মতামত

কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তায় আইন ও শাস্তির বিধান

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ফটো)

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৩৩২ ধারা অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানে কোন কাজে কোন মহিলা শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে, তিনি যে মর্যাদারই হোন না কেন, তার প্রতি প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ এমন কোন আচরণ করতে পারবেন না যা অশ্লীল বা অভদ্রজনোচিত বলে বিবেচিত হতে পারে, কিংবা যা উক্ত মহিলার শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী হতে পারে। ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রনীত হলেও ২০১৫ সালে প্রনীত বিধিমালায় এ সংক্রান্ত কোন ব্যাখ্যা ছিল না।

তবে সুখের সংবাদ হচ্ছে, শ্রম আইনের উপরোক্ত ধারাটিকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি শ্রম বিধিমালার সংশোধনীতে ৩৬১ক বিধি যুক্ত করা হয়েছে। উপরোক্ত বিধির উপবিধি ১ এ ধারা ৩৩২ এর ব্যখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে –অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণ যেমন শারীরিক স্পর্শ বা অনুরূপ প্রচেষ্টা; প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা;  যৌন হয়রানী বা নিপীড়নমূলক উক্তি; যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ প্রস্তাব; পর্ণোগ্রাফি দেখানো; যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি; অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্যক্ত করা বা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে কোন ব্যক্তির অলক্ষে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ করা, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা; চিঠি,টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, চেয়ার-টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস বা বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোন কিছু লেখা; ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থির চিত্র বা ভিডিও চিত্র ধারণ করা; যৌন হয়রানির কারণে সাংস্কৃতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ হতে বিরত থাকতে বাধ্য করা;প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেয়া বা চাপ প্রয়োগ করা; ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা করা ইত্যাদি অশোভন আচরণ নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন ও হয়রানীমুলক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

একইসাথে উপবিধি ২ এ প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে অন্যুন ৫ সদস্য বিশিষ্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে অভিযোগ তদারকির জন্য কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে কমিটির প্রধান হবেন একজন নারী এবং কমিটিতে প্রতিষ্ঠানের মধ্য হতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী প্রতিনিধি থাকবেন।

এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে, বেশীরভাগ কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন বা হয়রানীর অভিযোগ প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ক্ষমতাধর উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় ফলে কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্য হতে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত তদারকি কমিটি কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

অবশ্য বিধিমালা সংশোধনের বহু পূর্বে হাই কোর্টের একটি রায়ের নির্দেশনা মেনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম এর পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত বিষয়ে অধিদপ্তরের পরিদর্শক রেজাউল রেশমাকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি অভিযোগ তদারকি কমিটি গঠিত হলেও উক্ত কমিটি নিয়ম রক্ষার জন্য একটা বা দুইটা জুম মিটিং ছাড়া তেমন কোন ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের গঠিত অভিযোগ তদারকি কমিটিকে আরো সক্রিয় করে উক্ত কমিটি এবং প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক তদারকি কমিটির সাথে একটি নিয়মিত যোগাযোগ তৈরি হলে কিছুটা হলেও ফল পাওয়া যেতে পারে বলে আমার ধারনা। অন্যথায় কমিটিগুলো সব কাগুজে কমিটিতে পরিনত হবে এর কোন সুফল কর্মরত নারী শ্রমিকেরা পাবেনা।

শ্রম আইনের ৩৩২ ধারার সমর্থনে বিধিমালায় নতুন সংযোজিত বিধি ৩৬১ক এর মাধ্যমে কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনী বিষয়টির বিস্তারিত ধারণা পাওয়া গেলেও তা পরিপূর্ণতা পায়নি বলেই আমি মনে করি। কেননা  ৩৩২ ধারা লঙ্ঘণ করা হলে শাস্তির বিধান খুঁজতে গিয়ে ৩০৭ ধারা ছাড়া আর কোন বিধান পাওয়া যায়নি। ৩০৭ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে কেবল ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের কথা উল্লেখ আছে। ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়নের সময় কারাদন্ডের বিধান ছিল কিন্তু পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সংশোধনীর সময় রহস্যজনক কারণে কারা দন্ডের বিধান বাদ দেয়া হয়েছে অবশ্য অর্থদন্ডের পরিমান বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর ইজ্জত বা সম্ভ্রম কি অর্থ দিয়ে কেনা সম্ভব? আমাদের মনে রাখতে হবে কর্মস্থলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই শ্রম আইনে ৩৩২ ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ ধারা। সুতরাং ধারাটির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হলে এ ধারাটি লঙ্ঘণের দায়ে সুনির্দিষ্ট দন্ডের বিধান থাকাও বাঞ্চনীয়।

এক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ উল্লেখিত বিভিন্ন দন্ডের বিধান বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। যেমন উক্ত আইনের ৯ ধারায় ধর্ষনের দায়ে ধর্ষনকারীর মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডের কথা বলা হয়েছে।

সম্প্রতি আমাদের নারী ফুটবলাররা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত আসতে তাদের কী পরিমান অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়েছে তা তাদের দুই একজনের বক্তব্য থেকে উঠে এসেছে। এমনকি নারী ফুটবল দলের কোচ হওয়ার কারণে কোচকেও নানান টিপ্পনির মুখোমুখি হতে হয়েছে। সুতরাং বাস্তবতা হচ্ছে –ঘর থেকে বের হয়ে কোথাও কোন কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া নারীদের জন্য খুব সহজ কোন ব্যাপার নয়। সেটা হোক ক্রিড়া অঙ্গন কিংবা কর্মক্ষেত্র। তাই যে সকল সাহসী নারীরা সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছে তারা একদিকে সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। নিঃসন্দেহে তারা সমাজ প্রগতির এক লড়াকু সৈনিক এবং পথ প্রদর্শক ও অগ্রদূত। তাদের ঘরে-বাইরে এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। এই লক্ষে আইনের ধারা ৩৩২ এবং বিধিমালায় নতুন সংযুক্ত বিধি ৩৬১ক যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। শ্রম আইনের উক্ত ধারা এবং বিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়নে নারী ও শিশু দমন আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সুনির্দিষ্ট দন্ডের বিধান শ্রম আইনে যুক্ত করার জন্য জোরালো আবেদন জানাচ্ছি।

(লেখকঃ সংগঠক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি।)