মতামত

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা — মো. শহীদুল্লাহ

[ ‘‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কারা হামলা করে’’ লেখক বদরুদ্দীন উমরের। প্রথম আলোশুক্রবার, ১২ আগস্ট ২০২২। বদরুদ্দীন উমর এই লেখায় বাংলাদেশের মুসলিমগরিষ্ঠ সমাজে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে ভুল ব্যাখ্যা হাজির করেছেন।  বদরুদ্দীন উমর অতীতে  কয়েকটি লেখায় বাংলাদেশে হিন্দু প্রশ্ন সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন। তার দুটো লেখা গুরুত্বপূর্ণ।এটা কি সাম্প্রদায়িকতা?’,যুগান্তরে২৫ মে ২০১৪। দ্বিতীয় লেখাটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশে প্রকৃত সংখ্যালঘু কারা?’  যুগান্তরে  জুন ২০১৬ বাংলাদেশে হিন্দুদের পর সাম্প্রতিককালে নির্যাতন বেড়েছে। বদরউদ্দিন উমর হামলানির্যাতনের ঘটনা  অকপটে স্বীকার করেন। কিন্তু এই সমস্ত হামলাকে জনাব উমর  সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে রাজি নন। এই লেখা বদরুদ্দীন উমরের মতামতের সমালোচনা। ]

মো. শহীদুল্লাহ (ফাইল ছবি)

 

সাম্প্রদায়িকতা কি?

বদরুদ্দীন ওমর লিখেছেন ‘‘… সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশ আমলের উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জন্ম লাভ করা এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিশ শতকের প্রথম থেকে পুরোপুরি রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করে…। তার এই বক্তব্য ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশ আমলে জন্ম লাভ করেছে নাকি ব্রিটিশরা ভারতে পা রাখার আগেও ছিল, কিংবা ১৯৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে ছিল কিনা, এখন বাংলাদেশে আছে কি নেই; এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ আসলে কি? এই শব্দটির মর্মার্থ বলতে আমরা কি বুঝব?

বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ‘সাম্প্রদায়িক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে- ‘দল, গোষ্ঠী বা কোনো সম্প্রদায় সম্পর্কিত ব্যাপার, যা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিবিশিষ্ট।’ তবে আমার মতে ‘সমাজের ধর্মকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলোর ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে মানুষের ভেদবুদ্ধিজাত আচরণ ও মনস্তত্ত্বকে সাম্প্রদায়িকতা’ বলা হয়। এই সাম্প্রদায়িকতা রাজনীতি, সংস্কৃতি ও জীবনাচার মানুষের মনোজগতে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কিন্তু ধর্মীয় রাজনীতির অনুকুল বাতাস পেলে এই সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, তখন এক ধর্মের লোকজন অন্য ধর্মের মানুষদের বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রাণ সংহার করে এবং সহায়-সম্পদ লুটে নেয়। যা ব্রিটিশ আমলে গোটা ভারতবর্ষে,পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশে অনেকবার দেখা গেছে। আমাদের সামাজিক ইতিহাসের পাতা উল্টালে  দেখতে পাব এই সাম্প্রদায়িকতা কত রক্তক্ষয়ী ও মানবতাবিরোধী হতে পারে।

ভারতে হিন্দু-মুসলিমের ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও মানসিকতা বোঝার জন্য ঢাকার শিখা গোষ্ঠীর লেখক কাজী আবদুল ওদুদের এই বক্তৃতাংশটুকু খুব গরুত্ব বহন করে। তার ভাষায়, ‘‘…কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের পূর্ব্বে এ দেশে হিন্দু ও মুসলমানের সম্বন্ধ মধুর ছিল, ঐতিহাসিক সাক্ষ্য তার বিরুদ্ধে। এমন কি, দেশের এই দুই সম্প্রদায়ের সম্বন্ধ শুধু অপরিচয়ের সম্বন্ধ ছিল এও বলা যায় না। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ফরিদপুরে ও যশোহরে মুসলমান চাষী ও  নমঃশূদ্রদের ভিতরে দীর্ঘকালব্যাপী একাধিক দাঙ্গা হয়েছিল, তাতে সেই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানদের অনেকে দুই পক্ষে যোগ দিয়েছিল। মোগল-শাসনের শেষভাগে গুজরাটে ও কাশ্মীরে যে দুটি ভীষণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল বিখ্যাত ইতিহাস “সিয়ার মোতাখেরীণ”-এ তার উল্লেখ আছে এই ভাবে:

সম্রাট ফেরোহ্শিয়ারের সিংহাসনারোহণের বৎসরে আহমাদাবাদে এক হিন্দু গৃহস্থ হোলির সময়ে তার বাড়ীর উঠানে হোলি জ্বালালে। তখন হোলির সময়ে বিষম মাতামাতি হতো। আঙিনা-সংলগ্ন ও আঙিনার অতি অল্প অংশের অধিকারী মুসলমান গৃহস্থেরা তাতে আপত্তি করলে। হিন্দু গৃহস্থ সে আপত্তি শুনলো না, বলল, প্রত্যেকের তার নিজের বাড়ীতে সর্বময় কর্তৃত্ব আছে। পরের দিন পড়লো হজরত মোহম্মদের মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে মুসলমান গৃহস্থেরা একটি গরু কিনে এনে সেই আঙিনায় জবাই করল। এতে সেই অঞ্চলের সমস্ত হিন্দু উৎক্ষিপ্ত হয়ে মুসলমানদের আক্রমণ করল, মুসলমানেরা পালিয়ে যে যার বাড়ীতে আশ্রয় নিল। তখন সেই উৎক্ষিপ্ত হিন্দু-জনতা গোহত্যাকারী কশাইয়ের সন্ধান করল; তাকে না পেয়ে তার চোদ্দ বৎসর বয়সের ছেলেকে এনে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ সেই গো-হত্যার স্থানে বলি দিল। তখন শহরের সমস্ত বিক্ষুব্ধ মুসলমান ও আফগান-সৈন্য কাজীর বাড়ী গিয়ে উপস্থিত হল। কাজী জানতেন শাসনকর্তা দায়ুদ খাঁ পণি এ ব্যাপারে হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছেন, তিনি এদের মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারা উত্তেজিত হয়ে কাজীর বাড়ীর সদর দরজা ভাঙ্ল- হয়ত কাজীরই গোপন ইঙ্গিতে-ই, তারপরে আরম্ভ করল শহরের হিন্দু-দোকানে আগুন দিল। অচিরেই কাপূর চাঁদ নামক একজন রত্ন-বণিক লোকজন ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের বাধা দিল। কয়েকদিন এই ভাবে গণ্ডগোল চলল। শেষে শাসনকর্তা মুসলমানদেরই বেশী দোষী সাব্যস্ত করলেন। কাশ্মীরের দাঙ্গাটি এর কিছুকাল পরে ঘটে। সেখানকার আবদুল্ নবী ওরফে মাহ্তাবী খাঁ ভয়ানক হিন্দু-বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এই অরাজকতার কালে একদল ভবঘুরে উচ্ছৃখল মুসলমান জুটিয়ে তাদের নেতা হয়ে সে স্থানীয় সরকারী-শাসনকর্তা ও কাজীর কাছে এই প্রস্তাব করল যে এর পরে হিন্দুদের আর কোনো সম্ভ্রমসূচক যান-বাহন বা বস্ত্রাদি ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না; বাগান ও স্নানের ঘাটও তাদের জন্য নিষিদ্ধ হবে। সহকারী-শাসনকর্তা ও কাজী বললেন- মহামান্য বাদশাহের যা হুকুম তাই-ই কাশ্মীরে চলবে। বলা বাহুল্য এতে মাহ্তাবী খাঁ সন্তুষ্ট হলো না। এরপর তার কাজ হলো সুবিধা পেলেই হিন্দুদের আক্রমণ করা ও তাদের উপরে অত্যাচার করা। একদিন সাহাব রায় নামক জনৈক সম্রান্ত হিন্দু এক বাগানে উৎসব করছিলেন। সেই নিরপরাধ লোকদের উপর সে তার দলবল নিয়ে হামলা করল এবং যত পারল খুন জখম করল। সাহাব রায় পালিয়ে সরকারী-শাসনকর্তার বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। তার বাড়ী এই মাহ্তাবী খাঁর দল ইচ্ছামত লুট-তরাজ করল। সেই অঞ্চলের কোনো হিন্দুবাড়ী বাদ গেল না, এই সব বাড়ীতে আগুন দেওয়াও চললো। যে সমস্ত মুসলমান এই হতভাগ্যদের জন্য দুকথা বল্তে এলেন তারাও খুন জখম হলেন। এই মাহ্তাবী খাঁর দলের সঙ্গে কাশ্মীরের রাজপুরুষেরা এঁটে উঠতে পারলেন না, তাঁরা পালিয়ে গেলেন। তাঁদের আশ্রিত হিন্দুদের উপরে তখন হলো অকথ্য অত্যাচার। জয়ী হয়ে মাহ্তাবী খাঁ স্থানীয় জুমা মসজিদে নিজেকে “দীনদার খা” (ধর্ম্মরক্ষক) বলে ঘোষণা করলো ও শাসন-কাজ চালাতে লাগলো। রাজপুরুষদের একজনের চক্রান্তে মাহ্তাবী ও তার দুই শিশুপুত্র নিহত হলে তার দল উৎকট হত্যাকাণ্ড চালাল। প্রায় তিন হাজার  লোক তাদের হাতে মারা পড়লো- তার অধিকাংশই মোগল। কয়েক মাস ধরে এই দাঙ্গা চলে।

শেষের এই ঘটনাটি “সিয়ার মোতাখেরীণ”-এর লেখক বলেছেন একদল শয়তানের কাজ। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ যাঁরা বুঝতে চান তাঁদের জন্য সেকালের এই দুটি ঘটনাই খুব অর্থপূর্ণ। একালের কলকাতা, ঢাকা, কানপুর, চাটগাঁ প্রভৃতি স্থানের হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সঙ্গে এসবের আশ্চর্য মিল রয়েছে। ফিরোজাবাদের দাঙ্গার তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতেও এই ধরণের দাঙ্গা সেখানে হয়েছিল।’’ (বই: হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, ‘মুসলমানের পরিচয়’ শীর্ষক শান্তিনিকেতনে প্রথম বক্তৃতা-২৬ মার্চ, ১৯৩৫; পৃ. ১০-১১, কাজী আবদুল ওদুদ।)কাজী আবদুল ওদুদের এই বক্তব্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হিন্দু-মুসলিমের রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতে আসার আগেই ছিল।

.

উমর লিখেছেন,‘‘ পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু আধিপত্যের অবসানের পর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিবর্তে  অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যে তার বড় ধরনের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। এ প্রক্রিয়া ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটা পরিণতি লাভ করে। বাংলাদেশ কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। এটি বাঙালিদের রাষ্ট্র, যার একাংশ হিন্দু।’’ এই বক্তব্য আংশিক সত্য, তবে ভুললে চলবে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রধর্মের রাজদণ্ডধারী রাষ্ট্র। তা ছাড়া এই রাষ্ট্রে ইসলামধর্মকেন্দ্রিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর যে কদর ও প্রভাব তাতে বাংলাদেশকে একটি আধা-ধর্মীয় রাষ্ট্র (Quasi-Islamic State) বললে অন্যায় হবে না। ‘পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু আধিপত্য’- স্মরণযোগ্য যে, ১৯৪৬’র হিন্দু-মুসলিম দঙ্গা এবং ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে কোনো অর্থেই হিন্দু আধিপত্য ছিল না। তখন গোটা পাকিস্তানে হিন্দুদের অবস্থা ছিল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। এ ব্যাপারে আমি তৎকালীন পাকিস্তানে তথা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে হিন্দুদের কি অবস্থা হয়েছিল তার সামান্য ঐতিহাসিক প্রমাণ দিচ্ছি। আমার মতে, পূর্ববঙ্গ হিন্দুশূন্য হওয়ার প্রধান কারণ তাদের ওপর মুসলিম উগ্রবাদীদের হত্যা, হুমকি ও বিধর্মী নিধন (Pogrom) এবং হিন্দুদের সম্পত্তিকে ‘মালে গনিমত’ মনে করে দখল করা। মিয়ানমারের রাখাইনে আজ মুসলিমদের যে দশা, ঠিক একই দশা হয়েছিল ১৯৪৭-১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানের হিন্দুদের। পাকিস্তানের কোনো অংশেই সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা এবং সামাজিক মান-সম্মান বজায় ছিল না। পদে পদে ছিল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। এ ছাড়া ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরিকল্পিত হিন্দু নির্মূলীকরণও ছিল।

পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী মন্ত্রী ছিলেন তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা এবং দারুণ পাকিস্তানভক্ত বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। তার অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে পাকিস্তান ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। তিনি কলকাতায় গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে যে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন, তাতে তৎকালীন পাকিস্তানে হিন্দুর জীবনে কী নাজুক দশা হয়েছিল, তার বর্ণনা রয়েছে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ পত্র থেকে সামান্য অংশ, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ১৯৫০ সালের ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াতক আলী খানকে চিঠিতে লেখেন, “The East Bengal Govt. is still following the welplanned policy of squeezing Hindus out of the province.”

শুধু এই যোগেন মণ্ডল কেন! গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ঢাকার প্রগতিবাদী সাহিত্যসেবী ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন কিরণচন্দ্র সেনগুপ্ত, তিনি কি পাকিস্তানে ইসলামি জাতীয়তাবাদের সর্প-ফণার সামনে টিকতে পেরেছিলেন? পারেননি। চারপাশে বিরূপ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাকে জন্মভূমি ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জামাতে হয়েছিল। যশোরের সন্তান ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত। তিনি সাত চল্লিশের ভারত ভাগাভাগিতে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। স্বাধীনতা সংগ্রামী এই নেতা পাকিস্তান সংবিধান সভার সদস্য ছিলেন। সেসময় পাকিস্তানি শাসকরা হিন্দু ও অন্য ধর্মের সংখ্যালঘুদের দেশ-ছাড়া করার কালাপাহাড়ী নীতি চালাচ্ছিলেন। এর প্রতিবাদে ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত পাকিস্তানের সংবিধান সভা থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘পাকিস্তানের এই প্রান্তে (পূর্বপাকিস্তানে) ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেভাবে নিপীড়িত হচ্ছেন, তাতে তারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এখানে হিন্দুরা প্রবল হতাশার মধ্যে কালাতিপাত করছেন।’’

টাঙ্গাইলের রানাদা প্রসাদ সাহা। তিনি সিলেটে গণভোটের সময় পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য মুসলিম লীগের তহবিলে এক হাজার টাকা চাঁদা দেন এবং পাঁচ শতাধিক নৌকা ভাড়ার খরচ বহন করেছিলেন। সেই রানাদা প্রসাদকে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। কুমিল্লার ধীরেন্দ্র নাথ দত্তকেও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাসে আটক রেখে হত্যা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রভাবশালী ও সমাজের নেতৃত্ব পর্যায়ের হিন্দুদের কথা বললাম, তাদেরই যখন জীবনের নিরাপত্তার অভাবে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, অন্যদিকে পাকিস্তানে থেকে যাওয়াদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল তখন সাধারণ হিন্দু এবং অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা ইসলামি নিশানের পাকিস্তানে কি ভয়ংকর দস্যুতার শিকার হয়েছিল, এখন তা কল্পনা করাও কঠিন। লেখক ও সমাজ গবেষক বদরুদ্দীন উমর জানেন না, তা নয়, কিন্তু তারপরও তিনি কি করে বলেন পূর্ব পাকিস্তানে ‘হিন্দু আধিপত্য’ ছিল?

.

‘‘… বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশ এই হারের চেয়ে বেশি…। ’’ উমরের মুখে এ কি অগণতান্ত্রিক কথা! ভাবতে বড়ই বিব্রত বোধ করি যখন তার মত কমিউনিস্ট আদর্শের মানুষ দেশের হিন্দু নাগরিকদের নিয়ে এভাবে চিন্তা করেন। নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণ ও ভারতবর্ষের সমাজ বিকাশের ধারায় বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশে জমির মালিকানা, শহরে বসবাস, শিক্ষা, সংস্কৃতির চর্চা, আর্থিক শক্তি, অকৃষি লাভজনক পেশা ও চাকরি-বাকরিতে ব্রাহ্মণ ও কায়েস্থরা সুলতানি, মুঘল ও ব্রিটিশ যুগ থেকেই এগিয়ে ছিল। বরং গোটা পাকিস্তান আমল, বলতে কি বাংলাদেশ আমলেও হিন্দুদেরকে নানাভাবে চাকরি ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে, দেশভাগের সময় ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিমরা হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়েছিল। সেই সময় পাকিস্তানের হিন্দুদের মত ভারতের মুসলিমদেরও অনেকে নিহত হয়েছে এবং সহায়-সম্পদ হারিয়েছে। এবং আজ অবধি ভারতে থাকা মুসলিমরা বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রের মতো চাকরি-বাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দু উগ্রবাদীদের ধর্ম-ঘৃণার শিকার হচ্ছে। ভারতে হিন্দুত্ব-নির্ভর দল বিজেপির উত্থান সংখ্যালঘু মুসলিমদের অবস্থাকে সেখানে আরও নাজুক করে তুলেছে।

বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থি সাম্প্রদায়িক মানসিকতার শাসকরা বর্তমানে ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে আছেন। এই সময়ে দেশের সংখ্যালঘুরা খানিকটা ন্যায্য অধিকার পেয়েছে। হিন্দুদের এইটুকু অধিকারও উমরের কাছে ‘বেশি’ মনে হচ্ছে। শুধু উমর না, এই ধরনের কথা সম্প্রতি শুনেছি প্রগতিশীল রাজনীতি করেন বলে পরিচিত একাধিক ব্যক্তির মুখে। মনে রাখা দরকার, আমাদের সংবিধান দেশের নাগরিকদের ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু এই শাসনতান্ত্রিক নীতি কার্যকরের ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। কমিউনিস্ট হিসেবে বদরুদ্দীন উমর তো সোচ্চার হবেন এই ঘাটতিগুলো নিরপেক্ষভাবে পূরণ করার দাবিতে। তা না করে তিনিও ফস করে বলে দিলেন দেশে হিন্দুদের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশ হিন্দু জনসংখ্যার (৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ) হারের চেয়ে বেশি। তার এই মনোভাব মোটেই কমিউনিস্টসুলভ নয়, এমনকি ন্যূনতম প্রগতিশীলও না। বলতে বাধ্য হচ্ছি, অতি বামের পরিণতি যে অতি ডানে বিলীন হয়, বদরুদ্দীন উমর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

.

পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালের ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ এবং বাংলাদেশ ‘আমলের অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন ‘‘১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের ধর্মবিযুক্ত(সেক্যুলার) রাষ্ট্রের সরকার…”। বদরুদ্দীন উমর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মানুষ। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ তার প্রতিষ্ঠিত। আমার প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ কি সেক্যলার রাষ্ট্রছিল? আমার বিবেচনায় মোটেই না। পাকিস্তান ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেলাম, তা পাকিস্তানের চেয়ে শতগুণ অগ্রসর রাষ্ট্র এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই রাষ্ট্র কোনো অর্থেই সেক্যুলার রাষ্ট্র নয়। বরং বহুধর্মের চর্চাকারী রাষ্ট্র (Multi-theological state)। পরবর্তীতে সংবিধানে ৫ম সংশোধনী এবং রাষ্ট্রধর্ম বিল যুক্ত হয়েছে। সঙ্গে আছে ব্রিটিশ আমলের ধর্ম অবমাননা আইন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও নানা প্রকার আদিভৌতিক ভাবাদর্শ চার্চাকারী ধর্ম-গোষ্ঠী আমাদের সমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।  এই মধ্যযুগীয় চিন্তার গণবিরোধী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে ছায়া-রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করে। এগুলো মাঝে-মধ্যেই বিরাট ধ্বংসাত্মক শক্তি প্রদর্শন করে। সমাজের প্রগতিশীল রূপপান্তর ঠেকিয়ে রাখাই এদের কাজ।এসব কারণে আমাদের রাষ্ট্র এখন আধা-ইসলামিক রাষ্ট্রের (Quasi Islamic State) চরিত্র ধারণ করেছে। যার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি আমাদের রাজনীতিতে ধর্মের আগ্রাসী ব্যবহার এবং সমাজের সর্বস্তরে ইসলামীকরণের মধ্যে দিয়ে।

.

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি মৌলবাদী দল ক্রিয়াশীল রয়েছে আমাদের সমাজে। এদের সামাজিক ও সাংগঠনিক শক্তি অবহেলা করার মত নয়। এখন প্রশ্ন, এসব দল কি শুধুই মৌলবাদী এবং বাংলাদেশে সরা-শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র ও সরকার কায়েম করতে চায়, এ কথা সত্য। কিন্তু তাদের কল্পস্বর্গ ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ করার সংগ্রামে এসব ধর্মভিত্তিক দলের নেতা ও সংগঠকরা তাদের বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা মত যা-কিছুকে অনৈসলামিক বলে মনে করেন, সেগুলোকে সমাজ থেকে নির্মূল করার নীরব ও সোচ্চার জিহাদ পরিচালনা করাকে তারা ঈমানি দায়িত্ব মনে করেন। এই ফ্যাসিবাদী চেতনা অনুযায়ী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টন ও অমুসলিম ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর মানুষকে তারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট বাধা মনে করে। নারীর ক্ষমতায়নের বেলায়ও তারা এই একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে থাকে। একারণে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের উপস্থিতি এবং নারী ও অমুসলিমদের ক্ষমতায়ন মেনে নেন না। উপরন্তু রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করে তা ঠেকিয়ে দেওয়ার সন্ত্রাসী কাজে সক্রিয় থাকেন। এসব দলের এই যে গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী পুরনো আদর্শ, তা অনিবার্যভাবেই সাম্প্রদায়িক এবং সমাজের অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশের পথে ক্ষতিকর ও কালাপাহাড়ী বাধা।

শেষ কথা: কারো কারো থাকতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগেরই ফৌজদারী অপরাধের সামাজিক রেকর্ড নেই, সামাজে তারা হিংসাত্মক ব্যক্তি হিসাবেও পরিচিত নন; এ রকম স্বভাবের এক দল মানুষ যখন শুধুই নিজের ধর্ম-গৌরব ও পরিচিতি রক্ষার জন্য সম্প্রদায়গত দলবদ্ধতার ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে পরস্পরকে খুন-জখম করে এবং প্রতিপক্ষের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়, নারীদের অসম্মান করে এবং সহায়-সম্পদ লুটে নেয়, তখন এই সহিংস কাজ নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা প্রতিহিংসা। মানবতাবিরোধী এ ধরনের সহিংস নরঘাতী কাজকে বদরুদ্দীনের কমিউনিস্ট চিন্তাকাঠামোর ছকে ফেলে শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠ-পোষকতায় সবল পক্ষ কর্তৃক দুর্বলের জমি-সম্পত্তি দখল বললে ঘটনার প্রকৃত সামাজিক ব্যাখ্যা হয় না। উমরের শ্রেণিদৃষ্টির চশমায় হিন্দু-মুসলমানের মনোজাগতিক এই অমানবিকতা ও পশ্চাৎপদতা দৃষ্টিগোচর হয় না। উমরের এই সীমাবদ্ধতা নতুন নয়, বহু পুরনো।

 

লেখক: সাংবাদিক সাবেক ছাত্রনেতা