মতামত

গলাবাজ টকশোজীবীদের বিরুদ্ধে কেউতো কিছু বলেন না?

– ফজলুল কবির মিন্টু

মন মেজাজ কেমন যেন হয়ে গেছে। কেউ ভাল কথা বললেও চরম বিরক্ত লাগে। ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশী টের পাচ্ছে আমার গিন্নি।  গত উনিশ বছর যাবৎ সে আমাকে যেরকম দেখেছে তার সাথে মিলাতে পারছেনা। গত এক সপ্তাহে সে আমাকে বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে জানতেও চেয়েছে -আমার কী হলো? তাকে কেমনে বুঝায় পুরুষ মানুষের মন মেজাজ সব নির্ভর করে তার পকেটের স্বাস্থ্যের উপর।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম আকাশ চুম্বী। জিনিষের দাম বেশি হওয়ার কারন জানতে চাইলে -উল্টো দোকানদাররা বলে, স্যার টাকা থাকলে দরাদরি না করে কিনে ফেলেন আগামীকাল দাম আরও বেড়ে যাবে। এ যেন উদ্ভট উটের পিঠে চলছে আমার  প্রিয় স্বদেশ। কোথাও কোন নিয়ন্ত্রন নাই।

মাঝে মধ্যে টক দই কিনতাম এনায়েত বাজারের এক দোকান থেকে। টক দই এর জন্য দোকানটার বেশ নামডাক আছে। সম্প্রতি টক দই এর দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতটুকুতে আমার আপত্তি ছিলনা। কিন্তু গিন্নি বললো তারা শুধু দাম বাড়িয়েই ক্ষান্ত হননি -দই এর মানও কমিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ এখন বেশি দাম দিয়ে কম মান সম্পন্ন পণ্য পাবেন।

আমরা আশির দশকে রাজনীতি করা মানুষ। তখন অন্তত রাজপথটা রাজনীতিবিদদের দখলে ছিল। এরশাদ স্বৈরাচার ছিল। স্বৈরাচারদের জনসমর্থন কম থাকে। ফলে সে মাস্তান বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করলে জনতার বিক্ষোভ যেন আরও প্রবল বেগে বেড়ে অগ্নিমূর্তি ধারন করতো। কিন্তু এখন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়। দলটির নেতৃত্বে আছেন শেখের বেটি শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিকভাবে এই দলের একটি ব্যাপক গণভিত্তিও আছে। আছে তার ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ে দলটির ছাত্র সংগঠনের কমিটি ঘোষিত হয়েছে। কমিটির সদস্য সংখ্যা চার শতাধিক। এই কমিটির মিটিং করতে হলেও একটি কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করতে হবে। অবশ্য এসব সংগঠনের কমিটি মিটিং করার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা কে জানে? আসলে ওদের পদ-পদবিই মূল বিবেচ্য বিষয়। পদ যারা পায় এবং যারা দেয় শুনেছি তাদের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক লেনদেন থাকে।

তারও আগে আওয়ামী যুবলীগের চট্টগ্রাম উত্তর, দক্ষিণ এবং মহানগর সম্মেলন হয়েছে। উক্ত সম্মেলনগুলোকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে এক হুলস্থুল কান্ড প্রত্যক্ষ করলাম আমরা। সারা চট্টগ্রামে পদ প্রত্যাশীদের যে পরিমান ডিজিটাল ব্যানার লাগানো হয়েছে –টাকার অঙ্কে তার পরিমান নাকি তা কয়েক কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে সম্মেলন করার কয়েক মাস পরও এখনো কোন কমিটি ঘোষনা করা হয়নি।

বোধকরি কমিটি ঘোষণার পর চট্টগ্রামে কয়েকদিন পদ বঞ্চিতদের মহড়া চলবে। যেমনটি হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষনার পর। এরা পদ বঞ্চিত হয় দল থেকে আর তান্ডব চালায় সারা দেশে। যেন যত দোষ সব জনগণের।

দেশে এখন এক অদ্ভুত নিয়ম জারি আছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের পদ বঞ্চিতরা রাস্তা অবরোধ করলেও দেশের শান্তি শৃংখলা নষ্ট হয়না। কিন্তু তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ সমাবেশও আমাদের শান্তিপ্রিয় পুলিশ ভাইদের পছন্দ হয়না। তার সর্বশেষ মহড়া দেখলাম সম্প্রতি শাহবাগে। গুটি কয়েক ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ যেভাবে হিংস্রতা দেখিয়েছে তা দেখে দেশবাসী রীতিমত আতংকিত।

মাঝে মধ্য আমি বুঝে উঠতে পারিনা দেশ রক্ষার দায়িত্ব আসলে কাদের? –পুলিশের নাকি ছাত্রলীগ-যুবলীগের। প্রশ্নটা আমার মনে এসেছে সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিও  দেখে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগ পরিচয়ে ২০-২২ বছরের এক তরুণ খুবই অশোভন এবং আক্রমণাত্মক ভাষায় গণসংহতি আন্দোলন চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমিকে রীতিমত শাসাচ্ছে। ঐ তরুণের ভাষায় রুমি নাকি সরকার বিরোধী কাজ করছে। যদি যুক্তির খাতিরে ধরে নিই রুমি সরকার বিরোধী কাজ করেছে – তাহলে তাকে নিবৃত করার দায়িত্ব ঐ তরুনকে কে দিল? দেশে সরকারী দল এবং সরকার যে দুইটা আলাদা সত্ত্বা সেটা আমাদের সরকারী দলের অনেক বড় বড় পদধারী নেতারাও বুঝে কিনা সন্দেহ। ফলে ঐ তরুণের দোষ দিয়ে আর কী লাভ? তাই সাবধান রাস্তায় সরকার কিংবা সরকারী দল কারও বিরুদ্ধেই কিছু বলা যাবেনা। ঐ তরুণের ভাষায় সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই – প্রথমে মারা হবে এবং মেরে হাত পা ভেঙ্গে তারপর থানায় সোপর্দ করা হবে।

শুধু যে রাস্তায় বাধা পাবেন তাও না। ইদানীং আমার কিছু ভিন্নতর অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। আমি মাঝে মধ্যে সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিই। আমার পোস্ট সবার পছন্দ হবে না –এটাই স্বাভাবিক। যৌক্তিকভাবে আমার পোস্টের বিরোধীতা করলে আমার নিজেরও লাভ হয়। কিন্তু কেউ কেউ যখন নির্লজ্জভাবে সরকারের কর্মকান্ডকে সমর্থন দেয়ার জন্যই আমার পোস্টের বিরোধীতা করে তখন সরকারী দলের ঐ বিভ্রান্ত তরুণ এবং আমার ফেসবুক পোস্টের বিরোধিতাকারীদের একটা মিল খুঁজে পাই। তেমনি একজন রাশেদ মাহমুদ নামের এক সাংবাদিক। তার সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাই। শুনেছি তিনি নাকি প্রথম আলোতে এক সময় ফটো সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন। বর্তমানে কোথায় আছেন তাও জানিনা। সম্প্রতি সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতনের একটা বক্তব্যের সূত্র ধরে আমার ফেসবুক ওয়ালে এক লিটার ডিজেলের দাম ৭০ টাকার বেশি হতে পারেনা বলে উল্লেখ করেছি। রাশেদ মাহমুদ সাহেব আমার পোস্টের বিরোধীতা করলেন। এতে মোটেও বিরক্ত হইনি। কিন্তু বিরক্ত হয়েছি যখন তিনি রাজেকুজ্জামান রতনকে আহম্মক হিসাবে উল্লেখ করলেন আমাকে মাথা খারাপ বললেন। তাকে ইন্টারনেট থেকে বেশ কয়েকটা রেফারেন্সও দিলাম। কিন্তু যথারীতি বলতে লাগলেন এসব তথ্য ভূয়া। বলা বাহুল্য বার বার বলার পরেও তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে কোন রেফারেন্স দেখাতে পারেন নি। শুধু বলেছেন ইস্টার্ন রিফাইনারীর একজন কেমিস্ট নাকি ওনাকে জানিয়েছেন। সবশেষে উনি রেফারেন্স হিসাবে প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক একরামুল হক বুলবুলের নাম উল্লেখ করেছেন এবং এ সংক্রান্ত বুলবুল সাহেবের ফেসবুক ওয়ালে একটা পোস্ট আছে সেটা পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি যথারীতি বুলবুল সাহেবের ফেসবুক ওয়ালে ঢুকে ঐ পোস্টটা পড়লাম। জনাব বুলবুল চট্টগ্রামের একজন সিনিয়র সাংবাদিক। সাংবাদিক হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। কিন্তু দেখলাম তিনি রাজেকুজ্জামান রতনের বক্তব্যের মর্মার্থই বুঝতে পারেন নি। তিনি রাশেদ মাহমুদ থেকে এক কাঠি সরস। তিনি রাজেকুজ্জামান রতনের মত লোককে কেন টকশোতে আনা হয় সে প্রশ্ন তুলেছেন। দেখলাম রাশেদ মাহমুদ এবং বুলবুল সাহেবের বক্তব্যের সুর প্রায় একই।  তারা দুই জনই বলতে চেয়েছেন ক্রুড অয়েল থেকে ৪০% থেকে ৪৫% ডিজেল আউপুট হিসাবে পাওয়া যায়। অথচ ক্রুড অয়েল থেকে কেবল ডিজেল উৎপাদন হয়না। ক্রুড অয়েল থেকে ডিজেল ছাড়াও পেট্রোল, অক্টেন, জেট ফুয়েল, কেরোসিন, ন্যাপথা, এলপিজি, এলএনজি ইত্যাদি পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে ক্রুড অয়েলের তুলনায় রিফাইন্ড আউটপুটের ঘনত্ব কম থাকায় ১০০ লিটার ক্রুড অয়েল থেকে ১০৬ লিটার রিফাইন্ড আউটপুট পাওয়া যায়। এটাকে বলা হয় প্রসেস গেইন। অর্থাৎ প্রসেস গেইন ৬%।

এগুলি সব বিবেচনায় নিলে রাজেকুজ্জামান রতনের হিসাবের কাছাকাছি মিল পাওয়া যায়।  তাছাড়া রাজেকুজ্জামান রতন বক্তব্য রেখেছেন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসাবে। তিনিতো কষ্ট একাউন্টেন্ট হিসাবে বক্তব্য রাখেন নি। তাই তার বক্তব্যে প্রতি পয়সার হিসাব খুঁজতে যাওয়া বোকামী। তিনি একটি সূত্র দেখিয়েছেন মাত্র। যা দ্বারা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন সরকার এই মুহুর্তে তেলের দাম না বাড়ালেও পারতেন।

প্রতিদিন বিভিন্ন চ্যানেলে কত রাজনৈতিক  টকশো দেখা যায়। অধিকাংশই আবোল-তাবোল, গাঁজাখোরী এবং এক ধরণের যুক্তিহীন গলাবাজি । সেগুলি নিয়ে কাউকে তেমন কোন উচ্চ বাচ্য করতে দেখিনা কিন্তু রাজেকুজ্জামান রতনের বিরুদ্ধে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া কেন? কেন রতন ভাইকে টকশো থেকে বিতাড়িত করতে চান? তিনি গরীব মানুষের পক্ষে কথা বলেন বলেই? তার কন্ঠ থামাতে পারলে কার লাভ? রাশেদ মাহমুদ এবং একরামুল হক বুলবুল সাহেবরা কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান?

( ফজলুল কবির মিন্টু, সংগঠক , কেন্দ্রীয় কমিটি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র )