মতামত

কার্ল মার্কস ও মার্কসবাদ

– নাজিমুদ্দীন শ্যামল

১৮১৮ সালের ৫ মে সমাজবিজ্ঞানী ও মার্কসবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কস জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজ বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী। তিনি সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন ।  তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর মাঝে রয়েছে তিন খণ্ডে রচিত পুঁজি এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে রচিত কমিউনিস্টইশতেহার (১৮৪৮)।

কার্ল মার্কস  প্রুশিয়া সাম্রাজ্যের নিম্ন রাইন প্রদেশের অন্তর্গত Trier নামক স্থানে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বাবা হাইনরিশ মার্কস  এমন এক বংশের লোক যে বংশের পূর্বপুরুষেরা রাব্বি ছিলেন। অবশ্য তাদের মধ্যে অতিবর্তী ঈশ্বরবাদ এবং আলোকময়তার যুগের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই ভলতেয়ার ও রুসোর মত দার্শনিকদের প্রশংসা করতেন। জন্মের সময় হাইনরিশ মার্ক্সের নাম ছিল Herschel Mordechai, তার বাবার নাম Levy Mordechai (১৭৪৩-১৮০৪) এবং মা’র নাম Eva Lwow (১৭৫৩-১৮২৩)। ইহুদি পরিবারেই হাইনরিশের জন্ম, কিন্তু ধর্মের কারণে আইন অনুশীলনে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তিনি ইহুদি ধর্ম ত্যাগ করে লুথারীয় মতবাদে দীক্ষা নেন। লুথারীয় ধর্ম তখন প্রুশীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম ছিল, তাই সেই রোমান ক্যাথলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে লুথারীয় সংখ্যালঘু হিসেবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভের আশায়ই তিনি এভাবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

তার মায়ের নাম Henriette née Pressburg (১৭৮৮-১৮৬৩)। তিনি শিল্পপতি Gerard PhilipsAnton Philips এর মাতামহ (আপন নন) এবং Barent-Cohen পরিবারের উত্তরসূরী। Henriette এর বাবার নাম Isaac Heijmans Presburg (১৭৪৭-১৮৩২) এবং মা’র নাম Nanette Salomon Barent-Cohen (১৭৬৪-১৮৩৩)। Nanette এর বাবা ছিলেন Salomon David Barent-Cohen (মৃ. ১৮০৭) এবং মা ছিলেন Sara Brandes। এই সালোমোন ও সারা আবার বিবাহ সূত্রে Nathan Mayer Rothschild এর স্ত্রীর চাচা-চাচী ছিলেন।

কার্ল মার্কস  ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন।বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার অধ্যয়নের বিষয়বস্তু‍‌ ছিল আইনশাস্ত্র, ইতিহাস ও দর্শন। তিনি ডক্টরেট ডিগ্রিও লাভ করেন। তার জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ছিল ব্যাপক। তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, গণিত প্রভৃতির গভীর অনুশীলন ও অধ্যয়ন  করেছিলেন। তার আজীবন সহযোগী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-র সাথে তিনি মার্কসীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মতবাদই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ হিসাবে পরিচিত। এই মতবাদ শূন্য থেকে সৃষ্ট নয়। মানব সভ্যতার অগ্রগতির যে রাজপথ সেই রাজপথ থেকেই উদ্ভুত হলো সমাজতন্ত্রের মতবাদ।

মার্কস  জেনি ফন ভেস্টফালেন-কে বিয়ে করেন। জেনি ছিলেন এক প্রুশীয় ব্যারনের শিক্ষিত কন্যা। তাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হয়েছিল, কারণ এই বিয়েতে মার্কস  পরিবারের সম্মতি ছিল না। ১৮৪৩ সালের ১৯শে জুন Bad Kreuznach-এর Kreuznacher Pauluskirche-এ তাদের বিয়ে হয়।

১৮৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে মার্কস  পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভাল ছিল না। তখন তারা লন্ডনের সোহো’র ডিন স্ট্রিটে একটি তিন রুমের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতেন। এরই মধ্যে তাদের চার সন্তানের জন্ম হয়। লন্ডনে বসবাস শুরু করার পর আরও তিন সন্তান হয়। এই সাত জনের মধ্যে কেবল তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বেঁচে ছিল। মার্ক্সের আয়ের উৎস ছিল কেবল এঙ্গেল্‌সের দেয়া ভর্তুকি ও নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন-এর বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে পাওয়া বেতন। জেনি এক কাকা ও মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্র কিছু অর্থ পান। এই অর্থই মার্কস  পরিবারকে কেন্টিশ টাউনের গ্র্যাফ্টন টেরেস এ অপেক্ষাকৃত ভালো ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাসা নিতে সাহায্য করে। আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হলেও মার্কস  তার স্ত্রী ও সন্তানদের বুর্জোয়া সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আবশ্যক সব উপকরণ সরবরাহ করতেন।

জেনির গর্ভে  তার সন্তানরা হল: জেনি ক্যারোলিন (১৮৪৪-১৮৮৩), জেনি লরা (১৮৪৫-১৯১১), এডগার (১৯৪৭-১৮৫৫), হেনরি এডওয়ার্ড গাই (১৮৪৯-১৮৫০), জেনি এভেলিন ফ্রান্সেস (১৮৫১-১৮৫২), জেনি জুলিয়া এলিনর (১৮৫৫-১৮৯৮) এবং আরও কয়েকজন যারা নাম রাখার আগেই মারা যায়।

মার্কসবাদ ঊনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক এবং বিপ্লবী কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অনুশীলন ও সামাজিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বে সামাজিক পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও শ্রেণি-সম্পর্ককে ভিত্তি করে সমাজ বিশ্লেষণের বিশ্বদর্শন ও প্রক্রিয়া বয়ান করা হয়েছে। মার্কসবাদী প্রক্রিয়াকে পদ্ধতিগত অর্থনৈতিক পরিবর্তনে শ্রেণিসংগ্রামের ভূমিকা এবং পুঁজিবাদের বিকাশের সমালোচনা ও বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ও সামজিক-রাজনৈতিক জিজ্ঞাসা ও প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়। সমাজ, অর্থনীতি, ও রাজনীতিসংক্রান্ত মার্ক্সের তত্ত্বসমূহ মার্কস বাদ নামে পরিচিত। মার্ক্সের ইতিহাস দর্শন ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে পরিচিত।

তার মতে, মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাবের মতো নমনীয় আর কিছু নেই। শ্রেণী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মানব সমাজগুলো বিবর্তিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এই সংগ্রামের প্রকাশ ঘটে শাসক শ্রেণী (যারা একইসাথে রাষ্ট্র, ও কলকারখানা নিয়ন্ত্রণ করে) এবং শ্রমজীবী শ্রেণী (যাদের জীবিকার একমাত্র উপায় পুঁজিপতির কারখানায় ন্যূনতম মজুরির বিনিময়ে শ্রম বেঁচা), তাদের মাঝে।মার্কস  বলেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে শ্রমিক শ্রেণি যে পরিমাণ নতুন মূল্যের সৃষ্টি করে তার ভগ্নাংশই মাত্র তারা মজুরি বাবদ পান, উদ্বৃত্ত সিংহভাগ অংশ পুঁজির মালিকগণ আত্মসাৎ করে ফেলেন।

‘থিসিস অন ফয়েরবাখ’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভে তিনি লিখেছেন, ‘সামাজিক সম্পর্কগুলোর যূথবদ্ধতাই মনুষ্যচরিত্রের সার।’ তিনি বলেন, ধরা যাক, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে ফেলার মাধ্যমে আপনি সামাজিক সম্পর্কগুলো পাল্টে দিলেন এবং পুঁজিবাদী ও শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বিলুপ্ত করে দিলেন; তাহলে দেখা যাবে পুঁজিবাদী সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষের চেয়ে এই নতুন সমাজের মানুষ একেবারে আলাদা ধরনের হয়ে উঠেছে। হেগেলের মতে, মানব চেতনার মুক্তিই ইতিহাসের অভীষ্ট লক্ষ্য। হেগেল মনে করেন, যখন আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারব যে আমরা বিশ্বজনীন মানবসত্তার একেকটি অংশ, তখনই সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। মার্কস  হেগেলের ‘আদর্শিক’ ব্যাখ্যাটিকে এমন একটি ‘বস্তুগত’ আদর্শে রূপান্তরিত করেছেন, যে আদর্শে আমাদের জাগতিক বস্তুগত অভাব মেটানোর সন্তুষ্টিই ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং যে আদর্শে একমাত্র শ্রেণিসংগ্রামকেই মুক্তি অর্জনের পথ মনে করা হয়। শ্রমিক শ্রেণিই হবে বিশ্বজনীন মুক্তির হাতিয়ার; কারণ এই আদর্শ ব্যক্তিগত সম্পদের ধারণাকে অস্বীকার করে এবং যৌথ মালিকানাভিত্তিক উৎপাদনের পথ দেখিয়ে দেয়। মার্কস  মনে করতেন, যখন কর্মীরা যৌথ মালিকানাভিত্তিক উৎপাদনে আত্মনিয়োগ করবে, তখন মার্ক্সের ভাষায় ‘সহযোগিতামূলক সম্পদের ঝরনাধারা’ ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ যে গতিতে ছড়ায়, তার চেয়ে অনেক বেশি পর্যাপ্ত আকারে সমাজে প্রবাহিত হবে। মার্কস  বলেছিলেন পুঁজিবাদ এমন সব জিনিস তৈরি করবে, যা মানুষের দরকার নেই, কিন্তু তারপরেও সে বস্তুর চাহিদা তৈরি হবে। একেই তিনি ‘কাল্পনিক চাহিদা’ বলে নাম দিয়েছিলেন। যেমন ধরা যাক, ফ্যাশন। চলতি হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে কাপড়-চোপড় পরতে গিয়ে আমরা এমন সব কাপড়-চোপড় ফেলে দিচ্ছি যেগুলো আসলে এখনো ব্যবহার করা যায়। অথবা স্মার্টফোনের কথাই ধরা যাক । যে স্মার্টফোনটি আপনার হাতে আছে, তার তুলনায় বাজারে আসা নতুনটির তফাৎ খুব সামান্যই। তারপরও ফোন কোম্পানিগুলো বিরামহীন নতুন মডেল উদ্ভাবন করে বাজারে ছাড়ছে এবং সর্বশেষ মডেলের ফোনটির জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে ভোক্তাদের মধ্যে।

পুঁজিবাদের প্রকৃতিই হচ্ছে এটি ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ আর ‘মন্দা’র মধ্যে ঘুরপাক খায়। সেই অর্থে ২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী মতই হয়েছে। পুঁজিবাদের পতন সম্পর্কে মার্কস  আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, লাভের জন্য পুঁজিবাদের যে তীব্র ক্ষুধা, সেজন্য বিশ্বে মানুষের যা প্রয়োজন তার চেয়ে উৎপাদন অনেক বেশি হবে এবং শ্রমিকের মজুরি এতই কমবে যে তারা নিজেদের উৎপাদন করা পণ্য কিনতে পারবে না। মানুষ পণ্য না কিনলে পুঁজিবাদীরা মুনাফা করবে কিভাবে? যে কারণে পুরো ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে শুরু করবে। সাধারণ অর্থে পুঁজিবাদের বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার কথা। যেমন পাড়ার মাংস ও মাছ বিক্রেতার মত ছোট ব্যবসা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। কিন্তু মার্কস  বলেছেন, কোম্পানিগুলো এত বড় হতে থাকবে যে তারা নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্রমে গ্রাস করে নেবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কার্ল মার্কস  বলেছেন, পুঁজিবাদের ধরণ অনুযায়ী মুনাফার জন্য বড় ব্যবসায়ীরা কর্মীদের বেতন ও সুবিধাদি কমিয়ে দেয়। এতে মধ্যবিত্ত ক্রমে গরীব হতে থাকে। এর ফলে একটি বড় অংকের নগদ অর্থ অল্প কিছু মানুষের হাতে জমতে থাকে। আজকের পৃথিবীতে চীন, ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত জনসংখ্যা তিন ‘শো সত্তুর কোটি মানুষের যা সম্পদ, তার চেয়ে বেশি সম্পদ আছে মাত্র ৪২ জন ধনী মানুষের হাতে।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অনুসরণ করে মার্কস  দাবি করেন যে পূর্বতন সমাজব্যবস্থাগুলোর মতো পুঁজিবাদও তার অন্তঃস্থ বিভেদ ও শ্রেণী সংগ্রামের দরুন ভেঙে পড়বে এবং সমাজতন্ত্রের জন্ম হবে। মার্কস  মনে করেন, অস্থিতিশীল ও সংকটপ্রবণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমাগত শ্রেণী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে মজলুম শ্রমজীবী শ্রেণীর মাঝে শ্রেণীচেতনার জন্ম হবে; যার ফলে তাদের মাঝে ঐক্য গড়ে উঠবে এবং এই ঐক্যবদ্ধ শ্রমজীবী শ্রেণী জালেম শাসক শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে শ্রেণীহীন কওমী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবে। মার্কস  মনে করেন, বিদ্যমান পুঁজিবাদী জালেমী ব্যবস্থার অবসান করতে এবং নিজেদের মুক্তির খাতিরে মজলুম শ্রমজীবী শ্রেণীগুলোর ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের বিকল্প নেই।

নাজিমুদ্দীন শ্যামল: কবি, প্রবন্ধকার ও সাংবাদিক