বিজ্ঞান প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ভাবনা (৫২)

-বিজন সাহা

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। শেষ পর্যন্ত পদ্মার উন্মত্ত জলরাশিকে বশ মানিয়ে ঢাকার সাথে দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগ স্থাপিত হল। এ নিয়ে অনেক দিন থেকেই বিভিন্ন কথাবার্তা চলছিল সামাজিক মাধ্যম সহ সর্বত্র। সব কিছুকে ছাপিয়ে সামনে চলে এসেছিল পদ্মা সেতু। বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অনেকেই অবশ্য এত আড়ম্বরে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আদৌ দরকার আছে কিনা সে প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু সব আপত্তি, সমস্ত বাধাবিপত্তি পেছনে ফেলে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথেই শেষ আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছিল।

বন্যার যুক্তি শুনে আমার মনে পড়ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের এক জনপ্রিয় গানের কথা। বিজয় দিবস নামের এই গানের একটা লাইন – এটা অশ্রুসিক্ত নয়নে উৎসব। আমারও মনে হয়েছিল সিলেটের বন্যাদুর্গত মানুষের কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তারপরেও অশ্রুসিক্ত নয়নে আমাদের জাতির জীবনে এই আনন্দঘন মুহূর্তকে অবশ্যই বরণ করে নিতে হবে। বন্যা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। এর আগেও ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, এর চেয়েও অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিন্তু জীবন থেমে থাকেনি। আর পদ্মা সেতু উদ্বোধন করার মত দিন জাতির জীবনে একবারেই আসে। তাই কোন অজুহাতেই সেটা এড়িয়ে যাবার উপায় বা অধিকার আমাদের নেই।

আমার মনে আছে ১৯৭৪ সালের কথা। সে সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সড়ক সেতু তৈরি হয়েছিল আমার গ্রামে, আমাদের গ্রামে। তরা ব্রীজ নামে পরিচিত কালীগঙ্গা সড়ক সেতু উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ মনসুর আলী। যদিও সেই ১৯৭০ থেকে শুরু করে দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত চোখের সামনে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই সেতু, তারপরেও কতই না উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম সেই উদ্বোধনের দিনটার জন্য। এখনও মনে পড়ে আগের দিন বিকেলে গ্রামের যেসব লোক সেখানে কাজ করত তাদের সাথে কথা বলে আমরা বন্ধুরা মিলে দৌড়ে অন্য তীরে চলে গেছিলাম, তবে ঢাকার দিকের ওই মুখটা বন্ধ থাকায় সেখান থেকেই ঘুরে আসতে হয়েছিল। কত লোক যে এসেছিল সেদিন ব্রীজের উদ্বোধন দেখার জন্য। এর পরেই গ্রামের লোকজন ব্রীজের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে পার হয়েছিল নদী। আমাদের মত প্রাইমারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা সেদিন স্কুলে যায়নি। সে এক অন্য রকমের অনুভূতি। এর পরেও অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের বিকেলের কাজ ছিল ব্রীজের উপর দিয়ে হেঁটে অন্য পাড়ে যাওয়া। অনেক দিনের জন্য আমরা খেলাধুলা সব ভুলে গেছিলাম। ব্রীজের উপর দিয়ে হাঁটা, মাঝ নদীতে গিয়ে নীচে কিছু ফেলা বা সেখানে দাঁড়িয়ে বিদায়ী সূর্যকে টা টা দেওয়া। ভাগ্যিস তখন বিরোধী দল ছিল না। তবে অনেক পরে গ্রামে যখন ডাকাত ধরা পড়ে তাদের অনেককেই নাকি ব্রীজের মাঝখান থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমি দেখতে যাইনি। রাখালদের কাছে গল্প শুনেছিলাম।  যমুনা সেতু হওয়ার আগে পর্যন্ত এটাই ছিল দেশের দীর্ঘতম সড়ক সেতু আর এই ঢাকা আরিচা রোড ছিল ঢাকার সাথে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা। মনে পড়ে মস্কো বসে যখন যমুনা সেতু সম্পন্ন হবার কথা শুনি ক্ষনিকের জন্য হলেও মন খারাপ হয়েছিল। মনে হয়েছিল হঠাৎ করেই গর্ব করার মত কি একটা জিনিস নাই হয়ে গেল জীবন থেকে। কিন্তু সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র। এখন পদ্মা সেতুর কথা শুনে গর্বে বুক ফুলে উঠছে।

২০১৬ সালে যখন দেশে বেড়াতে যাই আহসান সহ কয়েকজন বন্ধু আমাকে নিয়ে যায় ওদিকে। তখন সেখানে সৃষ্টির উৎসব। এমনকি সেই ২০১৬ সালেও দেখেছি কী উত্তেজনা নিয়ে মানুষ অপেক্ষা করছে এই পদ্মা সেতুর জন্য। তরা ঘাটে যেমন রাস্তার দুই দিকে গড়ে উঠেছিল শত শত দোকান ঠিক তেমনি এখানেও লোকজন মেলা বসিয়েছিল আর যে সব লোকজন অপেক্ষা করছিল পদ্মার অন্য পাড়ে যাবে বলে তারা যেন মনে মনে এই দিনটির অপেক্ষাই করছিল।
শুধু তার দৈর্ঘ্য আর গুরুত্বের কারণেই নয় সেতু তৈরি নিয়ে যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে সে কারণেও পদ্মা সেতু  বার বার আলোচনায় এসেছে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ওয়াশিংটনের নব্য ঔপনিবেশিক নীতির কারণে বাংলাদেশ বার বার বাধা পেয়েছে বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে। আর এখানেই সে নিয়েছে ইদানিং কালের সব চেয়ে সাহসী পদক্ষেপ। যদিও এর আগেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেছে, কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের শর্ত না মেনে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল অভূতপূর্ব। এটা শুধু দেশের শক্ত মেরুদণ্ডের প্রকাশই নয় ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যবাদের নির্মাণরত কফিনে আরও একটি পেরেক।

যে সেতু হতে পারত দেশ ও জাতির জন্য ঐক্যের প্রতীক, নতুন পথ নির্দেশিকা – সেই সেতু নিয়ে শুধু দেশের বাইরে নয় ভেতরেও শুরু হয়েছিল নানা ষড়যন্ত্র। গুজব উঠেছিল পদ্মা সেতুর জন্য শিশুদের বলি দানের কথা আর সেটাকে কেন্দ্র করে মানুষের উন্মাদনা। এমনকি সেতু যখন তৈরি হল তখন এ উদ্বোধন বাঞ্চাল করার কত চেষ্টাই না করা হল। সমস্যা সেতুতে নয়, সমস্যা আমাদের চরিত্রে। আজকাল আমরা আর ভালো কাজের প্রশংসা করতে পারি না। কাজ ভালো না মন্দ সেটা বিচার করি কাজটা কে করল সেটা দেখে। ফলে সব দিক থেকে পদ্মা সেতু দেশের জন্য একটা ইউনিক প্রোজেক্ট হবার পরেও আমরা সবাই সেটাকে জাতীয় অর্জন বলে মনে করতে পারছি না। আর জাতি হিসেবে এখানেই আমাদের বড় ব্যর্থতা।

পদ্ম সেতু নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন আসছে। এরকম একটা প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা অনেক ক্ষেত্রেই যতটা না দেশের কথা চিন্তা করে তার চেয়েও বেশি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বা এই কাজে সরকারের সাফল্য ছোট করতে। এখানে যত না কাজ করে দেশপ্রেম তার চেয়ে বেশি ঈর্ষা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বুঝতে বাকী থাকে না যে যে সরকারই এটা করুক না কেন সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠত, সব ক্ষেত্রেই কমবেশি অনিয়ম দেখা দিত। কিন্তু এসব অনিয়মের বোঝাপড়ার জন্য আইন আদালত আছে, সংসদ আছে। এই মুহূর্তে এসব প্রশ্ন তোলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।

কিছুদিন আগে পদ্মা সেতুর নাম নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। সেতুর চেয়েও সেতুর নাম হয়ে পড়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এটাও রাজনৈতিক কারণেই। অথচ শুধু পদ্মা সেতু নাম রাখলেও কোনই ক্ষতি নেই। কই কালীগঙ্গা সড়ক সেতু তো কোন বিতর্কের জন্ম দেয়নি! কেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মানুষের হৃদয়ে স্থান না খুঁজে সেতু বা বিমান বন্দরে, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সাথে জড়িয়ে অমর হতে চায়?

সেতু মিলনের প্রতীক। সেটা নদীর দুই পাড়ই হোক আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির দুজন মানুষ বা দুটো দলই হোক। সেতু না হিন্দু, না মুসলমান, না আওয়ামী লীগ না বিএনপি। সেতু নিজে ধর্ম ও রাজনীতি নিরপেক্ষ। এই সেতু দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সব মানুষের সেতু। তাদের টাকায় গড়া। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন জন শুরুতে এর বিরোধিতা করেছেন। সেতু উদ্বোধনের সময় সরকার প্রধান বিভিন্ন ক্যাপাসিটিতে বিরোধী দলের নেতাদের আমন্ত্রণ জানালেই পারতেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের কাজকর্ম দিয়ে বিশ্বের দরবারে একজন সাহসী ও বলিষ্ঠ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই তিনি যদি বেগম খালেদা জিয়া, প্রফেসর ইউনুস – এদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেন সেটা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর হয়ে থাকত। কিন্তু তিনি উল্টো তাঁদের প্রতি কটূক্তি করলেন। তাই পদ্মা সেতু পদ্মার দুই পাড়কে মেলালেও দেশের রাজনৈতিক ধারাগুলোকে মেলাতে পারল না।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই একের পর থেকে ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ঘটনার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা। ইতিমধ্যে দুজন বাইকার মারাও গেছে। ফলে সেতুতে বাইক চালানো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ভাগ্যিস পদ্মা সেতুর প্রথম শহীদ বলে ঘোষণা দিয়ে কোন রাজনৈতিক দল তাদের লাশ নিয়ে মিছিল করেনি। একদিকে মানুষ সেতুর উপর নামাজ পড়ছে (কেউ যে সেখানে ঢাক ঢোল বাজিয়ে পূজার আয়োজন করেনি সেটাই রক্ষা) আবার আরেক দল সেখানে পেচ্ছাব করে গণ মাধ্যমে সেসব ছবি দিচ্ছে (এরা সবাই কি বহুমূত্র রোগে ভুগছে?)। আরেকজন আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কিছু নাট বল্টু খুলে ফেলেছে। এক কথায় জনগণ যে যেভাবে পারছে সেভাবেই পদ্মা সেতুকে বরণ করছে। কেউ প্রতিবাদ করে কেউ বা বিভিন্ন রকম প্রতীকী অ্যাক্টের মাধ্যমে। সরকারও বসে নেই। ইতিমধ্যে এসব ঘটনায় বিরোধী দলের কালো হাত বের করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তারা। ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজতে কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন কাজকর্ম দেখে মনে হয় অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার যেমন বাড়ছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সহমর্মিতা – এসব ক্ষেত্রে মন্দা বা অধঃপতনের হারও বাড়ছে একই গতিতে। আর এসব হচ্ছে শিক্ষার কারণে। শিক্ষা কি? এটাও একটা সেতু যা অতীতের সাথে ভবিষ্যতের সংযোগ ঘটায়। কিন্তু আজকের শিক্ষা, শিক্ষানীতি, রাজনীতি এসব কি একাত্তরের চেতনার সাথে বর্তমানকে সংযুক্ত করতে পেরেছে নাকি দেশ দিন দিন সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে? তাই আমাদের শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে যাতে নতুন সেতু দিয়ে নতুন মানুষ দেশকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে।

গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, দুবনা
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো, রাশিয়া