মতামত

চা শ্রমিকদের দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি যৌক্তিক দাবি

– ফজলুল কবির মিন্টু

প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় পূর্বে বৃটিশ আমলে এই অঞ্চলে চা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। চা বাগান শ্রমিকদের আদি নিবাস মাদ্রাজ, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ডোমকা, নাগপুর এবং পশ্চিম বঙ্গ। এরা ছিল হরিজন, কোল, মুন্ডা, কৈরি, চন্ডাল এবং সাঁওতাল সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষ। অভিযোগ আছে দারিদ্র পীড়িত এসকল হতভাগ্য জনগোষ্ঠীকে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে এবং শক্তি প্রয়োগ করে চা বাগানের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায়, উন্নত জীবনতো অনেক দূর অস্ত এখনো চা শ্রমিকদের নিজেদের বসবাসের এক খন্ড ভূমি পর্যন্ত হয়নি।

বাগানে কাজ করার শর্তে মালিকের দেয়া ছোট এক খণ্ড জায়গাই তাদের এক মাত্র আশ্রয়স্থল। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে -প্রত্যেক পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন শ্রমিককে চা বাগানে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হয় নাহলে আশ্রয়স্থলটুকুও হারানোর শংকা থাকে। ফলে তারা বংশ পরস্পরায় চা শ্রমিক হিসাবেই দিন যাপন করতে বাধ্য হয়।

ইতিহাসে বর্ণিত আছে, ১৯২১ সালের ২০ মে বঞ্চিত ও বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকেরা নিজ মাতৃভূমিতে তথা মুল্লুকে ফিরে যাওয়ার জন্য চাঁদপুর জাহাজঘাটে জমায়েত হলে বৃটিশ সরকার এবং বাগান মালিকরা সম্মিলিতভাবে শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে হামলা করে। নিহত হয় শত শত হতভাগ্য চা শ্রমিক। শ্রমিকের লাল রক্তে রঞ্জিত হয় মেঘনার জল। আজও যেন মেঘনার জলে শ্রমিকের রক্ত প্রবাহমান।

সভ্যতা এগিয়েছে –চা শিল্পেরও অনেক বিস্তৃতি ঘটেছে। কিন্তু চা শ্রমিকের ভাগ্য বদল হয়নি এখনো। তাদের জীবন যেন যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে।  শ্রম আইনেও তারা বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশের সকল সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য নৈমিত্তিক ছুটি আছে কিন্তু এক অজানা কারণে চা শ্রমিকদের নৈমিত্তিক ছুটি নাই। আবার অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকেরা ১৮ দিনে ১ দিন অর্জিত ছুটি পেলেও চা শ্রমিকেরা অর্জিত ছুটি পায় প্রতি ২২ দিনে ১ দিন। অর্থাৎ চা শ্রমিকেরা অন্যান্য সেক্টরের শ্রমিকদের তুলনায় গড়ে বছরে ৪ দিন কম অর্জিত ছুটি পায়।

ট্রেড ইউনিয়ন করার কারণে আমার বেশ কয়েকটি চা বাগান ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। চা শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম -বাগান জুড়ে কোথাও কোন ল্যট্রিন বা শৌঁচাগার নাই।  ফলে চা শ্রমিকদের বাধ্য হয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় খোলা আকাশের নীচে। এতে পুরুষ শ্রমিকরা কোন রকম কাজ সেড়ে নিতে পারলেও নারী শ্রমিকেরা খুবই সংকটে পড়ে। অথচ শ্রম আইনের ৫৯ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক শৌচাগার ও ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা মালিকের দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে মালিক পক্ষের অনীহা –মালিক পক্ষকে আইন মানতে বাধ্য করতে রাষ্ট্রের উদাসীনতা যেমন লক্ষণীয় তেমনি চা শ্রমিকদের একমাত্র ইউনিয়ন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও খুব একটা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন শ্রমিকদের সিবিএ ইউনিয়ন হওয়ায় তারাও বাগানে ল্যাট্রিন বা শৌঁচাগার স্থাপনের জন্য দাবি জানাতে পারতো কিন্তু এধরনের কোন দাবি চা বাগান শ্রমিকদের সিবিএ’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কিনা তা আমার জানা নাই।

উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে চা বাগান শ্রমিকদের খুব একটা মাথাব্যথাও নাই। দিনরাত বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে গিয়ে তারা এতবেশি ক্লান্ত যে, কোন রকমে ডাল-ভাত খাবার মত মজুরি পেলেই যেন বাঁচে অন্যান্য ন্যায়সংগত সুযোগ-সুবিধাগুলো তাদের কাছে আকাশ কুসুম কল্পনার মতই মনে হয়। চা শিল্পের ইতিহাস ১৫০ বছরের বেশি হলেও এখনো তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা মাত্র। এখানেও শর্ত আছে। দৈনিক নিম্নতম মজুরি নিশ্চিত করতে হলে তাদেরকে কমপক্ষে ২৩ কেজি পাতা উত্তোলন করতে হয়। এর বাহিরে তারা সপ্তাহে ৩ কেজি আটা পায়। চা শ্রমিকদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে ১ বেলা খেয়েও তাদের পক্ষে দৈনন্দিন খরচ মিটানো প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। এরকম এক প্রেক্ষাপটে চা শ্রমিকেরা বিগত ৯ আগস্ট থেকে প্রথমে ২ ঘন্টা কর্ম  বিরতি এবং পরবর্তীতে সর্বারত্মক কর্ম বিরতি পালন করছে। তাদের দাবি দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি। শ্রমিকদের এই দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক দাবি। ৪ সদস্য বিশিষ্ট কোন পরিবারের জন্য দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরি খুব একটা রাজকীয় দাবি নয়। এ দাবি হচ্ছে –শুধু সারাদিন কাজ করে তার বিনিময়ে কেবল বেঁচে থাকার সুযোগ। অথচ এমন একটি যৌক্তিক দাবির জন্য চা শ্রমিকদেরকে আজকে প্রায় ১২ দিন লাগাতার ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করতে হচ্ছে যা খুবই অমানবিক। রাষ্ট্রও যেন নির্বিকার। তারাও কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারছেনা। তারা  অপেক্ষা করছে মালিক পক্ষের সিদ্ধান্তের জন্য। আমাদের গ্রামে গঞ্জে একটা কথা প্রচলন আছে। সেটা হচ্ছে –গরুকে জিজ্ঞাসা করে হাল চাষ করা যায়না। সম্প্রতি চা শ্রমিকদের আন্দোলনে রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যেন মুখে কুলুপ দিয়েছে। কথা বলার সাহসও যেন তাদের নাই।

অন্যদিকে মালিক পক্ষের বক্তব্য লক্ষ করেছি। তারা প্রথমত বলছে চা শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি দৈনিক ১২০ টাকা থেকে অনেক বেশি। একথা বলে তারা সারা দেশে গড়ে উঠা জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও প্রকারান্তরে শ্রমিকদের মজুরি যে কম সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। মালিক পক্ষের আরেকটি বক্তব্য হচ্ছে – চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা হলে শিল্প বাঁচবে না। এ যেন নানার বাড়ির আবদার। শিল্প বাঁচানোর জন্য শ্রমিকদেরকে না খেয়ে মরতে হবে।

বিশ্বব্যাপী যখন শিল্প মালিকদের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে তখন আমাদের দেশের শিল্প মালিকদের -তার শ্রমিকদের প্রতি এমন দায়িত্বহীন আচরণ –একধরণের ঔপেনেবেশিক মানসিকতার বহিঃ প্রকাশ। মালিকদের এমন মানসিকতা কেবল চা বাগান শ্রমিকদের ক্ষেত্রে নয় বরং সারা দেশের শ্রম সেক্টরে একই চিত্র। আমরা বৃটিশ তাড়িয়েছি। পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছি কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের কাংখিত স্বপ্ন তথা এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আজও অর্জন করতে পারিনি।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি