মতামত

প্রসঙ্গ ২৬শে জুলাই ১৯৯৪

-ফজলুল কবির মিন্টু

১৯৯৪ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২৬শে জুলাই স্থানীয় লালদিঘী মাঠে এক জনসভা করার ঘোষনা করা হয়। উক্ত জনসভায় প্রধান অতিথি নির্ধারিত ছিল গোলাম আযম। উল্লেখ্য ১৯৭৮ সালে জিয়ার আমলে গোলাম আযম পাকিস্তানের পাসপোর্ট এবং স্বল্প মেয়াদের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন অতঃপর ১৯৯৪ সাল অবধি অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার আমলে হাইকোর্টের একটি বিতকির্ত রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। এর আগে গোলাম আযম ঘরোয়াভাবে জামায়াত ইসলামীর কমর্কান্ডে অংশগ্রহন করলেও সেইদিনই প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল জামাতের রাজনৈতিক কৌশল। গোলাম আযমের প্রকাশ্য জনসভার ঘোষনার সাথে সাথে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তবে আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে নীরবতা লক্ষনীয় ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছিল নানান সমীকরন এবং গুঞ্জন। এরই মাঝে আমরা বামপন্থী ছাত্র সঙ্ঘটনের নেতৃবৃন্দ একত্রিত হয়ে গোলাম আযমের জনসভা প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু কেবলমাত্র বাম ছাত্রসংগঠন সমূহের শক্তি সমাবেশ দিয়ে যে গোলাম আযমের জনসভা ফলপ্রসু প্রতিরোধ সম্ভব নয় সেটা আমরা অনুধাবন করি। তাই ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্রলীগ সেইদিন স্থানীয় নেতাদের কোন গ্রিন সিগন্যাল না পাওয়া সত্ত্বেও তারা জনসভা প্রতিরোধের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় অন্যদিকে ছাত্রদল তাদের নেতাদের সাথে আলোচনার জন্য সময় নেয় এবং পরবর্তীতে তারাও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয় এতে আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। সম্ভবত ১৮ জুলাই প্রথম মিটিং হয় ছাত্র ইউনিয়ন অফিসে এবং ২০শে জুলাই ছাত্রদল অফিসে ২য় মিটিং এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মিটিং শেষে মিছিল করা হয়। প্রকৃত অর্থে সেটা ছিল গোলাম আযমের জনসভা প্রতিরোধে প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচী। ২০শে জুলাইয়ের পরে প্রেক্ষাপট পুরোপুরি পরিবতর্ন হতে থাকে। পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়ে। তখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ছিলেন ওসমান আলী খান। তিনি ছাত্র নেতাদের সাথে বৈঠকের প্রস্তাব দিলেন।সম্ভবত ২১ কিংবা ২২ তারিখ আমরা পুলিশ কমিশনারের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। তিনি চট্টগ্রামের কিছু ডাকসাইটে রাজনৈতিক নেতার নাম উল্লেখ করে বললেন যে তাদের সাথে সমযোতা করেই জামায়াত ইসলামী চট্টগ্রামে জনসভা ঘোষনা করেছে সুতরাং প্রতিবাদ করে লাভ হবেনা। তিনি আমাদের কমর্সূচী প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান। আমরা সাফ জানিয়ে দিই কমর্সূচী প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। রাজাকার শিরোমনি গোলাম আযমকে কোনভাবেই চট্টগ্রামে জনসভা করতে দেয়া হবেনা। আমরা কমিশনার সাহেবকে বললাম যদি মনে করেন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবার আশঙ্কা আছে তাহলে আপনি ১৪৪ ধারা জারী করেন। তখন কমিশনার সাহেব অনেকটা হুমকীর সুরে বললেন ২৬শে জুলাই পুলিশ কোন ভূমিকাই রাখবেনা। পুলিশ কেবল রেফারির মত বাঁশি বাজাবে। আমরা পুলিশ কমিশনারের চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে মিটিং থেকে বের হয়ে আসলাম। পরের দিন বড় আঘাতটা আসলো আমাদের আন্দোলনের উপর। BNP কেন্দ্র থেকে ছাত্রদলকে নিদের্শ পাঠালো তারা যেন আন্দোলন থেকে তাদের সমথর্ন প্রত্যাহার করে নেয়। কৌশলগত কারনে ছাত্রদলের সভাপতি এবং সাধারন সম্পাদক আন্দোলন থেকে সরে দাড়ালেও বাকী নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আন্দোলন চালিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ২৫শে জুলাই শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে জনসভার আয়োজন করা হয়। মহানগর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি সফিকুর রহমান স্বপন সভায় সভাপতিত্ব করেন। ছাত্রদল আমাদের আন্দোলনের সাথে আছে বুঝানোর জন্যই আমরা ছাত্রদলের একজন সহসভাপতিকে দিয়ে সভাপতিত্ব করানোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। সভা পরিচালনা করি আমি নিজে। তখন আমি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি হিসাবে দায়িত্বরত ছিলাম। জনসভায় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি আমাদের আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। গোলাম আযমের জনসভা প্রতিরোধে আমরা ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহন করি। ২৬শে জুলাই সকাল থেকেই শহীদ মিনার প্রাঙ্গন হতে GPO পযর্ন্ত ছাত্র জনতা দখল নেয় কিন্তু চট্টগ্রাম কলেজ হয়ে আন্দরকিল্লা থেকে লালদিঘী পযর্ন্ত রাস্তাটি জামাত-শিবির-পুলিশ দখল নেয়ায় ঐ পথ দিয়েই তাদের লোকজন জনসভায় যোগ দেয়। আমদের কাছে খবর আসে জামাত-শিবিরের সশস্ত্র বাহিনী নতুন বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক প্রাঙ্গনে অবস্থান নিয়েছে এবং পুলিশ – BDR (বতর্মানে BGB) কোতোয়ালি থানার মোড়ে অবস্থান করছিল। আমরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে গোলাম আযমের জনসভার দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ-BDR এবং জামাত- শিবির সম্মিলিতভাবে আমাদের মিছিল লক্ষ করে গুলি ছুড়তে থাকে। গুলিতে প্রান হারায় সরকারি সিটি কলেজের একাদশ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র এহসানুল হক মনি, জাফর এবং টিটু রায়। আহত হয় আরো অনেকে। চাকসুর GS আজিম উদ্দিনও মারাত্বকভাবে আহত হন। গোলাম আযমের জনসভা প্রতিরোধ করতে গিয়ে ছাত্ররা বুকের রক্ত ঢেলে দিল। চট্টগ্রামের কালো রাজপথ ছাত্রসমাজের রক্তে রঞ্জিত হল। অন্যদিকে গোলাম আযমও জনসভা করতে সক্ষম হয়েছিল। তাহলে কি ছাত্রসমাজের রক্ত দান বৃথা গিয়েছিল? সেটা একটা অমিমাংসিত প্রশ্ন তবে সেদিন যদি আওয়ামীলীগ এবং BNP ভোটের নোংরা রাজনীতি না করতো তাহলে পরিস্থিতি আরও ভিন্ন রকম হতে পারতো। তারপরও বলবো কোন রক্ত দান বৃথা যায়না। শহীদ এহসানুল হক মনি, জাফর এবং টিটু রায় লাল সালাম।
লেখকঃ সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলা।