মতামত

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব  এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

– ফজলুল কবির মিন্টু

হস্তচালিত যন্ত্র, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট এর হাত ধরে বিশ্ব আজ ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের  মহা সড়কে যাত্রা শুরু করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যাত্রা পথে যুক্ত হয়েছে ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ, জীব প্রযুক্তি তথা বায়ো-টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিন এডিটিং, ইন্টারনেট অফ থিংস, ব্লক চেইন, মেশিন লার্ণিং  ইত্যাদি নানাবিধ বিস্ময়কর প্রযুক্তি। বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারনে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের চিকিৎসার জন্য আর কোন ডাক্তার প্রয়োজন হবেনা। মানুষের অনেক জটিল অপারেশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত রোবটের মাধ্যমে করা সম্ভব হবে। গাড়ি চালানোর জন্য ভবিষ্যতে আর ড্রাইভার প্রয়োজন হবেনা। ধারণা করা হয় ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতির সাথে সাথে মানব সমাজের কায়িক শ্রমের প্রয়োজনীয়তা সংকুচিত হবে -বিপরীতে জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর (Knowledge Based) কাজ বৃদ্ধি পাবে

আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশে শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় কোটি। এখানে দক্ষ-অদক্ষ এবং অর্ধ দক্ষ শ্রমিকের সম্মিলন ঘটেছে। এ সকল শ্রমিকের উপর ভর করে গড়ে উঠেছে শ্রমঘন শিল্প কারখানা। ৪র্থ শিল্প বিপ্লব যত বেশী অগ্রসর হবে তত বেশী শ্রমঘণ শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাবে এবং বৃদ্ধি পাবে উচ্চতর প্রযুক্তি নির্ভর মূলধন ঘন শিল্প কারখানা। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের আগমন এদেশের ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের জন্য সুখকর হবেনা। ব্যাপক শ্রমিক চাকরি হারাবে। শুধু বাংলাদেশেই আগামী ১০ বছরে ৫৫ লক্ষ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল সেক্টরে ৬০%, ফার্ণিচার সেক্টরে ৬০%, এগ্রো ফুড প্রসেসিং সেক্টরে ৪০%, লেদার সেক্টরে ৩৫% এবং ট্যুরিজম সেক্টরে ২০% শ্রমিক কাজ হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি আমরা যদি আমাদের তরুন প্রজন্মকে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সক্ষম হই তাহলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পণ্য তথা রোবোটিক্স সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করে তা বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পাশাপাশি ১ কোটি মানুষের কর্ম সংস্থান হবারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের প্রজন্মকে Critical Thinking, Creativity, collaboration এবং Communication এই চারটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ প্রযুক্তি নির্ভর আগামী বিশ্বের সাথে খাপ খেতে পারে এমন প্রজন্ম তৈরি করতে পারলেই বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করতে পারার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কায়িক শ্রম নির্ভর প্রযুক্তি জ্ঞান বঞ্চিত সাড়ে ছয় কোটি শ্রমিকের জীবন জীবীকা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ সব সময়ই ছিল।

১ম এবং ২য় শিল্প বিপ্লবের সময়েও শ্রমজীবী মানুষের চাকরি হারানোর চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু উক্ত সময়ের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষ তাদের অধিকারের প্রশ্নগুলোর ব্যাপারেও বিশ্ববাসির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে ১ম শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ও ২য় শিল্প বিপ্লবকালীন শ্রমিকশ্রেণির বড় অগ্রগতি ছিল দৈনিক শ্রমঘন্টা সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা হিসাবে  স্বীকৃতি অর্জন করা। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দৈনিক শ্রমঘন্টা সুনির্দিষ্ট ছিলনা। তখন শ্রমিকদেরকে দৈনিক ১২ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত শ্রম দিতে হতো।  মেশিনের সাথে বেঁধে রেখে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করানোর ইতিহাসও আমরা জানি।

২য় শিল্প বিপ্লবের সময় উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদনের গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বব্যাপী দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালে আন্তুর্জাতিক শ্রম সংস্থা আই এল ও প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কনভেশনটাও কিন্তু দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম বিষয়ক। অবশ্য এ ব্যাপারে ১৮৮৬ সালের শ্রমজীবী মানুষের রক্তস্নাত আন্দোলনও অন্যতম প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল। কেননা দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম প্রতিষ্ঠা করাই ছিল ১৮৮৬ সালের শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

বর্তমানে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের পূর্ণতার যাত্রাপথে, প্রযুক্তির একের পর এক অভাবনীয় সফলতা বিশ্ববাসির জন্য যেমন আনন্দবার্তা বয়ে আনছে তেমনি শংকার কারন হয়েও দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাসী এ পর্যন্ত ৩টি শিল্প বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় শিল্প বা প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার একটা বিপরীতমুখী সম্পর্ক রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের উল্টো পিটে আমরা দেখতে পাই, শিল্পে বা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যন্ত্রের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং শ্রমের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ শ্রম ঘন শিল্পের পরিবর্তে মূলধন ঘন শিল্পের প্রাধান্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপক মানুষ বেকার হয়ে পড়ার শংকা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে কম দক্ষ বা অদক্ষ এবং প্রযুক্তি জ্ঞান ছাড়া শুধু কায়িক শ্রম নির্ভর মানুষের ক্ষেত্রে এ সমস্যা সবচেয়ে বেশী প্রকট হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সুফল বিশ্বের সব মানুষের কাছে পৌছাচ্ছেনা। এ যেন বিশ্ব যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে বটে তবে এর নিয়ন্ত্রন কর্পোরেট পুঁজির কাছে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে মানুষে মানুষে বৈষম্য আরো বাড়বে। যা বিশ্বকে একটা ভয়াবহ মানবিক বিপর্জয়ের পথে ঠেলে দিবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। অথচ জাতি  সংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রার মূল শ্লোগান হচ্ছে কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবেনা এবং টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষমাত্রার মূল মর্ম হচ্ছে, খাদ্য সুরক্ষা-উন্নত পুষ্টি অর্জন এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ে তোলাএবং শোভন কাজ নিশ্চিত করা।  সুতরাং সবার জন্য কাজের সুযোগ সম্মানজনক মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আজ খুবই অপরিহার্য।

জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি, মাথা পিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বড় বড় দালান কোঠা, রাস্তা ঘাট, ফ্লাইওভার তৈরি এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি কখনোই মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হবেনা যদি না এর সুফলের অংশীদার শ্রমজীবী তথা দারিদ্র পীড়িত প্রান্তিক মানুষ হতে পারে।

এটি আজ সুস্পষ্ট যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে মূলধন ঘন শিল্প বাড়ছে  ফলে বিশ্ব আজ কর্পোরেট পুঁজির  একচেটিয়া  দখলে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতি এবং কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণ যেন একই সমান্তরালে এগিয়ে চলছে।

ফলে ৪র্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তির আগ্রাসন হিসাবে দেখা দিচ্ছে। সন্দেহাতীতভাবে উৎপাদিকা শক্তি, উৎপাদন সম্পর্ক, শ্রমের ধরন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। আগামী প্রজন্ম পযুক্তি নির্ভর নতুন বিশ্ব অবলোপন করবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি উপযোগী মানব সম্পদ তৈরি করে প্রযুক্তির অগ্রগতির সুফল মানব কল্যাণমুখী করাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখকঃ সংগঠক, কেন্দ্রীয় কমিটি, টিইউসি