মতামত

চট্টগ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে

চট্টগ্রামে দিন দিন বেড়েই চলেছে নারীর প্রতি সহিংসতা। যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে মাত্রাগতভাবে। গেল ৬ মাসে শুধু নগরীতেই অর্ধশতাধিক ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর বাইরে নির্যাতন, হেনস্তা ও হয়রানীর অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে গৃহবধু এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও রেহাই পাচ্ছেন না নিপিড়নের হাত থেকে। সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন না হওয়ার পাশাপাশি ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ও সামাজিক সচেতনতা অভাবে এমন ঘটনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। বন্দরনগরীর সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকা জিইসি মোড়। দিন-রাত এখানে মানুষের আনা-গোনা থাকেই। ট্রাফিক পুলিশ ও টহল পুলিশের অবস্থান থাকে সবসময়। ব্যস্ততম এলাকা হওয়া সত্বেও গত ১৭ জুলাই দিবাগত রাত দেড়টার দিকে জিইসি মোড় আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের নিচে এক তরুণীকে রিকশা থেকে নামিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। এসময় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে রিকশাচালক আব্দুল হান্নান। নগরীর ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পুলিশের অবস্থান সত্বেও এই ধরনের ঘটনা কিভাবে ঘটল- এই প্রশ্ন এখন সচেতন মহলের। চবি’র এক ছাত্রীকে যৌন নিপিড়নের ঘটনায় উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন চত্ত্বরে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে ছাত্রলীগ নামধারী দুর্বৃত্তরা তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালায়। তবে ৬ দিনের মাথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের হিসেবে, ২০১৭ সালে বন্দরনগরীর বিভিন্ন থানায় ধর্ষণ মামলা হয়েছিলো ১০৮ টি। পরের বছর তা দাড়ায় ১৩০ টির বেশি । ২০১৯ সালে ১৯৫ টি, ২০২০ সালে ২৪৮ টি, ২০২১-এ ২৫১ টি আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৪২ টি ধর্ষণ মামলা রেকর্ড হয়েছে। গত ছয়মাসে সংগঠিত ঘটনা সমূহ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু, কিশোরী এবং তরুণী। নির্যাতনের শিকার অন্তত ৬০ শতাংশ নারীর বয়স ৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে। অন্যদিকে নিপীড়কদের অন্তত ৭০ শতাংশের বয়সই ৪০ বছরের ওপরে ও বিবাহিতরাই বেশি। তারা হয় ফুসলিয়ে ধর্ষণ বা যৌন নির্যতন করছে নতুবা জোরপূর্বক ধর্ষণ করছে। ধর্ষণের মামলায় শাস্তি বাড়ানো হলেও কমছে না এ অপরাধের সংখ্যা। উল্টো দিন দিন বাড়তির দিকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, মাঝে মাঝে এ জাতীয় অপরাধ একত্রে ঘটে বলে মনে হয়, হঠাৎ বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নারী নেত্রীরা বলছেন, নারীদের ওপর সহিংসতার একটি কারণ হলো- সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারে না বরং পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে সহ্য করতে বাধ্য হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তবতা আরো ভয়ঙ্কর। কিছু কিছু ঘটনা আলোচিত হলে তার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হয় ঠিকই, কিন্তু বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়নি এখনো। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক লতিফা কবির বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি দীর্ঘদিন ধরে মহিলা পরিষদ জানাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানান।

সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সারা দেশে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এ জন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্ট। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) শামসুল আলম বলেন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ হলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তদারকি করি। কেন ঘটনা ঘটলো, এর পেছনে কারণ কী- এ সব জানার চেষ্টা করি। যতক্ষণ এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন না হয় ততক্ষণ আমরা লেগে থাকি। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা কোন প্রেক্ষাপটে কারা ঘটাচ্ছে; ভুক্তোভোগীরা কোন শ্রেণীর মানুষ -এসব চিহ্নিত করতে যে পরিমান গবেষণা প্রয়োজন তার কিছুই হচ্ছে না। তাই প্রতিরোধের উপায়ও বের করা সম্ভব হচ্ছে না।

একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন বলেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যা। মানুষের মধ্যে যে আদিম প্রবৃত্তি, তা দমিয়ে রাখতে হলে শৈশব থেকে বা পরবর্তীতে স্কুল কলেজে যথাযথ জ্ঞান চর্চা, নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করলো, তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায়, এক নাগাড়ে এখানে ওখানে হতেই থাকে। এটা হয় কারণ, যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি, তারা ঘটনার সংবাদটি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। এই ধরনের অপরাধে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত, পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগটা হচ্ছে না। মূল্যবোধ, আদর্শের অবক্ষয় হচ্ছে।

#২৮.০৭.২০২২, চট্টগ্রাম #