চলমান সংবাদ

চট্টগ্রাম থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক বিএনপি’র

চট্টগ্রাম থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। কেন্দ্রঘোষিত বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচির প্রথম চট্টগ্রামের গণসমাবেশ থেকে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সরকার পতনের আন্দোলনের এই ডাক দেন।

বুধবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে নগরীর পলোগ্রাউন্ড ময়দানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পুলিশের গুলিতে পাঁচ নেতাকর্মী নিহত ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির ডাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে অংশ নিতে সকাল থেকেই মিছিল নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসতে থাকেন। দুপুরের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে পলোগ্রাউন্ড ময়দান।

দীর্ঘদিন পর আয়োজিত এই সমাবেশে ব্যাপক জমায়েত উজ্জ্বীবিত করেছে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকের সমাবেশ প্রমাণ করে, ভয় দেখিয়ে চট্টগ্রামবাসীকে দমিয়ে রাখা যায়নি। চট্টগ্রাম থেকে সূচনা হয়েছে। এবার সারা বাংলাদেশের মানুষ জেগে উঠবে। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনাকে গদি থেকে নামিয়ে আনবে। সরকার পতনের আন্দোলন শুরু করে দিয়েছি। শেখ হাসিনাকে এখনই পদত্যাগ করতে হবে। এদেশের জনগণ আর একদিনও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এই আন্দোলন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে এই স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটাব।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের একটা প্রতিষ্ঠানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে। আমি বলি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হবে না। শুধু র‌্যাবকে নয়, শেখ হাসিনার সরকারকে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। এই সরকার অনির্বাচিত সরকার। এই সরকারের কোনো ম্যান্ডেট নেই। আগের রাতে ভোট নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করেছে। এই সরকার বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করেছে।
তিনি বলেন, ‘এই সরকার পুলিশ-র‌্যাব-প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে। বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছে। দেশে আজ কারও নিরাপত্তা নেই। গুম, খুন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, কাস্টডিতে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়েছে এই সরকারের আমলে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের লোকজন কিছুদিন আগে এসে বলেছেন, এখানে গুম হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৪ পৃষ্ঠার রিপোর্টেও তারা বলেছেন বাংলাদেশে কোনো মানবাধিকার নেই। দেশে গুম হয়, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। এখানে বিচারবিভাগ স্বাধীন নয়।

সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সকল রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ভোটের আয়োজন করবে। জনগণ ভোট দিয়ে একটি সংসদ নির্বাচিত করবে, যেটা হবে জনগণের সংসদ। জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করুন। ডিসি-এসপিরা নির্বাচন কমিশনারকে মানে না। এরা কিভাবে নির্বাচন করবে? নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’

দুর্নীতি-অর্থপাচারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সবকিছু লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছে। শেখ হাসিনা ১০ টাকায় চাল দেবে বলেছিল, এখন চালের দাম ৭০ টাকা। চাল, ডাল, তেল, নুন, মাছ, মাংস সবকিছুর দাম তিন থেকে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম কয়েক বার বাড়িয়েছে। এখন শুনতে পাচ্ছি, বিদ্যুতের দাম নাকি আবার বাড়াবে। বার বার দাম বাড়াতে হচ্ছে কেন? কারণ তারা টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। এখন আবার শেখ হাসিনা বলছেন, দুর্ভিক্ষ আসছে, আপনারা কম খান। আমরা বলি, দেশ চালাতে না পারলে ছেড়ে দিয়ে এখনই চলে যান।’

চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক ডা.শাহাদাত হোসেন সভাপতিত্বে ও সদস্যসচিব আবুল হাসেম বক্করের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহাজাহান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, এসএম ফজলুল হক, কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিভাগীয় সমাবেশের সমন্বয়কারী মাহবুবের রহমান শামীম, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহবায়ক আবু সুফিয়ান প্রমুখ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, চট্টগ্রাম থেকে শেখ হাসিনার পতন শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামবাসী ডাক দিয়েছে, তাহলে আর দেরি কিসের। শেখ হাসিনা আপনি ক্ষমতা ছাড়ুন, পদত্যাগ করুন। চট্টগ্রামের মাঠ থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটা সহজে থামবে না। দরকার হলে জীবন দিয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটাবো।’
নেতাকর্মীদের সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে আমীর খসরু বলেন, পুলিশের কিছু অংশ নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। ঢাকা থেকে আসতে নেতাকর্মীদের বাধা দিয়েছে। অনেক নেতাকর্মীকে হোটেল-রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপরও নেতাকর্মীরা সকল বাধা অতিক্রম করে সমাবেশের মাঠে যোগ দিয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে শেখ হাসিনাকে বার্তা দিয়েছে, শেখ হাসিনা এখনই পদত্যাগ করো।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘চট্টগ্রামের সমাবেশ থেকেই শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলন শুরু। এ আন্দোলন চলবে, যতদিন পর্যন্ত এ অবৈধ সরকার গদি ছাড়বে না। শ্রীলঙ্কার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা আপনি মনে করছেন, এ দেশ থেকে পালাবেন। না আমরা পালাতে দিব না।’

সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘এ সরকারের আমলে তাদের চুরি-লুটপাটের জন্য আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তি। শুধু তাই নয়; বিদ্যুৎ-পানির দামও বাড়তি। তারা এ টাকা বাইরে পাচার করছে। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অবৈধ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়, অবৈধ পার্লামেন্ট বাতিল, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ চার দাবি জানান।

সমাবেশে কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা সকাল থেকেই সমাবেশস্থলে সমবেত হতে শুরু করেন। সরকারি দলের চাপে সকাল থেকে বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে- এমন আশঙ্কায় চট্টগ্রামের বাইরের বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকেই বাস-ট্রাক বোঝাই করে রাতেই চট্টগ্রামে চলে আসেন। বিএনপির সমাবেশের কারণে পলোগ্রাউন্ড ও আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন সড়কে যানচলাচল বিঘ্নিত হয়। তীব্র যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। সমাবেশকে ঘিরে পলোগ্রাউন্ডসহ আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাধারণ গাড়ি চলাচল কম থাকায় বুধবার ভোর থেকে সড়কে ভোগান্তিতে পড়েন অফিসমুখী মানুষ। মহাসড়কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডে যাত্রীদের গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেও দেখা গেছে।

এদিকে বিএনপির এই বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সতর্ক অবস্থায় ছিল পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, সাদা পোশাকে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে কমপক্ষে ৯০ জন পুলিশ সাদা পোশাকে পুলিশ অবস্থান নেয়। সমাবেশস্থলের বিভিন্ন পয়েন্টেও সাদা পোশাকে পুলিশের একটি টিম অবস্থান নেয়। এছাড়া সকাল থেকে সকাল থেকে নিউ মার্কেট, আগ্রাবাদ, ষোলশহর, টাইগারপাস,আমবাগান, অলংকার, একেখান, জিইসি, লালখানবাজার, সিআরবি মোড়ে সর্তক অবস্থান ছিল পুলিশের।

অন্যদিকে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে আসা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, আসার পথে বিভিন্নস্থানে সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের বাধার শিকার হয়েছেন তারা। সমাবেশে যাওয়ার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে হামলায় বিএনপির অন্ততপক্ষে ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এছাড়া বুধবার (১২ অক্টোবর) ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রামমুখী গাড়ি তল্লাশির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটে।

# ১৩.১০.২০২২ চট্টগ্রাম #