মতামত

শ্রমিকের কর্ম ঝুঁকি সুরক্ষা প্রসঙ্গে

-ফজলুল কবির মিন্টু

বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্ম সংস্থান মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)  বিগত ৮ জুন জেনেভায় এক সভায় মিলিত হয়েছেন। এতে উভয় পক্ষ এদেশে পেশাগত রোগ এবং দুর্ঘটনার জন্য চিকিৎসা সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের লক্ষে অন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম চালু করার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২১ জুন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম উদ্বোধন ঘোষনা করা হয়েছে। এটা একটি পরীক্ষামূলক স্কিম। সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথমে কিছু নির্বাচিত পোশাক কারখানার মাধ্যমে এই স্কিমের কাজ পরিচালিত হবে। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ গার্মেন্টস সেক্টর এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য সকল সেক্টরেও এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিমের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।  জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ হতে এই স্কিমের পরীক্ষ্মূলক কাজ শুরু হবে। স্কিমের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একটি ব্যাঙ্কে একাউন্ট খোলা হবে এবং সরকার, মালিক ও শ্রমিক তিন পক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠিত হবে। উক্ত কমিটি কর্তৃক ব্যাংক একাউন্ট এর মাধ্যমে শ্রমিকদের পেশাগত রোগ ও দুর্ঘটনাজনিত চিকিৎসা সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে এখন কোন শ্রমিক পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হলে চিকিৎসা সুবিধা ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানে পৌছানোর পথে যাত্রা শুরু হয়েছে বলা যেতে পারে। বাংলাদেশকে এই স্কিম বাস্তবায়নের জন্য নেদারল্যান্ড এবং জার্মান সরকার আর্থিক সহযোগিতা করবেন।

ইআইএস এ প্রতিরোধ, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ তিনটি প্যারামিটার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ এবং অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। অতঃপর কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরনের প্রশ্ন আসবে। উল্লেখ্য যে, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কিংবা পেশাগত রোগ পরবর্তী সেবা ও ক্ষতিপূরণ এর দায় শুধুমাত্র মালিকের হবেনা বরং এর দায় বর্তাবে ইআইএস কর্তৃপক্ষের উপর। স্কিমের সুবিধা পেতে হলে প্রতিষ্ঠানের মালিককে প্রতি শ্রমিকের বেতনের ০.৩৩% হারে টাকা জমা দিতে হতে পারে তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবে ত্রিপক্ষীয় পরিচালনা কমিটি। অবশ্য এরজন্য শ্রমিকের মজুরি হতে কোন টাকা কর্তন করা যাবেনা।

উন্নত বিশ্বে পেশাগত রোগ কিংবা দুর্ঘটনায় চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরন প্রদানের ক্ষেত্রে আদর্শ মানদন্ড হিসাবে আইএলও’র  -শ্রমিকের পেশাগত রোগে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত কনভেনশন ১৮, সামাজিক নিরাপত্তা (ন্যূনতম মান) কনভেনশন ১০২ এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত কনভেনশন ১২১ অনুসরণ করে থাকে। বাংলাদেশে এমপ্লয়মেন্ট স্কিম পরিচালনায় একই নীতি অনুসরন করা হবে বলে ধারণা করা যায়।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী সামাজিক সুরক্ষায় ৮টি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে  যার মধ্যে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই -কর্মক্ষেত্রে আহত বা নিহতের ক্ষতিপূরণ হতে হবে “Loss of Year Earnings” এবং “Sufferings” এর উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ নিহত বা আহতের আজীবন আয় ও ভোগান্তি হিসাব করে ভুক্তভোগিকে চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করা  উচিৎ বলে বিশেজ্ঞ মহলের অভিমত।  কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমান শ্রম আইনে কেবলমাত্র ক্ষতিপূরণ হিসাবে কিছু এককালীন থোক বরাদ্দ ছাড়া বাকী অন্যান্য বিষয়গুলি উপেক্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা ভুক্তভোগী শ্রমিকের বা তার পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করেনা।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ প্রনয়নের সময় কর্মক্ষেত্রে কোন শ্রমিক নিহত হলে ১ লক্ষ টাকা এবং স্থায়ী পঙ্গু হলে ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরন, আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটি এবং পেশাগত রোগে আক্রান্ত হলে ২ বছর পর্যন্ত সবেতন ছুটির কথা উল্লেখ ছিল।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধ্বসের কারনে ১১৩৭ জন শ্রমিক নিহত এবং আরও ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক আহত হলে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নেতিবাচকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে বাংলাদশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরন সংক্রান্ত বিষইয়টি ব্যাপক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে শ্রম আইন সংশোধনীর সময় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ দ্বিগুন করা হলেও আন্তর্জাতিক মানদন্ডের তুলনায় সেটাও যথেষ্ট অপ্রতুল বলেই প্রতীয়মান হয়। তাছাড়া শ্রম আইনে কেবল ক্ষতিপূরনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কিন্তু প্রতিরোধ কিংবা পুনর্বাসন বিষয়ে তেমন গুরুত্ব পায়নি। ফলে আইএলও, বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সম্মিলিত কার্যক্রম ও বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বিগত ২১ জুন এমপ্লয়মেন্ট ইনজুরি স্কিম উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়েছে – এতে  ইআইএস এর সাথে সংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পের কোনো কর্মী কর্মক্ষেত্রে আহত, নিহত বা দুর্ঘটনার শিকার হলে তাকে বা তার পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদে মাসিক ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। যাতে ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত যা দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশে বর্তমান ব্যবস্থায় আরেকটি অন্যতম দুর্বলতার দিক হচ্ছে –যদি প্রমানিত হয় যে, দুর্ঘটনায় নিহত-আহত শ্রমিক মালিক কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নির্দেশনা অমান্য করেছেন কিংবা শ্রমিক মাতাল  ও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কাজে যোগ দিয়েছেন তাহলে উক্ত শ্রমিক কোন ক্ষতিপূরণ পাবেন না। অন্যদিকে ইআইএস এর ক্ষেত্রে নো ফল্ট নীতি অনুসরণ করা হয় এখানে শ্রমিক আহত-নিহত হলেই আইন মোতাবেক চিকিৎসা এবং ক্ষতিপূরণ পাবেন। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য শ্রমিকের দোষ পাওয়া গেলেও ভুক্তভোগী শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন না।

বর্তমান ব্যবস্থায় ক্ষতিপূরনের পরিমান অপ্রতুলতা সত্ত্বেও অনেক মালিক সেটাও দিতে নানা গড়িমসি করে। ফলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রেও ভুক্তভোগী শ্রমিক কিংবা তার পরিবারকে নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট – ব্লাস্ট এর এক গবেষণার তথ্যমতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য শ্রম আদালতে মামলা করে রায় পেতে গড়ে ৬৩০ দিন লেগে যায়। অথচ শ্রম আইনে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি নির্দেশনা রয়েছে। এমন কি রায় পাওয়ার পরও টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে আরও নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হয়। ইআইএস চালু হলে যেহেতু ক্ষতিপূরণ পরিশোধের দায় মালিকের নয় সেহেতু ক্ষতিপূরণ এবং চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানী থেকে মুক্তি পাবে।

বর্তমান ব্যবস্থার তুলনায় ইআইএস নিঃসন্দেহে একটি উন্নততর ব্যবস্থা। আশা করি, এটি বাস্তবায়ন হলে হয়তো বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি নিরসনে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে। কিন্তু এখনই আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার সময় আসেনি। আমরা শ্রমজীবী মানুষ প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। এদেশে আইনের ঘাটতি যেমন আছে আবার আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়না। নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রশাসনিক গাফিলতির চক্করে পড়ে শ্রমিক প্রতি নিয়ত বঞ্চিত হয়। সুতরাং ইআইএস পরিচালনায় ত্রিপক্ষীয় কমিটির সফলতার উপর নির্ভর করবে এর সুফল শ্রমজীবী মানুষ পাবে কিনা? এছাড়া শুধুমাত্র একটি ব্যাংক একাউন্ট এবং ত্রিপক্ষীয় কমিটি দ্বারা ইআইএস সাময়িকভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে হলে এর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা থাকতে হবে অন্যথায় ইআইএস এর পথ চলা অংকুরেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি সরকার গুরুত্ব সহকারে ভাববেন এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখকঃ সংগঠক, টিইউসি, কেন্দ্রীয় কমিটি