মতামত

একজন দিনমজুর ভদ্রলোক এবং শাকির হোসেনের গল্প

-ফজলুল কবির মিন্টু

ফজলুল কবির মিন্টু (ফাইল ছবি)

-এক-

বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায়, বিগত ৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে বরিশাল নগরির বিসিক এলাকার সুগন্ধা ফ্লাওয়ার মিলের মালিক শংকর কুমার সাহা ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা একটি ব্যাগে নিয়ে ব্যাগটি তার মোটর সাইকেলে ঝুলিয়ে নগরীর হাটখোলার কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পথে ভাঙ্গা রাস্তায় ঝাঁকুনিতে ব্যাগ ছিড়ে টাকাসহ রাস্তায় পড়ে যায়। পরবর্তীতে উক্ত ব্যবসায়ী হাটখোলা কার্যালয়ে গিয়ে দেখতে পান মোটর সাইকেলে ব্যাগ নাই। পথে যে কয়টি দোকানে সিসি  ক্যামেরা ছিল সবগুলো দোকানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেও টাকার কোন সন্ধান পাননি। পরবর্তীতে ৮ আগস্ট সারাদিন তিনি মাইকিং করেন এবং টাকা পেয়ে কেউ ফেরত দিলে পুরস্কার দেয়ারও ঘোষনা দেন। কিন্তু টাকার সন্ধান পাচ্ছিলেন না। সব ধরণের চেষ্টা করেও যখন কোন কুল-কিনারা হচ্ছিল না তখনই ব্যবসায়ী শংকর কুমার সাহা সুসংবাদটি পেলেন নগরীর ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম  মর্তুজা আবেদীনের কাছ থেকে। কাউন্সিলর জানান তাকে একজন মানুষ কিছু কুড়িয়ে পাওয়া টাকা জমা দিয়েছেন। কুড়িয়ে পাওয়া টাকা এবং শংকর সাহার হারিয়া যাওয়া টাকার পরিমান মিলে যাওয়ায় পরবর্তীতে কাউন্সিলর শংকর কুমার সাহাকে টাকাগুলো ফেরত দেন।

এখানে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, টাকাগুলো কুড়িয়ে পেয়েছেন একজন হতদরিদ্র দিনমজুর।  যিনি হয়তো প্রতিনিয়ত সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করার জন্য। এতগুলো টাকা এক সাথে পেয়েও লোভের কাছে নতি স্বীকার না করে টাকাগুলো ফেরত দেয়ার মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয় ব্যবসায়ী শংকর কুমার সাহা তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেও পুরস্কার দিতে পারেননি। কারন আত্ম প্রচার বিমুখ ঐ দিনমজুর ভদ্রলোক পুরস্কার নিবেনতো দূরের কথা তিনি তার পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করতে রাজী হননি।

সৎ এবং আত্মসম্মানবোধ মানুষগুলো এমনই হয়। শংকর কুমার সাহা তার টাকা খুঁজে পেলেও দেশের মানূষ একজন সৎ ও নির্লোভ মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলেন।

-দুই-

২৫ আগস্ট জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ হতে জানা যায়, শাকির হোসেন ওরফে সৌরভ নামে এক ভদ্রলোক মহাসড়কে ৫ লক্ষ টাকা কুড়িয়ে পেয়েছেন। ঐ টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য তিনি ঠাকুগাঁও শহরে দুইদিন মাইকিং করেছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় খবর ছাপিয়েছেন। জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করে টাকাগুলোর ব্যাপারে করনীয় নির্ধারনের জন্য জেলা প্রশাসকের সহযোগিতা চেয়েছেন।  সবশেষে শাকির হোসেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি টাকাগুলো মাস খানেক নিজের হেফাজতে রাখবেন। এরপরেও প্রকৃত মালিক পাওয়া না গেলে স্থানীয় প্রশাসন, গন্যমান্য ব্যক্তি ও তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে পরামর্শ করে টাকাগুলো ভাল কোন কাজে ব্যবহার করবেন। কুড়িয়ে পাওয়া টাকা প্রকৃত মালিকের নিকট পৌছে দেয়ার জন্য শাকির হোসেনের আপ্রাণ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের কাছে অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে গন্য হবে।

-তিন-

আমরা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার ছিনিয়ে এনেছি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছি। এখনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লড়াই জারি রেখেছি – একটি সুখি-সুন্দর-সমৃদ্ধশালী, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। সমতা ও ন্যায় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা এমন একটা দেশ রচনা করতে চেয়েছি যেখানে কোন হানাহানি থাকবে না, মানুষের উপর মানুষের কোন শোষণ-নির্যাতন-জুলুম থাকবে না। পরস্পরের প্রতি থাকবেনা কোন কোন অবিশ্বাস। একজন আরেকজনকে ঠকিয়ে কিংবা একজন আরেকজনের সম্পদ কুক্ষিগত করে বড়লোক হওয়ার চেষ্টা থাকবে না। এমন একটি স্বপ্নময় সুন্দর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কতই না ভালো হতো।

-চার-

আমাদের পূর্বসূরীরা জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিল শুধু নিজের ভাগ্য বদলের জন্য নয় বরং দেশের সকল মানুষের  ভাগ্য বদলের জন্য। অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে, অনেক বড় প্রত্যাশা নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।  আমাদের পূর্বসূরীদের স্বপ্ন, আমাদের সবার স্বপ্ন -আজ পথ হারিয়েছে। প্রশাসন-আইন ও বিচার ব্যবস্থা আজ ভঙ্গুর দশা। সমতা আর ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ আজ নির্বাসিত।  হত্যা-খুন-ধর্ষণ নিত্য দিনের সংবাদ। আস্থার সংকট আজ চরম পর্যায়ে পৌছেছে। দেশের মানুষ দিশে হারা। এমন এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী শংকর কুমার সাহার ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে একজন হতদরিদ্র দিনমজুরের পক্ষ হতে পরিচয় গোপন রেখে তা ফেরত দেওয়া এবং ঠাকুগাঁওয়ে মহাসড়কে ৫ লক্ষ টাকা কুড়িয়ে পেয়ে তা ফেরত দেওয়ার জন্য মালিকের সন্ধানে দুইদিন মাইকিং করা এক ব্যতিক্রম এবং আশা জাগানিয়া সংবাদ। এই দুইটি সংবাদ আমাদের বর্তমান সময়ের বিরল ঘটনাও বটে।

-পাঁচ –

আমি ভাবছি নাম না জানা সেই দিন মজুর ভদ্রলোক  কিংবা তার পরিবারের লোকেরা টাকার অভাবে সেদিনও হয়তো ভাত খেতে পারেন নাই। পরের দিনও খাবার যোগাড় হবে কীনা তাও হয়তো তার অজানা। সে রকম এক পরিস্থিতিতে এতগুলো টাকা কেউ কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দেয়ার চিন্তা সে কীভাবে করতে পারে? খুব উচ্চ নৈতিকতার মানূষ ছাড়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

আমি আরো আশ্চর্য হই যখন শুনি ঠাকুরগাঁয়ে শাকির হোসেন নামে অন্য আরেকজন ভদ্রলোক রাস্তায় ৫ লক্ষ টাকা কুড়িয়ে পেয়ে টাকার মালিকর সন্ধান পাওয়ার জন্য মাইকিং করে, স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ ছাপিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছে। মালিককে খুঁজে না পেয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে পরামর্শ করছে ঐ টাকা প্রকৃত মালিকের কাছে কীভাবে পৌছানো যায়? মালিকের সন্ধান পাওয়া নাগেলে ঐ টাকা দিয়ে কী করবেন?

চারিদিকে যখন প্রবল হতাশা, তখন এধরনে সংবাদ আমাদেরকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়। নতুন করে বাঁচতে শেখায়।

প্রবাদ আছে –“রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটে আসে”। আমাদের আলোচ্য দুইজন ব্যাক্তি কী সেই ভোরের আগমনী বার্তা বাহক? যে ভোরের প্রত্যাশায় আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল?মৃত্যু ভয় পরোয়া না করে পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল?

-ছয়-

ঠাকুগায়ের শাকির হোসেনের পরিচয় পাওয়া গেছে । অন্যদিকে দিনমজুর ভদ্রলোকের পরিচাওয় পাওয়া না গেলেও স্থানীয় কমিশনার তাকে চিনেন। সুতরাং কমিশনার সাহেবের উচিৎ হবে ঐ দিনমজুর ভদ্রলোকের অনুমতি নিয়ে তার পরিচয় দেশবাসীকে জানিয়ে দেয়া।

আমাদের উচিৎ শাকির হোসেন এবং দিন মজুর ভদ্রলোককে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত ও সম্মানিত করা। কারন এই লোকগুলিইতো আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে আইডল হওয়া উচিৎ। প্রতিনিয়ত অভাবের মধ্যে থেকেও কোন মানুষ সৎ থাকতে পারে –নির্লোভ হতে পারে সেটা ঐ দুইজন ভদ্রলোককে না দেখলে বা চিনলে আগামী প্রজন্ম সৎ ও নির্লোভ হতে শিখবেনা। তাই ঐ শাকির হোসেন এবং দিনমজুর ভদ্রলোক দুজনকে কেবল পুরস্কৃত করা নয় তাদেরকে জাতীয়ভাবে পরিচিত করিয়ে দেয়া উচিৎ, তাদের দুজনের টাকা ফেরৎ দেয়ার গল্পটি ছোটদের পাঠ্যপুস্তকেও সংযুক্ত করা যেতে পারে। সেটা করতে হবে আমাদের স্বার্থে, আমাদের দেশের স্বার্থে, আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বার্থে।

(লেখকঃ সংগঠক, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি)