মতামত

মৃত্যুন্জয়ী বিপ্লবী কমরেড মনি সিংহ

-রবীন গুহ

মৃত্যুন্জয়ী বিপ্লবী কমরেড মনি সিংহ ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মনি সিংহের মৃত্যুর পরে চট্টগ্রামে এক নাগরিক শোকসভার আয়োজন করা হয়। সেই শোকসভা উপলক্ষ্যে নগরীর বিভিন্ন জায়গায় কিছু পোস্টার লাগানো হয়েছিল। পোস্টারের একটা লেখা এখনো মনে গেঁথে আছে। সেখানে লিখা ছিল- শোষক যেখানে করিবে পাপের প্রায়শ্চিত্তি তুমিই এদেশে রচিয়াছ তার প্রথম ভিত্তি। এভাবেই স্মরণ করা হয় এদেশের বামধারার রাজনীতির এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ কমরেড মনি সিংহকে।

একেবারেই অল্প বয়সে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি শুরু করে ১৯২৫ সালের দিকে বামপন্থী রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মার্কসবাদের দীক্ষা নেন। বড় মাপের মার্কসবাদী পন্ডিত না হয়েও দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রায়োগিক দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রনয়ন করে এদেশের রাজনীতিতে মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইকে শক্তিশালী রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি এদেশে গড়ে তুলেছেন তাঁর অসংখ্য অনুসারী যাদের অনেকেই আজ এদেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাসহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন।

শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ, পারিবারিক আভিজাত্য ও স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সশস্ত্র টঙ্ক আন্দোলন পরিচালনা, সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিভূমি রচনা করা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে এদেশের গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুগপৎ আন্দোলনে নেতৃত্বদান, রাজনীতির জন্য দীর্ঘসময় কারারুদ্ধ থাকাসহ সর্বোচ্চ ত্যাগে প্রস্তুত থাকার মত মানসিকতা ইত্যাদি-এসবই কমরেড মণি সিংহকে এদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধার আসনে পৌঁছে দিয়েছিল। এমনকি বংঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে বড়ভাই নামে ডাকতেন। আমৃত্যু নীতি-আদর্শের প্রশ্নে অনমনীয়, আপোষহীন থেকেও তিনি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে রাখতে পেরেছিলেন নিজেকে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ও কমিউনিস্ট পার্চির সাবেক সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনি সিংহের জীবনী আলোচনাতে লিখেন, “বিপ্লবী রাজনৈতিক জীবনবোধের নিখুঁত প্রতিফলন তাঁর মধ্যে তখন দেখেছি। শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রাত্যহিক জীবনাচরণ, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ-বিনোদন, বন্দীদের প্রতি মমত্ববোধ, সাধারণ কয়েদিদের প্রতি প্রীতিময় আচরণ—এসব বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত ছিল তখনকার ৭৫ বছর বয়সী মণি সিংহের কারাগারের দিনগুলো। এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর নিরন্তর লড়াই চালানোর ঘটনা। রেশন কেন খারাপ এল? পত্রিকা আসতে বিলম্ব হয় কেন? ডাক্তার রাউন্ডে থাকে না কেন? বন্দিজীবন, তাতে কী। কারাগারেও চলবে সংগ্রাম! ১৯৭৭ সালে এসবের মধ্যে প্রতিবিম্বিত হতে দেখেছিলাম একজন প্রকৃত বিপ্লবীর অন্তরের অবিরাম সংগীত মূর্ছনার মর্মবাণী।” সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দীর্ঘপথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন। সততা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ,বিপ্লবী চিন্তার বাস্তবায়নে অধ্যয়ন, মানবতাবোধ ইত্যাদি অসংখ্য গুনের সমাহার মনি সিংহকে একজন কিংবদন্তিতূল্য মানুষে পরিণত করে। আজকের দিনের এই সুবিধাবাদী রাজনীতির সময়ে ক্ষণজন্মা পুরুষ মনি সিংহের জীবন-দর্শণ অধ্যয়ন তরুণ প্রজন্মকে নিশ্চয়ই নতুন আলোর পথ দেখাবে। মৃত্যুন্জয়ী বিপ্লবী কমরেড মনি সিংহ, জন্মদিনে আপনাকে লাল সালাম।