তার বিনিময়ে তাকে ৭ দিন কাজে উপস্থিত থাকতে হবে।  এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হিসাব করে শ্রমিক যদি বুঝে মাত্র ৪৭৮ টাকা পাওয়ার জন্য শ্রমিককে ৭ দিন চাকরিতে হাজিরা দিতে হবে তাহলে শ্রমিক সেটা করতে আগ্রহী হবে কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া তদন্তকালীন সাময়িক বরখাস্ত এক প্রকার অগ্রিম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। যা দোষ প্রমাণ হলে কার্যকর হয়ে যায়। সেকারণে তদন্তকালীন সাময়িক বরখাস্তের জন্য শ্রমিকের মূল মজুরি হতে অর্ধেক কর্তন করে রাখা হয় –যা তদন্ত শেষে দোষ প্রমাণ না হলে ফেরত পায় আর দোষ প্রমাণ হলে ফেরত পায়না। আর ফেরত না পাওয়ার অর্থই হচ্ছে শাস্তি কার্যকর হয়ে যাওয়া। সুতরাং যে শাস্তি কার্যকর হয়ে যায় সেটাকে মালিকের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা করার সুযোগ আর থাকেনা।

তাই কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তদন্তকালীন বরখাস্ত এবং শাস্তিমূলক বরখাস্ত দুইটা পৃথক বিষয় ফলে দুইটাই ভিন্নভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একটার সাথে অন্যটার মিলানো বা সমন্বয় করার কোন সুযোগ নাই।

যদি কোন কারখানা কর্তৃপক্ষ মনে করে উৎপাদনের স্বার্থে শ্রমিকের কাজে যোগদান করা খুবই প্রয়োজন সেক্ষেত্রে শ্রম আইনের ধারা ২৩ উপধারা ২ এর দফা ‘ছ’ অনুসারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ‘ভৎসনা ও সতর্কীকরন’ করা যেতে পারে।

এছাড়া শ্রম আইনের ধারা ২৫ অনুসরণ করে জরিমানা করা যেতে পারে।

(লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি)