বিজ্ঞান প্রযুক্তি

মহাবিশ্ব ও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের প্রযুক্তি

-রবীন গুহ

মানুষের কল্পনার শক্তি অনেকসময় সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞান  মানুষের এই কল্পনাকেই একসময় বাস্তবে রূপ দেবার ধারণা দিতে পারে। আবার বিজ্ঞানের কোন কোন আবিস্কার কখনো কখনো সাধারন  মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। সম্প্রতি আমেরিকার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা কিছু ছবি গোটা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষের চিন্তার জগতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। নাসা, আমেরিকান স্পেস এজেন্সি এবং ইউরোপীয় এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সিগুলির মধ্যে একটি যৌথ প্রকল্প, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চালু করা হয়েছিল। তবে প্রায় দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি আজকের এই ফলাফল  পেতে দুই দশকেরও বেশি সময় লেগেছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই ফলাফল কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে এমন সব আবিস্কার করা সম্ভব হবে, যা এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা প্রমাণে সক্ষম হবে। এই জুলাই মাসে প্রাপ্ত এর ফলাফল সত্যিই চমকপ্রদ, অনেকটাই অবিশ্বাস্য রকমের ব্যাপার। এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনাও কম নয়। কেউবা এর সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন করছেন। তবে মহাকাশ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, বা আমাদের মত সাধারণেরা যারা মহাকাশ নিয়ে অল্পবিস্তর খোঁজ খবর নেবার চেস্টা করেন  তারা সবাই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ আশাবাদী। ১৩০০ কোটি বছর আগের এত স্পষ্ট ছবি নেয়া,  মনে হবে যেন গাঁজাখুরি একটা ব্যাপার! তবে বিশেষজ্ঞরা ব্যাপারটা যেভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তাতে এ নিয়ে মোটামুটি একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

আমাদের মহাবিশ্বের বয়স মোটামুটি ১৩৮০ কোটি বছরের মত। যদিও আমাদের গ্যালাক্সি মহাবিশ্ব সৃষ্টির ১০০ কোটি বছরের মধ্যেই সৃষ্ট, তবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার ৮০ কোটি বছরের মধ্যে প্রথম তারা ও গ্যালাক্সিদের সৃষ্টি।তাদের থেকে আমাদের কাছে আলো আসতে ১৩০০ কোটি বছরের মত লাগছে। অন্যদিকে,  আমাদের গ্যালাক্সির আলো তাদের কাছে ১৩০০ কোটি বছর পরে পৌঁছাচ্ছে, অর্থাৎ তারা আমাদের গ্যালাক্সি ১৩০০ কোটি বছর আগে যেরকম দেখতে ছিল – সবে জন্মাচ্ছে সেরকম হয়তো দেখবে।

আমাদের পৃথিবীসহ বাকি গ্রহগুলা ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে, সূর্য একটা স্টার বা নক্ষত্র। পৃথিবী ছোট একটা গ্রহ যেটা সূর্য নামের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এমন ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র মিলে আমাদের গ্যালাক্সি, যেটার নাম ‘মিল্কিওয়ে’। এমন অনেকগুলা গ্যালাক্সি একসাথে মিলে হয় গ্যালাক্সি ক্লাস্টার। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরকম প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি  নিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব।আকাশগঙ্গা একটি ছায়াপথ ,ইংরেজিতে যাকে বলে গ্যালাক্সি। আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র সূর্য্য এই ছায়াপথের অংশ। অর্থাৎ আমরা থাকি এই ছায়াপথে। আর ছায়াপথ হলো তারা, নাক্ষত্রিক অবশেষ, আন্তঃনাক্ষত্রিত গ্যাস, ধুলিকনা নিয়ে গঠিত মহাকর্ষীয় টানে আবদ্ধ একটি জগৎ। আমাদের পৃথিবীসহ বাকি গ্রহগুলা ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে, সূর্য একটা স্টার বা নক্ষত্র। পৃথিবী গ্রহটি আবার  সূর্য নামের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। এমন ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র মিলে আমাদের গ্যালাক্সি, যেটার নাম ‘মিল্কিওয়ে’। গ্যালাক্সিগুলো হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে লাখ লাখ থেকে শতকোটি-সংখ্যক নক্ষত্র মহাকর্ষের টানে একসঙ্গে আটকে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা ছবিগুলো  মহাকাশের অনেক গোপন রহস্যের সমাধান করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিগুলো অনেক নতুন গবেষণার ফল পেতে সাহায্য করবে। এসব গবেষণার মধ্যে রয়েছে—আমাদের সৌরজগৎ, ছায়াপথ, কৃষ্ণগহ্বর, নক্ষত্র সৃষ্টি ও বিবর্তনের মতো নানা বিষয়। এই ছবিগুলোর একটি নাম দেওয়া হয়েছে এসএমএসিএস ০৭২৩। ছবিটি আকাশে ছড়িয়ে থাকা আরও দূরবর্তী ছায়াপথের উপস্থিতি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ছবিতে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ ফুটে উঠেছে। মহাবিশ্বের প্রাচীনতম রূপ এটি। ১ হাজার ৩০০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের ছবি এটি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তত্ত্ব অনুযায়ী, সবচেয়ে দূরবর্তী আদি নক্ষত্রগুলোকে আজকে আমরা যেভাবে দেখছি, এর চেয়ে ভিন্নরূপ হতে পারে। আদি নক্ষত্রগুলো মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং থেকে অবশিষ্ট বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত ছিল। এগুলো পরে সূর্যের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে এবং দ্রুত পতন ঘটে বৃহৎ কৃষ্ণগহ্বরে রূপ নিতে পারে। অধিকাংশ ছায়াপথের কেন্দ্রে এ ধরনের কৃষ্ণগহ্বরের দেখা মেলে।

বিজ্ঞানীদের ব্যবহৃত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এই সময়ের  সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ইনফ্রারেড স্পেস-ভিত্তিক টেলিস্কোপ যার মাধ্যমে প্রথম পূর্ণ-রঙের চিত্রগুলি জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তারা এবং ছায়াপথগুলি দেখতে সক্ষম হওয়ার জন্য ইনফ্রারেড প্রয়োজন। ইনফ্রারেড হল ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণের একটি রূপ। ইনফ্রারেড (IR), কখনও কখনও ইনফ্রারেড আলো বলা হয়, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন (EMR) যা দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে বেশি। তাই এটি মানুষের চোখের অদৃশ্য। ইনফ্রারেড আমাদের ধূলিকণার মেঘের মধ্য দিয়ে দেখতে দেয়। ধুলোর মেঘ যেখানে তারা এবং গ্রহের জন্ম হয় এবং তাদের মাধ্যমে দেখতে সক্ষম হওয়া আমাদেরকে সেই তারা এবং গ্রহগুলি কীভাবে তৈরি হয় তা আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।এই টেলিস্কোপে দূরবর্তী তারা এবং গ্রহ থেকে আলো ক্যাপচার করার জন্য একটি বিশাল আয়না রয়েছে। আয়নাটি তার পূর্বসূরি হাবল স্পেস টেলিস্কোপে ব্যবহৃত আয়না থেকে ছয় গুণ বড়। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এমন বস্তুগুলি দেখতে সক্ষম যা আগের হাবল যা দেখতে পারে তার চেয়ে দশ থেকে ১০০ গুণ বেশি ক্ষীণ, এবং আগের যেকোনো টেলিস্কোপের তুলনায় ইনফ্রারেডে অনেক তীক্ষ্ণ এবং বিশদ ছবি তুলতে পারে। ১৮৫৬ সালে চাঁদ থেকে প্রথম ইনফ্রারেড বিকিরণের সনাক্তকরণ সম্ভব হয়।পরবর্তিতে, এর  থেকে আরও অনেক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি হয়েছে। ১৮৭৮সালে বোলোমিটারের উদ্ভাবন হয়েছিল, একটি ইনফ্রারেড পরিমাপ যন্ত্র, যার উন্নত সংস্করন ২০১৩ সাল পর্যন্ত হার্শেল স্পেস অবজারভেটরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইনফ্রারেড ডিটেক্টরগুলির সংবেদনশীলতা এবং নির্ভুলতার দিনদিন উন্নতি হতে থাকে  যা বিজ্ঞানীদের বৃহস্পতি এবং শনির মতো গ্রহ থেকে ইনফ্রারেড আলো সনাক্ত করতে সাহায্য করে।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া এরকম ছবি কিন্তু এই প্রথম নয়। হাবল নামক দূরবীন দিয়ে এর আগেও এধরণের ছবি পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো আজকের ছবির মত অতটা স্পষ্ট ছিলনা।যার নামে এই টেলিস্কোপের নামকরন করা হয় তিনি হচ্ছেন এডউইন হাবল-একজন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি ছায়াপথ, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং মহাবিশ্বের আকার-আকৃতি বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন যে আমরা পৃথিবী থেকে যে কুন্ডলাকার নীহারিকাগুলো দেখতাম সেগুলো প্রকৃতপক্ষে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মতই এক ধরনের ছায়াপথ। তবে হাবলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল মহাবিশ্বের ক্রম সম্প্রসারণ আবিষ্কার।হাবলের সূত্র মূলতঃ বলে যে, আমাদের থেকে একটি ছায়াপথের দূরত্ব যত বেশি হবে, তত দ্রুত তা সরে যাবে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপে এই সমৃদ্ধ প্রযুক্তির ব্যবহার  বিজ্ঞানের ইতিহাসে যোগ করেছে আগের চেয়ে আরও পিছনে তাকিয়ে, এবং আরো বেশি স্পষ্ট ও বিস্তারিত ছবি তোলার  সক্ষমতা। এর ফলশ্রুতিতে আমরা নিশ্চয়ই একদিন  মহাবিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্ব কেমন ছিল, কালগহ্বর, সৃষ্টি ও ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাস ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ণ অনেক  আবিস্কার প্রত্যক্ষ করতে পারবো। এমনকি হয়তো পৃথিবী ছাড়া মহাবিশ্বের অন্য কোথাও জীবনের অস্ত্বিত্ব যদি থাকে তাও জানা হয়ে যেতে পারে।

(তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট)